একটি রহস্যে ঠাঁসা বিশ্বভ্রমণ

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন তখন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। ওই সময় চার্লস উলমার ছিলেন র‌য়্যাল এক্সচেঞ্জ ইন্সরেন্স কোম্পানির সিনিয়র অফিসার। ভারতের কানপুরে পোস্টিং। পরিবার নিয়ে থাকতেন সেখানে।

কানপুরের জর্জিনা ম্যাকরোবার্ট মেমোরিয়াল হাসপাতালে তাঁর ছেলের জন্ম হয়। দিনটা ছিল ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। হাসপাতালের বিছানা থেকে কানপুরের বিখ্যাত গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামটা দেখা যেত। সেই ক্ষুদে শিশুটা একদিন ক্রিকেট বিশ্বে এতটাই খ্যাতিমান হন যে তাঁর নামে ওই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের নামকরণ করা হয়।

সেই ছেলেটা কে?

খেলোয়াড়ী জীবনের ছবি দেখে এই তাঁকে হুট করে চেনা সম্ভব না। তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন খুব বর্ণাঢ্য না হওয়ায় চেনাটা জরুরিও না। তবে, কোচ হিসেবে তিনি বিশ্বের অবিসংবাদিত সেরা।

তিনি বব উলমার। এবার মনে হয় না চেনার কোনো কারণ নেই!

শিফট হন ইংল্যান্ডে। বাবা কানপুরেই ক্রিকেট খেলতেন, ছেলেও বড় হয়ে ক্রিকেটকেই বেছে নেয় জীবন হিসেবে। ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯৭২ সালে ওয়ানডে অভিষেক। ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। খেলেন ১৯ টেস্ট ও ছয় ওয়ানডে। সাদামাটা ক্যারিয়ারে করেন ১,০৮০ রান। ১৯৮৪ সালে অবসরে যান, পিঠের ইনজুরির কারণে। তবে, পরিসংখ্যান যাই বলুক তিনি অন্তত এতটা ভাল ক্রিকেটার ছিলেন যিনি ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট খেলার মত যোগ্য ছিলেন। এটা ঠিক যে প্যাকারদের ওই সিরিজে না খেললে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে আরো হাইলি রেট করা হত। ১৯৭৭-১৯৮০ – এই তিনটা বছর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি সেটা প্রমাণ হয় তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পারফরম্যান্সে। সেখানে ৩৫০ টি ম্যাচ খেলৈ ১৫ হাজারের ওপর রান করেন ৩৪ টি সেঞ্চুরি ও ৭১ টি হাফ সেঞ্চুরিতে।

তবে, খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যতই সাধারণ হয়ে থাকুন না কেন – কোচ হিসেবে তিনি অনন্য। তিনি ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘উদ্ভাবনীয়’ কোচদের একজন। বিশেষ করে ক্রিকেট কোচিংয়ে প্রযুক্তির যোগাযোগ হয় তাঁর হাত ধরেই। আবার একই সাথে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির শিকারও হন তিনি।

যদিও, কোচ হওয়ার পর কখনো তিনি নিজের দেশ ইংল্যান্ডের বা অভিষেকের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার কোচিং করাননি। তিনি দু’টো জাতীয় দলের কোচ ছিলেন – দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান। দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে তিনি প্রায় অজেয় বানিয়ে ফেলেছিলেন, পাকিস্তান দলে ফিরিয়েছিলেন শৃঙ্খলা।

হ্যাঁ, আরো অনেকেই অবশ্য তাঁকে কোচ হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিল। ইংল্যান্ডে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি যাননি।

মারা যান ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ চলাকালে, ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যামাইকার টিম হোটেলে পাওয়া যায় তার মরদেহ। আত্মহত্যা, স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি খুন – আজো সেই রহস্যের কুল কিনারা হয়নি।

অনেকেই বলেন, সেটা স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়। বলা হয়, ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের বিরাট কোনো কিছু জেনে ফেলেছিলেন উলমার, তাই কেউ বা কারা উলমারকে সরিয়ে পথের কাঁটা সরিয়েছেন নিজেদের।

জন্ম এক দেশে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক। আবারও ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ভিন্ন দু’টি দলকে আন্তর্জাতিক কোচিং করানো। মৃত্যুটাও আবার আরেকটা দেশে।

সেই মৃত্যুতেও আবার কত রহস্য।

বব উলমারের জীবনের নানা রং, নানা রুপ – সব রং বা রুপ বোঝাও যায় না। জন্মেছেন ভারতে, খেলেছেন ইংল্যান্ডে, জীবন কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, মারা গেছেন ক্যারিবিয়নে- জীবন নয়, যেন রহস্যে ঠাঁসা এক বিশ্বভ্রমণ।

হয়তো তাঁর আত্মজীবনীটা বের হলে কিছুটা বোঝা যেত তাঁর জীবনটা। ওই ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ শেষেই কোচিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানিয়ে নিজের জীবনটা বইয়ের পাতায় আনতে চেয়েছিলেন। লেখার কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু, তাঁর ল্যাপটপেও তার কিছুও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর এটা তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহটা আরো প্রকট করে তুলে।

কি এমন লিখতে চেয়েছিলেন উলমার?

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link