কাঁটা আঙুলে বিশ্বজয়

বয়স তখন তিন কি চার হবে। দরজার ফাঁকে আঙুল পড়ে খানিকটা কাটা পড়লো। রক্তে হাত মাখামাখি অবস্থা। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পর দেখা গেল ডান হাতে সবচেয়ে বড় আঙুলের (মধ্যমা) উপরিভাগের খানিকটা পড়ে গেছে। এটা কোনো ভাবেই আগের অবস্থায় আনা সম্ভব না। এই বয়সে বাচ্চারা একটি ছুঁটে বেড়াতেই চায়। দুষ্টুমিটাও কম বেশি সব বাচ্চাই করে। তবে অনেক সময় দুষ্টুমিতে অনেক অঘটনও ঘটে যায়। এমনই এক দূর্ঘটনা ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ান পেসার প্যাট কামিন্সের জীবনে।

অবশ্য আঙুল খানিকটা ছোট হওয়ায় বোলিংয়ে কোনো সমস্যাই হয়নি। তার পেস, বাউন্স দেখলে বোঝার উপায়ই নেই ডান হাতের এক আঙুলের খানিকটা নেই। বল ধরতেও কোনো অসুবিধা হয় না। পেসারের জন্য মধ্যমা-আঙুলটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আউট স্যুইংয়ের জন্য এই আঙুলের ব্যবহারটা একটু বেশি হয়। তবে এই ছোট আঙুল কখনোই কামিন্সকে দমাতে পারেনি। পেস, বাউন্স, স্যুইং – সবটাই তিনি করেছেন অনায়াসে।

বাল্যকালের সেই দূর্ঘটনা পাশ কাটিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন সেরাদের কাতারে। বনে গেছেন টেস্টের অন্যতম সেরা বোলার। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা একজন পেসার।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক। ইয়ান ক্রেইগের পর সর্বকনিষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে টেস্টে অভিষেক হয় কামিন্সের। অভিষেকেই দ্বিতীয় ইনিংসের শিকার করেন ছয় উইকেট। বাংলাদেশী বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রের পর সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে এক ইনিংসে ছয় উইকেট শিকার করেন কামিন্স। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকের পর ওই সিরিজেই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি জার্সিও গায়ে তুলেন এই অলরাউন্ডার।

ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল ইনজুরি জর্জরিত। ইনজুরির কারণে শুরুতেই পিছিয়ে পড়েছিলেন। বাদ পড়েছিলেন বেশ কয়েকবার। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে আবার ধারাবাহিক পারফরম করে জাতীয় দলে ফিরেছেন তিনি।

অভিষেক টেস্টের পর দ্বিতীয় টেস্ট খেলেছেন প্রায় ছয় বছর পর! ইনজুরিতে সাদা পোশাকে চেষ্টা করেও ফিরতে পারেননি তিনি। ব্রেট লি, শন টেইটরা থাকায় ওয়ানডে দলেও শুরুতে থিতু হতে পারেননি। তবে ধীরে ধীরে সেরাটা দিয়ে নিজের জায়গাটা জাতীয় দলে পাঁকা করে ফেলেন এই পেস অলরাউন্ডার।

২০১৫ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেলেন। বছর দুই বাদেই প্রত্যাবর্তন করলেন টেস্ট ক্রিকেটেও। প্রথমবারের মত অ্যাশেজ সিরিজে খেলার সুযোগ পেলেন। এরপর সেখান থেকে আর হোচট খাননি। বনে গেছেন সময়ের সেরা টেস্ট বোলার। ২০২০ সালে উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ারের পুরষ্কারও জেতেন তিনি। একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের একশোতম ওয়ানডে উইকেট শিকার করেন কামিন্স।

গ্লেনব্রুক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে জুনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেটে পথচলা। এরপর ২০১০ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। বছর না গড়াতেই জাতীয় দলের দরজায় কামিন্স। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশে ওই মৌসুমে ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এরপরই ইনজুরির হানা! কামিন্সের ক্যারিয়ারের শুরুতেই বড় ধাক্কা।

ইনজুরি থেকে ফেরার পর আর পেছনে ঘুরে তাকাননি। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) এরপর থেকে প্রায় প্রতি আসরেই চড়া দামে বিক্রি হয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের এখন নিয়মিত এক মুখ তিনি। সাদা পোশাকে কামিন্সের গতি আর বাউন্সারের সামনে মুড়িমুড়কির মত হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং শিবির।

ওয়ানডেতেও তিনি সেরাদের একজন। লাইন-লেন্থ, অ্যাকুরেসিতেও দুর্দান্ত। ইনজুরির প্রবণতাও কমেছে। এখন নিয়মিতই খেলছেন তিনি। পেস বিভাগের অন্যতম ভরসাও কামিন্স। টিম পেইনের জায়গায় এখন টেস্ট ফরম্যাটে অজিদের অধিনায়ক তিনি। টি-টোয়েন্টিতে রান খরচা করছেন, উইকেট পাচ্ছেন না খুব একটা। আইপিএলেও বল হাতে তিনি সমালোচিত। তবুও ওয়ানডে ও টেস্টে তিনি সন্দেহ ছাড়াই সময়ের সেরা বোলারের একজন।

কাঁটা আঙুল নিয়েই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু। ইনজুরিতে বার বার ধাক্কা খেলেও দমে যাননি তিনি। ফিরে এসেছেন, সেরাটা দিয়ে বনে গেছেন সেরাদের একজন। কামিন্সের ধারাবাহিকতায় আর বাঁধা হতে পারেনি কিছুই। ক্যারিয়ার শেষে হয়ত নিজেকে নিয়ে যাবে আরও উপরে – প্রত্যাশা সমর্থক সহ অনেক ক্রিকেটারদেরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link