ডিম্বাকৃতি সবুজ মাঠ টার ঠিক মাঝখানের বাইশ গজ থেকে ড্রেসিংরুমে পৌঁছতে ঠিক কতটা পথ হাঁটতে হয়? ঋষাভ পান্ত হয়তো এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে বলবেন অনন্তকাল। অবসন্ন বিকেলে যখন তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগার থেকে মাত্র চার রান বাকি থাকতেই ড্রেসিংরুমে ফেরার পথ ধরতে হয়; তখন কষ্টে ভারী হয়ে ওঠা এই হৃদয় নিয়ে অনন্তকাল ধরে হেঁটে পৌছানো লাগে প্যাভিলিয়নে। আগে চারবার এবং মোহালি-তে পঞ্চমবারের মত এই ঘটনা যেন চিত্রায়িত করেছেন ঋষাভ পান্ত; ভারতীয় ক্রিকেটের – ‘Next Big Thing’।
বাঙালি-ভারতীয় ঋদ্ধিমান সাহাকে টেস্টে রিপ্লেস করাটা ভালভাবে নিতে পারেনি অনেক ঋদ্ধি ভক্তই। ব্যাটিংটা আশাব্যাঞ্জক ছিলেও উইকেটের পিছনে ছিল নড়বড়ে। বারবার প্রশ্ন উঠেছে দলে জায়গা নিয়ে৷ ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি মহেন্দ্র সিং ধোনির উত্তরসূরী হিসেবে আগমনের ফলে প্রত্যাশার চাপও ছিল আকাশচুম্বী।
কিন্তু, শুরু থেকেই ম্যানেজমেন্টের হাতটা কাঁধের উপর পেয়েছিলেন পান্ত। আর তাই এখন ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দিচ্ছেন আস্থার প্রতিদান। তিন ফরম্যাটেই এখন ভারতীয় দলের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান।
প্রথমবারের মত ঋষাভ পান্ত ভারতীয়দের হৃদয় জিতে নিয়ে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গ্যাবায় এক ঐতিহাসিক ইনিংস খেলে। তার আগে অবশ্য শতরানের ইনিংস খেলে ছিলেন,অবশ্য এতটা আলোড়ন তুলতে পারেননি। অজি আভিজাত্যের দুর্গ গাব্বা জয়ের অন্যতম অগ্রনায়ক হয়ে আছেন এই ঋষাভ। তবু ঋষাভদের পরিসংখ্যান আর সংখ্যায় বিচার করা যায় না, তাদের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে প্রতিটা শটে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি কিংবা অজিদের অপরাজেয় ব্রিসবেন, ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন, ওভাল অথবা আফ্রিকায় কেপটাউনে বারবার ঋষভ তার ব্যাটিং প্রদশর্নী দেখিয়েছে। গ্লাভস হাতে ধীরে ধীরে নিজের ভুল গুলো শুধরেছেন। এখন আর হাত ফসকায় না সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলটা, স্ট্যাম্পিংয়ের সুযোগও আর মিস করেন না পন্থ। ব্যাটিং আর কিপিংয়ের পাশাপাশি আইপিএলে কাপ্তানিও করেছেন দিল্লির হয়ে।
অনেক ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তই মনে করে পন্থ আসলে ব্যাটিং টা জানে না। টেকনিকে ভুল, ফুটওয়ার্কে সমস্যা। আসলেই ঋষভ ব্যাটিং টা জানে না, জানলে মোহালিতে চারটা রান করে সেঞ্চুরি করেই ফিরতো। নব্বইয়ের ঘরে পাঁচবার আউট হতো না টেকনিকালি সলিড হলে। কিন্তু পান্থারা হয়তো সেঞ্চুরি কিংবা ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের উর্ধ্বে। প্রতিটি ম্যাচে দলের বিপর্যয়ে কাউন্টার এটাক করে রান তোলার সাহস সব সলিড ব্যাটসম্যানের হয় না।
এক হাতে মেরেই বলকে লং অন দিয়ে বাউন্ডারি ছাড়া করার আত্মবিশ্বাসও অনেকের নেই। ফ্লুক,হুক কিংবা কাট; প্রতিবার ব্যাট হাতে নামেন পন্থ আর এসব হয়ে উঠে নৈমিত্তিক শট! প্রতিদিন ব্যাটে বলে ঠিকঠাক হয় না, শুনতে হয় সমালোচনা; শুনতে হয় বিদ্রুপ! কিন্তু যেদিন স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে ব্যাটটাকে দাঁড়ের মত করে দলের নৌকা পাড়ে ভেড়াতে পারেন সেদিন আবার ঠিকই ভালবাসায় সিক্ত হন।
সমালোচনা, ভালোবাসা, প্রত্যাশা কিংবা ক্রিকেট ব্যাকরনের নিয়মকানুন কোনটিই হয়তো মাথায় থাকে না ঋষভের। বাইশ গজে শুধুই নিজের মত চিত্র এঁকে যান। তবু তিনিও মানুষ, লাকমালের বলে বোল্ড হয়ে যখন স্টাম্পের সামনে বসে পড়েন সেটা অভিনয় নয়।
অতপর ধীর শান্ত পায়ে একটু একটু করে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে তার বুকের ভিতরের দু:সহ আওয়াজ কেউ কখনো শুনতে পায় না। থাক,যন্ত্রনা নিজের কাছেই রাখুক। পৃথিবী শুনবে পান্তের গর্জন, শুনবে নতুন অ্যাডাম গিলক্রিস্টের আগমনী বার্তা।