সত্যি বলতে গত বছর যখন ক্যারিবিয়ান সফরে টেস্ট খেলতে নামলেন রোগাসোগা পিটারসেন নামের এক ব্যাটার দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে, মোটেই খুব একটা ভালো লাগেনি তাঁকে। মনে হয়েছিল তিন পজিশনে এ কাকে দেখছি, হাশিম আমলার মত লোক দীর্ঘদিন এই জায়গায় ব্যাট করে গিয়েছেন, সেখানে কোথাকার কে এই পিটারসেন। কেপি! কেভিন পিটারসেন? নাহ, কিগান পিটারসেন।
ক্যারিবিয়ান সিমারদের সামনে মোটেই খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না, ফলে ২ টেস্ট মিলিয়ে ৪০ এর সামান্য কিছু বেশি রান করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং এর হাল দেখে খারাপই লাগছিলো। কোথায় আমলা, ক্যালিস, ডি ভিলিয়ার্স, স্মিথ, ডু প্লেসিস, গিবস, কার্স্টেনদের ব্যাট করতে দেখেছি আর এখন কাদের দেখছি।
কিন্তু, অন্যদিক থেকে যদি দেখা যায়, বোঝা যাবে এরকম একটা সময় হয়তো প্রোটিয়া ব্যাটিং এর ক্ষেত্রে আসতোই, এটা ওদের ক্রিকেটে ট্রানজিশন পিরিয়ড, নতুনদের ওঠারই তো সময়, আর সেদিক থেকে দেখলে কিগান পিটারসেনের মত একজনকে প্রোটিয়া ব্যাটিং লাইনআপে দেখতে পাওয়ারই কথা।
কিগান পিটারসেন নামটা আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে মোটেই অপরিচিত নয়, প্রায় আট বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঘষাঘসি করে জাতীয় দলের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছিলেন বছর খানেক ধরেই। বোল্যান্ড এ জন্ম হওয়া কেপ প্রদেশের এই ব্যাটার ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৯ ম্যাচে ৯২৩ রান করে সর্বোচ্চ স্কোরার হন ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে, এর আগে ২০১৩-১৪ মৌসুমেও দুর্দান্ত খেলেন, সেবারেও ৯৬৫ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হন ৩ দিনের ম্যাচের প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টে।
মাঝে বেশ কিছুসময় একটু হারিয়ে গেলেও ২০১৯ এর শেষ থেকেই ‘এ’ দলে নিয়মিত কিংবা জাতীয় দলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যখন সুযোগ পেলেন হতাশই হতে হলো।
মানুষের জীবনে এমন একটা পর্যায় আসে যেখানে পারফরমেন্স করে দেখালে গোটা বিশ্ব ঠিক চিনে যায়, ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজও যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য ঠিক তেমনই একটা মঞ্চ, গোটা ক্রিকেট বিশ্বের বা সব মিডিয়ারই নজর থাকে ভারতের সাথে হওয়া যেকোনো সিরিজে।
সেঞ্চুরিয়নের প্রথম টেস্টেও সাড়া জাগাতে পারলেননা কিগান, কিন্তু ছোট্ট সময় যেটুকু উইকেটে ছিলেন টেকনিক্যালি মন্দ লাগছিলো না। এরপর জোহানেসবার্গ ও কেপটাউনের ২য় ও ৩য় টেস্টেই যেন ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার পালা আরো একটা পিটারসেন এসেছেন। দ্বিতী টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬২ এবং ৩য় টেস্টের ১ম ইনিংসে ৭২ ও ২য় ইনিংসে ম্যাচ জেতানো ৮২ রানে শুধুই মুগ্ধতার পালা।
দুর্দান্ত টেম্পারমেন্ট এর সাথে খুব ভালো ব্যাটিং টেকনিক এবং এর সাথে অনবদ্য স্ট্রোক প্লে ও মানসিক দৃঢ়তা কিগানের মধ্যে যা দেখা গিয়েছে তা অবশ্যই নজর কাড়ে। বিশেষত কেপ টাউনের কঠিন উইকেটে নিজের উইকেট বাঁচানোর পাশাপাশি নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেট করা বা স্ট্রোক প্লেতে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
শামি, বুমরাহ, শার্দুল, সিরাজ বা তৃতীয় টেস্টে উমেশ যাদবের মত দুরন্ত ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে বাউন্সি উইকেটে সাবলীলভাবে কিগানকে সামলাতে দেখে মনে হয় আন্তর্জাতিক সার্কিটে টিকে থাকতেই তিনি এসেছেন, এছাড়া অশ্বিনের মত স্পিনারকেও সামলেছেন খুব ভালো ভাবে চমৎকার ফুটওয়ার্ক দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট সিরিজ জয়ে বোলাররা যেমন দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছেন সেখানে ব্যাটিংয়ে পিটারসেন সত্যিই নজরকাড়া।
ঘরের মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে এই সিরিজে লেটার মার্কস নিয়ে কিগান উত্তীর্ণ হলেও, এরপরে নিউজিল্যান্ড সফরে সাউদি – বোল্টদের সামনে, এবারের ইংলিশ সামারে কিংবা বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়া সফরে স্টার্ক – কামিন্স – হ্যাজেলউড দের সামনে বড় পরীক্ষা বাকি রয়েছে। সেখানে তাঁকে নিয়ে যথেষ্ট কাটাছেঁড়া হবেই, পরবর্তীকালে উপমহাদেশের মাটিতে স্পিন খেলতে কেমন পারদর্শী হবেন সে বিচারও হবে।
আপাতত কিগান পিটারসেনের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের টেস্ট ক্রিকেটে তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনের একটা সমাধান পেলো এটা অবশ্যই বলা চলে। ইংল্যান্ডের কেভিন পিটারসেনের মতো এই ‘কেপি’ ও একদিন বিরাট হয়ে উঠতে পারেন কিনা সময়ই বলবে সে কথা।