বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ১০ হাজারের মত রান। সাথে আছে শ-দেড়েক উইকেট। যদিও প্রাপ্য সুনাম কুড়াতে পারেননি তিনি। শুধু তাই নয় বিশ্ব ক্রিকেটে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, জ্যাকব ওরামদের নিয়ে যতটা না মিডিয়াতে হৈচৈ ছিল তার একাংশও তাঁকে নিয়ে কখনো হয়নি।
তার মধ্যে পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি ছিল না ঠিকই, কিন্তু তাঁর টেকনিক ছিল অসাধারণ! আর সেটা দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেটে দীর্ঘদিন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সেই টেকনিক আর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত দিয়েই ঘরে তুলেছিলেন ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
হ্যাঁ, সাবেক ইংলিশ অলরাউন্ডার পল কলিংউডের কথা বলছিলাম!
তাঁর সময়ের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড অলরাউন্ডারদের একজন ছিলেন তিনি। যাকে নিয়ে বিশ্বক্রিকেটে খুব একটা হৈচৈও হয়নি, মিডিয়াতেও খুব একটা আলোচনায় ছিলেন না তিনি। কেভিন পিটারসেন, ইয়ান বেল, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফদের ভীড়ে এই প্রতিভাবান অলরাউন্ডার অনেকটাই ছিলেন আঁধারে। তাঁর সময়ের সেরা ফিল্ডারদের কথা আসলেও সবার উপরের দিকেই থাকবেন তিনি!
২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুলের ৯৪ রানের সেই ম্যাজিকেল ইনিংসটা কথা মনে আছে? ট্রিমলেট-পল কলিংউডের সামনে যেখানে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান দাঁড়াতে পারছিলেন না সেখানে ইংলিশ বোলারদের তুলোধুনো করেছিলেন আশরাফুল। সেই ম্যাচের নায়ক কে ছিলেন জানেন কি?
হ্যাঁ, পল কলিংউড! ব্যাট হাতে অপরাজিত ১১২ রান আর বল হাতে ৩১ রানে ৬ উইকেট। প্রথম ও একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ওয়ানডেতে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ছয় উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি৷ তার নেওয়া ৩১ রানে ৬ উইকেট আজও ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের হয়ে সেরা বোলিং ফিগার হিসেবে অক্ষত আছে!
পল ডেভিড কলিংউডের জন্ম ১৯৭৬ সালের ২৬ মে শাটল ব্রিজ, লন্ডনে। বাবা একটি ক্রিকেট ক্লাব চালালেও ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল পলের। এমনকি তিনি স্থানীয় ক্লাবে ফুটবলও খেলেছেন। মনে মনে যে একেবারে ফুটবলার হতে চাননি সেটাও না। তবে বাবার পরামর্শে ফুটবল থেকে সড়ে আসেন তিনি, পলের বাবা তাকে ক্রিকেটার হবার জন্য বলেন। বাবার কথায় সাড়া দিয়ে সেই ছোট্ট পল পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি ট্রফি হাতে তোলেন।
মাত্র ৯ বছর বয়সে স্কুল ক্লাব ক্রিকেটে বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৩ দলে সুযোগ পান তিনি। এরপর ক্লাব ক্রিকেট আর সেখান থেকে ডারহামের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পদাপর্ণ! ছয় বছর ডারহামে খেলার পর তার বোলিং শৈলি আর ব্যাটিংয়েও পারদর্শীতা দেখিয়ে ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে। পরবর্তীতে ডারহামের হয়ে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে সেঞ্চুরি করেন তিনি। পল কলিংউড তার সময়ে ইংল্যান্ডের অন্যতম ফিট খেলোয়াড় ছিলেন আর তাই নির্বাচকদের পছন্দের শীর্ষেই থাকতেন তিনি।
তার ক্যারিয়ারের শুরু এবং দুটোতেই তিনি ছিলেন চরম ব্যর্থ। অভিষেকের পর ওই সিরিজে চার ম্যাচে করেছিলেন মোটে ২০ রান, আর বল হাতে ছিলেন উইকেটশূন্য। ক্যারিয়ারের শেষ বছরে ওয়ানডেতে ৮ ম্যাচে ১৯ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১১৪ রান, সর্বোচ্চ ৩০ অপরাজিত।
ক্যারিয়ারের শুরুটা ভয়াবহ বাজে হলেও তার সামর্থ্য আর ফিটনেসে নির্বাচকরা খুশি থাকায় দল থেকে বাদ পড়েননি। তবে ক্যারিয়ারের মাঝের অংশটায় নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার পরে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টাই করেছিলেন। টেস্ট ফরম্যাটে বেশ ধারাবাহিক পারফর্মার ছিলেন, তবে ওয়ানডেতে মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলতেন তিনি।
ক্যারিয়ারের শুরু আর শেষটা যার ব্যর্থতার খাতায় লেখা সেই মানুষটাই ক্যারিয়ার শেষে ব্যাট হাতে ৬৮ টেস্টে প্রায় ৪১ গড়ে ৪২৫৯ রান করেছেন। আছে ১০ টি সেঞ্চুরি সাথে ২০ হাফ সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে ১৯৭ ম্যাচে ৩৫ গড়ে ৫০৯২ রান করেন, ৫ সেঞ্চুরির সাথে আছে ২৬ হাফ সেঞ্চুরি। ৩৬ টি-টোয়েন্টিতে তিন ফিফটিতে করেছেন ৫৮২ রান। তবে বল হাতে টেস্টের তুলনায় ওয়ানডেতে তিনি ছিলেন বেশ কার্যকর! টেস্টে মাত্র ১৭ উইকেট আর ওয়ানডেতে শিকার করেন ১১১ উইকেট যার মধ্যে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেওয়া ওই ৬ উইকেট ছাড়া আর একবারও পাঁচ উইকেটের দেখা পাননি।
অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডেতে খুব কিছু করতে পারেননি তিনি। তার নেতৃত্বে ২৫ ম্যাচে ১১ জয় পেলেও ইংলিশরা দেখেছে ১২ হার। তবে টি-টোয়েন্টি তে তিনি ইংলিশদের হয়ে সেরা অধিনায়কের একজন হিসেবেই রেখে গেছেন। ৩০ ম্যাচে ১৭ আর ১১ হার, যার মধ্যে ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জয়। ইংল্যান্ডের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি ট্রফি জেতেন কলিংউড। তার সময়ে সেরা দশ অলরাউন্ডারের একজন ছিলেন তিনি।
পল কলিংউডকে ব্রিটেনের রাণী এমবিই এওয়ার্ড বা মেম্বার অফ ব্রিটেন এম্পেরর হিসেবে মর্যাদা দেন! কিন্তু সেটা নিয়েও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তখন, অনেকেই বেশ সমালোচনাও করেছিলেন। মূলত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে শুধুমাত্র শেষ টেস্টেই খেলার সুযোগ পেয়েছিল কলিংউড, আর সেই টেস্টে দুই ইনিংসে মাত্র ৭ ও ১০ রান করেন তিনি! এরপরেও এমন মর্যাদাপূর্ণ এওয়ার্ড পাওয়ায় ক্রিকেটাঙ্গনের বেশ কিছু খেলোয়াড়ও তাকে হাসির পাত্র বানিয়েছিল যার মধ্যে সাবেক অজি গ্রেট শেন ওয়ার্নও ছিলেন।
তবে সব সমালোচনা জবাব তিনি পরের দুই সিরিজেই দিয়েছিলেন। পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে খেলা সেই দুই সিরিজে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন তিনি।
২০০১ সালে ওয়ানডেতে পাকিস্তানের বিপক্ষে আর ২০০৩ সালে টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক হওয়া কলিংউড প্রায় ১১ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০১১ সালে ব্যাট হাতে মোটেও ভালো সময় যাচ্ছিল না তার।
এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন। যদিও পরবর্তীতে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছিলেন বেশ কয়েক বছর। তবে ২০১৭ সালে তিনি সব ধরনের ক্রিকেট থেকেই অবসরের সিদ্ধান্ত নেন এবং বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সবাই প্রতিভা নিয়ে ক্রিকেটে আসে না কেউ কেউ যে নিজের সীমাবদ্ধ সামর্থ্য আর মেধা দিয়েও ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন এর মধ্যে একজন পল কলিংউড। তাকে হয়তো লিজেন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে না কিন্তু ইংল্যান্ড ক্রিকেটে তার অবদান এবং তার সময়ের তিনি সেরাদের একজন। ফুটবলের মায়া কাটিয়ে ক্রিকেটকে ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে জড়িয়ে ধরে তিনি ভুল করেননি, বরং ইংলিশ ক্রিকেটে রেখে গেছেন অপূরনীয় অবদান।