যে হাসিতে হৃদয় হাসে

বিরাট কোহলির সেঞ্চুরিটি দেখতে পারিনি। খানিকটা আক্ষেপ হয়েছে। তবে সেঞ্চুরির পর তার হাসি দেখেছি। তাতে সব পুষিয়ে গিয়েছে! এই হাসি নির্ভার হওয়ার হাসি। স্বস্তির হাসি। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার হাসি। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় জয়ী হওয়ার হাসি। সবশেষ কবে এভাবে তাকে হাসতে দেখেছেন?

এবার এশিয়া কাপ শুরুর ঠিক আগে থেকে যে কোহলিকে দেখা যাচ্ছে, এই কোহলিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি অনেক অনেক দিন। নাহ, ২২ গজের দাপুটে ব্যাটসম্যান আর চোখ ধাঁধানো সেঞ্চুরিয়ান কোহলির কথা বলছি না। বলছি, ওই হাসিমুখের কোহলির কথা। কতদিন পর এমন প্রাণবন্ত, চনমনে, তরতাজা কোহলিকে দেখা যাচ্ছে!

এমন নয় যে, আগের সময়টাতেও হাসেননি। তবে সেই হাসিতে কখনও মিশে ছিল আক্ষেপ, কখনও জেদ, কখনও বেদনা, কখনও যাতনা, কখনও তাড়না, কখনও অসহায়ত্ব। কখনও কখনও হয়তো সেই হাসিতে খুশিও ছিল। তবে হাসি থেকে মনটা কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছিল। দেখলেই বোঝা যেত, তার হাসিতে হৃদয় নেই!

কেন ছিল না, তা এশিয়া কাপের আগে খোলাসা করেছেন কোহলি নিজেই। মনের সঙ্গে তার যুদ্ধ চলছিল। সেই লড়াইয়ে চেপে ধরেছিলেন নিজের শরীরকেও। ফলাফল, হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। শুধু ব্যাটসম্যান কোহলি নয়, আপন ছন্দে ছিল না ব্যক্তি কোহলিও।

ওই যে এক মাস সময় কোহলি ব্যাট ছুঁয়ে দেখেননি, তিনি বলেছেন, আমরা কত সহজে বলছি বা লিখছি। অথচ ভেবে দেখেছেন, কাজটা কতটা কঠিন ছিল? একজন আপাদমস্তক চ্যাম্পিয়ন, দুনিয়া জুড়ে বোলারদের শাসন করা শাহেনশাহ, নিজের পরিশ্রম, খাঁটুনি আর নিবেদনে গর্বের চূড়া খুঁজে নেওয়া অ্যাথলেট, নিজের সঙ্গে কখনও আপোস না করা খ্যাপাটে চরিত্র, এরকম একজনের জন্য মাঠ আর ব্যাটের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, বিরতি নেওয়া, নিজেকে বোঝানো, এসব ভয়ঙ্কর কঠিন। অহমে আঘাত আসে, মরমে চোট লাগে।

ফর্ম খারাপ? নিজেকে তিনি কীভাবে বোঝাবেন! ২০১৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরির পর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫০ ম্যাচ খেলে ২০ বার পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন তিনি। দুনিয়ার বেশির ভাগ ব্যাটসম্যান বর্তে যাবেন এই পারফরম্যান্সে। কিন্তু তিনি তো ‘কিং’, তিনি কোহলি। মানদণ্ড অনেক উঁচু তারে বাঁধা। তাই শোর উঠতে থাকল।

একটা সময় তিনি একটা চক্রে ছিলেন। পরিশ্রম-পারফরম্যান্স-রান-সেঞ্চুরি… এভাবে চলেছে দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ। কিন্তু ক্রিকেট খেলাটাই এমন, অনেক সময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও হয় না। সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেক সময়ই অনেক কিছুই পক্ষে আসে না। কোহলির সেই চক্রেও একটু বাস্তবতার নাড়া পড়ল। তার সেঞ্চুরি না করাটাই ব্যর্থতা!

ম্যাচ শেষে তিনি বলছিলেন, ‘ওই সময়টায় আমাকে বিস্মিত করেছে যেটা, সত্যি বলতে, তা হলো আমার ৬০ রানের ইনিংসও ছিল যেন ব্যর্থতা! আমার জন্য এটা ছিল ‘শকিং।’ আমার মনে হচ্ছিল, ‘ব্যাটিং তো ভালোই করছি, অবদানও রাখছি।’ কিন্তু দেখছিলাম, এটা আসলে যথেষ্ট হচ্ছিল না।’

এই যে ধাক্কা, এটা সামলানো সহজ নয়। হ্যাঁ, মানসিক শক্তি তার প্রচণ্ড। কিন্তু, দিনশেষে তিনি রক্তমাংসেরই মানুষ। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এবার এশিয়া কাপের আগ পর্যন্ত ২৩ ইনিংসে স্রেফ ৪ ফিফটি। খারাপ সময়ের থাবা এখানে অবশ্যই বলা যায়। তবে আসল ঝড় তো তার চলছিল মনের ভেতর। টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পর হুট করে দল নির্বাচনী সভার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জানতে পারলেন, তিনি আর ওয়ানডে অধিনায়ক নন!

বাংলাদেশের বোর্ড হলে এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কিন্তু ভারতের মতো একটা দেশের বোর্ড, সেটির প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলির মতো ব্যক্তিত্ব, সেই বোর্ড এমন অপেশাদারভাবে নেতৃত্বে পরিবর্তনের ব্যাপারটি সামলাবে, সেটিও আবার কোহলির মতো মহীরূহর সঙ্গে, অভাবনীয়ই বটে!

কোহলি নিজেও আকাশ থেকে পড়েছিলেন। মনের চোট তাতে আরও দগদগে হয়েছিল। হুট করে টেস্টের নেতৃত্বও ছেড়ে দিলেন। ব্যস, যুদ্ধটা তখন একার। সেই যুদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। একদিকে নিজের অসহায়ত্ব, আরেকটি হার না মানা মানসিকতার অহম। সেই টানাপোড়েনেই পারফরম্যান্সে ছিল ভাটার টান। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু না হয়, একটা পর্যায়ে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হয়। কোহলির এক মাসের বিরতি সেই বোঝাপড়ারই ফসল।

যুদ্ধটা তার একারই ছিল। তবে ময়দানে একা হয়ে পড়েননি। জীবনসঙ্গীকে এই লড়াইয়ে পেয়েছেন। কালকে ম্যাচের মাঝবিরতিতে বারবার তিনি বলেছেন আনুশকা শর্মার কথা। ম্যাচের পরও আবার বলেছেন, ‘স্পেশাল একজন মানুষের কথা বলেছি আমি, সব সময় যে আমার পাশে থেকেছে। আনুশকা। এই কয়েক মাসে আমার সত্যিকারের কাঁচা অবস্থাটা কাছ থেকে দেখেছে সে। সময়টা অনেক কঠিন ছিল। সে আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে, পরামর্শ দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে।’

মাঠ থেকে দূরে থাকার সময়টায় তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সম্ভবত, তিনি বুঝতে পেরেছেন, নিজের সবকিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। পারা যায় না সব সময়। তার কথায় সেটি ফুঁটে উঠেছে সেদিন, ‘অতীতে স্রষ্টা আমাকে অনেক ভাল সময় উপহার দিয়েছেন। এজন্যই এই অবস্থানে আসতে পেরেছি যে এত কথা হয়েছে। আমার এটা স্বীকার করে নিতে কোনো অস্বস্তিই নেই যে, স্রষ্টা আমাদের ভাগ্যে সবকিছু লিখে রেখেছেন এবং আমাদের স্রেফ কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। খুব রিল্যাক্সড হয়ে আমি সিস্টেমে ফিরেছি। কাউকে কিছু প্রমাণে মরিয়া ছিলাম না। সেটা সত্যিকার অর্থেই, এমন ভাবনা থেকে নয় যে, ‘আমার সব প্রমাণ করা শেষ হয়ে গিয়েছে।’ স্রেফ খেলাটাকে উপভোগ করতে চেয়েছি। এত বছর ধরে যা অর্জন করেছি, সেটা নিয়ে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, মাটিতে পা রেখে পরিশ্রম করে যাওয়া এবং মাঠে নেমে আবার সবকিছু শুরু করা। এই মানসিকতা নিয়েই ফিরে এসেছি।’

এই কথাগুলো থেকে আপনি কোহলিকে নতুন করে চিনতে পারেন। আপনার ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে, এতদিনের চেনা কোহলির সঙ্গে মেলাতে পারছেন না। কিন্তু তিনি নিজেও যে নিজেকে নতুন করে চিনেছেন! তার টেকনিক নিয়েও কম কাটাছেঁড়া হয়নি, বিশেষ করে গত ৭-৮ মাসে। নিজেকে ফিরে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় তিনিও গবেষণাগারে ঠেলেছিলেন নিজের টেকনিককে। কিছুই খুঁজে পাননি। তবে একটা সময় গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন, ‘কিচ্ছু না, কোনো টেকনিক্যাল বদল করিনি। অনেক পরামর্শ, উপদেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে। অনেকের অনেক কথা শুনেছি। লোকে বলাবলি করেছে, ‘আমি এটা ভুল করছি, ওটা ঠিক হচ্ছে না।’  নিজের সেরা সময়ের সব ভিডিও দেখেছি আমি। সেই একই ইনিশিয়াল মুভমেন্ট, বলের দিকে অ্যাপ্রোচ সেই একই, সব একইরকম ছিল। স্রেফ নিজের মাথার ভেতর যা চলছিল, সেটাই কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। দিনশেষে, একজন মানুষ নিজেই কেবল বুঝতে পারে সে কোথায় দাঁড়িয়ে এবং তার কী করা উচিত।’

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘লোকে কথা বলবেই, তাদের অধিকার আছে মতামত দেওয়ার। তবে কেউ নিজে কেমন বোধ করছে, তা অন্য কেউই বুঝবে না। আমি খুব ভিন্নভাবে এটা অনুধাবন করতে পেরেছি গত কয়েক মাসে। এই সময়টা সত্যি বলতে, আমার জীবনের খুবই স্পেশাল সময়। সময়টার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। শুধু ক্রিকেটে নয়, নিজের জীবনে সামনে এগোনোর জন্য হলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর  প্রয়োজন ছিল। ওই সময়টার জন্য তাই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে নিজের মতো করে ভাবতে পেরেছি, মেনে নিতে শিখেছি, একদম তলানিতে চলে যাওয়ার অনুভূতি পেয়েছি এবং আস্তে আস্তে ওপরে ওঠার পথ খুঁজে নিয়েছি। এখন স্রেফ উপভোগ করছি।’

উপভোগ করছেন বলেই তার হাসির রঙ বদলে গিয়েছে। কোহলির হাসি দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। বিশাল এই লেখার মূল উদ্দেশ্য এটিই, তার হাসির উৎস অনুসন্ধান।
যে কোনো সেঞ্চুরির চেয়েও অনেক দামি এই হাসি। তার ব্যাট আবার হাসতে শুরু করেছে। হয়তো আগের মতো করে আবার হাসতে থাকবে। হয়তো নয়। কী যায়-আসে তাতে!
তার মুখের হাসিতে তো এখন হৃদয় আছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link