ব্রিস্টল। ১২ মে, ১৯৯৬। এক ভাই তখন লন্ডনের মেডিকেল কলেজে পড়ে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারির ক্লাস শেষ করে সে পৌঁছে যায় ব্রিস্টল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। নেহায়েতই একটা ওয়ার্ম আপ ম্যাচ চলছে। ইংল্যান্ড সফরে আসা ভারতীয় দল মুখোমুখি গ্লস্টারশায়ারের। তাড়াতাড়ি করে ব্রিস্টলে পৌঁছাবার কারণ হলো – সেই ওয়ার্ম আপ ম্যাচে তাঁর দাদার খেলতে নামার কথা।
কিন্তু গ্রাউন্ডে পৌঁছে দেখে তার দাদা একটা ব্যাট হাতে নিয়ে বসে আছে মনখারাপ করে। সে বুঝতে পারে হয় তার দাদা ব্যাট করতে নামেনি, অথবা তাড়াতাড়ি আউট হয়ে গেছে। দাদার পাশে গিয়ে বসল। তাদের কথাবার্তাটা ছিল নিম্নরুপ-
– হোয়াট হ্যাপেনড্?
– আই গট আউট ফর আ ডাক
– ওকে। ইটস্ অনলি গোয়িং বেটার ফ্রম হেয়ার।
কুমোরটুলির পঙ্কজ রায়ের ভিনু মানকড়ের সাথে করা ৪১৩ এর পার্টনারশিপ কিংবা দত্তাজি রায় গায়করের বদলে পঙ্কজ রায়ের টস করতে নামা অথবা দিলীপ দোশির অভিষেক ম্যাচে সাতটা উইকেট – ব্যাস এটুকুই। এতদিন অবধি বাংলার ক্রিকেট মুখ বলতে এটুকুই ছিল।
তবে এর ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য কর্ণপ্রয়াগের নির্মম সমাপ্তির মতোই গাঁথাছিল কিছু চালচিত্র,যেমন মনসুর পতৌদির তোপে গোপাল বসুর অভিষেক ব্রাত্য থাকা, অথবা শ্যামসুন্দর মিত্রের সাথে নোংরা রাজনীতি কিংবা অম্বর রায়ের নিশ্চিত দীর্ঘ ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারের ক্ষুদ্রিকরণ।
আবার দুর্ভাগ্যও আছে,যেমন কোচ পলাশ নন্দীর সিদ্ধান্তে ৮৯’ এর রঞ্জি ফাইনালে স্নেহাশীষের বদলে সৌরভের ডাক পাওয়া, যে ম্যাচে শুধু স্নেহাশিসকে দেখতেই উড়ে গিয়েছিল জাতীয় নির্বাচকরা। সব মিলিয়ে কিছুটা ভাগ্য আর বাকিটা রাজনীতি লবি মিলে বাংলার ক্রিকেট পোস্টারে এতদিন একটাই হেডলাইন ছিল – বাঙালি ডারকে ভাগ যাতা হ্যায়।
কাট টু ১৯৯৬। এক বছর বাইশের ছেলে ইংল্যান্ডে গিয়েছিল দল থেকে বাদ পড়ার চার বছর পর।তার আগের চিত্রনাট্যটা একটু বলে রাখি। দলের ম্যানেজার অভিযোগ হেনেছিল তার উপর, সে নাকি টুয়েলভথ ম্যান হয়ে ড্রিঙ্কস বইতেই চায়না, নিজের লাগেজ নিজে বইতেই চায়না। তার নামের উপর ট্যাগ নামানো আরম্ভ হয়ে গেছে অলরেডি – ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের ক্রিকেটার নয়। একবার নাকি সে ম্যানেজারকে চিঠিও লিখেছিল – ‘এমন ব্যবহার আপনারা করছেন যেন আমি রামু চাকর,মনে রাখবেন আমার ডাক নাম মহারাজা।’
সব মিলিয়ে অনেক বিতর্কে চার বছর ধরে সে দলে ভিড়তে পারেনি। বাঙালি পঙ্কজ রায় কিংবা দিলীপ দোশির পোস্টার নিয়ে বেশ সুখেই ভাতঘুম দিচ্ছিল। কিন্তু ৯৬’এর ইংল্যান্ড সফরটা যে ভাতঘুম কাটিয়ে চিরসবুজ বৈপ্লবিক শক্তিতে বাঙালিকে রাঙাবে সেটা বোধহয় পূর্বনির্ধারিত ছিল। যাই হোক, যেখানে শেষ করেছিলাম সেখান থেকেই শুরু করি।
গ্লস্টারশায়ারে তাঁর ডাক্তার ভাইয়ের ‘It’s only going better from here’ উক্তিটার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তার ব্যাট থেকে এসেছিল সত্তরটা রান। তারপর লাইন দিয়ে ওয়ার্ম আপ ম্যাচগুলিতে বেশ আত্মবিশ্বাস আদায় করল। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে লাস্ট ওডিআই তেও ইংল্যান্ডের স্যুইং সামলে লড়াকু ছেচল্লিশটা রান করে গেল সেই ছেলে। নাহ্, ‘ডারকে’ ভাগেনি সে।
কাট টু ২২ জুন, ১৯৯৬। লর্ডসের ক্রিকেট গ্রাউন্ড। দুদিন আগে তার অভিষেক হয়েছে আন্তর্জাতিক সাদা জার্সিতে। ইংল্যান্ডের পরিবেশ তখন চার বছর আগেকার ব্রিসবেনের ঠিক বিপরীত।বেশ স্যাঁতস্যাঁতে শীতল পরিবেশ। স্পিনার বলতে গ্রায়েম হিক আর টাফনেল, বল গ্রিপ করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তাই ভরসা ইংল্যান্ডের পেস ব্যাটারি।
এমনিতে বেশ সাদামাটা বোলিং লাইন আপ। ব্যাতিক্রম শুধু একজন ডোমিনিক কর্ক। কিন্তু সেই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতে ইংল্যান্ডের সবাই যেন ‘কর্ক’ হয়ে উঠেছে। বল বেশ ভালোই কাটছে। তবে সেই ছেলেটাকে বোধহয় অদৃশ্য এক স্যুইং খেলতে হচ্ছে, স্যুইংটা স্বয়ং ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিনের।
তিন নম্বরেই ব্যাট করতে নামিয়ে দেওয়া হলো অভিষিক্ত বাঙালিকে। কমেন্টেটর বলে উঠল – ‘সৌরভ গাঙ্গুলি,লেফট হ্যান্ড ব্যাটসম্যান, এজ টোয়েন্টি টু’। আর্লি উইকেট প্রেসার, স্যুইং আর ম্যানেজমেন্ট -যেন চাপের ত্রিশঙ্কু। প্রথমেই পিটার মার্টিনকে অফে একটা কভার ড্রাইভ আর তার একটা বল পরেই ফের শর্ট হওয়া একটা বলকে পুল মেরে বাউন্ডারির ঠিকানা দিয়ে লর্ডসের রাজসিংহাসনে রাজার অঘোষিত ঘোষণা – ‘আমি এসেছি’।
সবচেয়ে লম্বা ছিল বোধহয় ক্রিস লুইস। স্বভাবতই তার বলগুলো একটু বেশি উচ্চতায় আসছিল। কুছ পরোয়া নেহি। কিছু বলের ঠিকানা হলো ফাইন লেগ আর বাকিগুলোকে সোজা পুল মেরে ‘বাউন্ডারি-৫২০১’ ঠিকানায় পাঠানো হলো (৫২০১ লন্ডনের পিন কোড নাম্বার)। কিন্তু সবচেয়ে উপভোগ্য লড়াইটা বোধহয় ছিল কর্ক বনাম সৌরভ।
কর্কের বলগুলো প্রথমে হালকা আউটস্যুইং কাটছিল,কুঁজো হওয়া ট্রেডমার্ক স্টান্সে সেগুলোকে পাঠানো হলো কভারড্রাইভে। রাহুল দ্রাবিড়ের ‘নেক্সট টু গড ইন অফসাইড’ আখ্যা দেবার অনেক আগেই আথারটন, নাসের হুসেইনরা বুঝে গিয়েছিল এ ছেলের শক্তি পুরোটাই অফ। তাই চটপট প্ল্যানচেঞ্জ। কর্ক রাউন্ড উইকেট ছেড়ে ধরলেন ক্রস দ্য উইকেটটাকে।
আর বলগুলো ফুল লেংথ, সৌরভের পা লক্ষ্য করে। তাতে কি? কিছু বলকে স্ট্রেট ড্রাইভ, কিছুগুলোকে অন ড্রাইভ আবার কিছু ক্রিসপি শটও দেখা গেলো। পিটার মার্টিনকে কভারে মেরে হাফ সেঞ্চুরি পুরন। সাথে ফ্রি গিফট হিসেবে পাওয়া অদৃশ্য স্যুইং বোলার আজহারউদ্দীনের করমর্দন। দিশেহারা আথারটন একবার শেষ চেষ্টা করেছিল রনি ইরানি আর গ্রায়েম হিককে দিয়ে।
গ্রায়েম হিক রাইট আর্ম অফ ব্রেকার, সৌরভের প্রিয় খাদ্য। বেশিরভাগগুলোকেই স্কোয়ার কাট দিলেন।রনি ইরানির একটা বল পায়ে লেগেছিল। নট আউট। ওই একবারই বোধহয় বিব্রত বোধ করেছিলেন। কিন্তু তারপরের ঠিকানাগুলো সেই কভার অঞ্চলে। তবে কিছু ঠিকানা লেগসাইডে ছিল ক্রিস লুইসের জন্য।
তখন ব্যাট করছেন ৯০ রানে। উল্টোদিকে ফের কর্ক। আবারো ক্রস পিচ ধরেছেন। প্রথম বলটাতেই অন ড্রাইভ। পৌঁছালেন ৯৪ এ। পরেরটায় কভারে ঠেলে দিয়ে তিনটি রান। আর তার পরেরটায় ট্রেডমার্ক কভার ড্রাইভ। কালো রঙের স্কোরবোর্ডে লেখা হলো ‘Sourav Ganguly 101*’। নাসের হুসেইন বনাম সৌরভের স্ট্র্যাটেজির লড়াইয়ে সেদিন জিতেছিল একজন বছর বাইশের বাঙালি।
জিতেছিল ব্রাত্য গোপাল বসু। জিতেছিল রাজনীতির শিকার শ্যামসুন্দর মিত্র। জিতেছিল অরুণ লাল। জিতেছিল একটা গোটা বাংলা। জিতেছিল একটা গোটা দেশ। গ্যালারি জুড়ে তখন লর্ডসের ট্রেডমার্ক হ্যান্ড ক্ল্যাপস। কুমোরটুলির পঙ্কজ রায়কে সরিয়ে লর্ডসের ব্যালকনি পড়ে ফেলল বাংলার নতুন মুখ।
জীবনানন্দ দাশ তখন কোথায় ছিলেন জানিনা। হয়তো অদৃশ্য হয়ে ব্যালকনিতে আওড়াচ্ছিলেন –‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর।’ ভাতঘুম সরিয়ে পুনর্জাগরণ বাঙালির। স্ট্র্যাটেজির লড়াইয়ে কার্যত দিশেহারা কর্ক-মার্টিন-লুইস-ইরানি। সেঞ্চুরির ৬৭.৩২ শতাংশই এসেছে বাউন্ডারি থেকে!
একবার অরুণ লালকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সৌরভের সাথে বাকিদের তফাৎ কোথায়। ক্লাসিকাল ব্যাটসম্যান তো বাংলায় এর আগেও ছিল, এই যেমন অম্বর রায়ই, যথার্থই ক্লাসিক। লালজি উত্তর দিয়েছিলেন – ‘চাপের মুখে লড়বার বাঘের কলজে’।
সত্যিই, সেঞ্চুরির ট্রাক আগেও রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে বহুবার। কিন্তু ২৪-২৫ বছর আগেকার ২২ জুন তারিখে যে সেঞ্চুরি হেঁকেছিলেন সৌরভ, তাতে বোধহয় কিছু কলজে বোঝাই করা ছিল। অধ:নমিত বাঙালীর আকাশছোঁয়ার শতরান।
সেঞ্চুরি আগেও হয়েছে,ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু একটা সেঞ্চুরির মাধ্যমে একটা জাতিকে তুলে ধরা, ‘ডারকে ভাগ যাতা হ্যা’ কিংবা ‘রসগুল্লাবাবু’র ট্যাগলাইন সরিয়ে এক নতুন ট্যাগলাইন জন্ম দেওয়া-” বাঙ্গাল মে একদিন সুভাষ বোস জানাম লিয়া থা’ – এ আর হবে কি?
একবার একটা অ্যাডভার্টাইজের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন দেবার সূত্রে সৌরভ বলেছিল – ইস লিয়ে লোক মুঝে বাপ নেহি, দাদা ক্যাহাতা হ্যায়। সত্যিই তো – ‘Father creates a Generation & Dada leads the generation।’ অধ:নমিত ভাতঘুম জাতিকে তুলে ধরা একটা বছর বাইশের চওড়া কাঁধ – এ ‘দাদা’ ছাড়া আর কি।
বাবা চন্ডি গাঙ্গুলি ঠিকই বলেছিলেন – ‘ছোটটাকে দেখে রাখ, এ ঝাঁকাবে!