মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল! রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকালেন তিনি।
মাঠের বাইরে থেকে দিলশান, মাহেলা, মুরালিদের দৌড় আর বাধ ভাঙা উল্লাস!
১৮ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তুললো লঙ্কানরা। ১৩ বলে তিন ছক্কায় অপরাজিত ২৩ রানে শেষ ছোঁয়াটা তার হাতেই হয়েছিলো! এই স্মৃতি যখন আপনার মনে তাজা হচ্ছে ততক্ষণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন সেই ফাইনালের ফিনিশার থিসারা পেরেরা৷ মাত্র ৩২ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে গেছেন তিনি।
যে বয়সে ক্রিকেটারেরা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকে, সেরা সময় পার করে, যে বয়সটাকে ক্যারিয়ারের সোনালী সময় মনে করেন অনেকেই! সেই বয়সেই জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখলেন তিনি! তার সামনে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার প্রবল সম্ভাবনা ছিলো, সম্ভাবনা ছিল টি-টোয়েন্টিতে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন হিসেবে নিজেকে রেখে যাওয়া, সম্ভাবনা ছিলো ক্রিকেটের সেরা ফিনিশারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়া। কিন্তু তিনি নিজেকে মাঝ পথেই ছেড়ে দিলেন!
হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন তার সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। কিন্তু বর্তমান সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সেরা ফিনিশারদের একজন এই থিসারা পেরেরা যেতে পারতেন সর্বোচ্চ চূড়ায়।
মাত্র কিছুদিন আগেই প্রথম লংকান ক্রিকেটার হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছিলেন। তিনি উইকেটে থাকা মানে প্রতিপক্ষের বোলারদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কখনো নীল আকাশে হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেলেও সম্ভাবনা থাকে ঝড় না হবার, কিন্তু ২২ গজে যেদিন দাঁড়িয়ে যান থিসারা পেরেরা সেদিনটা বোলাররা স্বভাবতই মনে রাখতে চান না। ঘূর্নিঝড় কখন শুরু বা থামতে পারে সেটা হয়তো আপনি আকাশ দেখে বুঝতে পারেন কিন্তু থিসারা পেরেরা ঝড় শুরু হলে থামবে কখন সেটা বোঝার উপায় নেই!
৩ এপ্রিল, ১৯৮৯। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে জন্মগ্রহণ করেন লঙ্কান এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো ক্রিকেটার হবেন, আর সেই স্বপ্নকে লালন করেই ক্যারিয়ারে সময় নষ্ট না করেই অল্প বয়সেই জড়িয়ে গেলেন ক্রিকেটের সাথে। পেরেরা ওয়াটালার সেন্ট এন্থোনি কলেজ থেকে পাশ করার পর প্রসিদ্ধ কলেজ সেন্ট জোসেফে ভর্তি হন। এখান থেকেই সাবেক লংকান গ্রেট চামিন্দা ভাস, এঞ্জেলো ম্যাথিউস, দিমুথ কারুনারত্নের মতো খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। পেরেরা তার স্কুলের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন। যুব ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার হয়ে বিভিন্ন লেভেল তিনি ক্রিকেট খেলেছেন।
২০০৮ সালে তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পান। তখন তার সাথে একই দলে খেলেছিলেন দীনেশ চান্দিমাল, দিলশান মুনাভিরা, কুশাল পেরেরা ও লাহিরু থিরিমান্নে। একই বছরের নভেম্বরে তিনি প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে কল্টস ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে অভিষেক করেন। এরপর মাত্র ২০ বছর বয়সেই ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক করেন তিনি। সেই সিরিজের ৪র্থ ওয়ানডেতে কলকাতায় তিনি অভিষেক ম্যাচ খেলেন।
২০১০ সালেই তিনি চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সুযোগ পেয়ে যান। এরপর ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে সোফিয়া গার্ডেনে তার টেস্ট অভিষেক। ২০১২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হ্যাট্রিক সহ ক্যারিয়ার সেরা ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি! এরপর ২০১৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ভারতের বিপক্ষে রাঁচিতে টি-টোয়েন্টি হ্যাট্রিক করেন তিনি! ব্রেট লির পর একমাত্র বোলার হিসেবে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই হ্যাট্রিক করা কীর্তি গড়েন তিনি৷
পেরেরা ৬ টেস্টে এক ফিফটিতে ২০৬ রান করেছেন। ওয়ানডেতে ১৬৬ ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও দশ ফিফটিতে করেছেন ২৩৩৮ রান, স্ট্রাইক রেট ১১২ এরও বেশি। বল হাতে আছে ৩২ গড়ে ১৭৭ উইকেট! ৮৪ টি-টোয়েন্টি তে ৩ ফিফটিতে ১২০৪ রান ও বল হাতে ৫১ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ১৫২ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন তিনি।
তাঁর ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখলেই আঁচ করা যায় টেস্টে তিনি সাদামাটা হলেও সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে তিনি কতটা আগ্রাসী ব্যাটসম্যান ছিলেন। একা হাতে শ্রীলঙ্কাকে অনেক ম্যাচেই তিনি জিতিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়াও তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএল, বিগ ব্যাশ, বিপিএল, এসএলপিএল ও পিএসএলে খেলেছেন। বিশ্বের যেখানেই তিনি খেলেছেন নিজের আগ্রাসী ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছেন প্রতিক্ষেত্রেই।
অস্ট্রেলিয়ায় পেরেরাকে ‘পান্ডা’ হিসেবেই চিনে! বিগ ব্যাশে ব্রিসবেন হিটের হয়ে খেলার সময় তার অধিনায়ক জর্জ বেইলি তাকে এই নাম দেন। পান্ডা ছাড়াও লঙ্কান ক্রিকেটে তিনি টি.পি নামে পরিচিত। ২৬ জুলাই ২০১৩ সালে তিনি রবিন পিটারসনের এক ওভারে ৩৫ রান নেন যা ওয়ানডে ইতিহাসে এক ওভারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান নেওয়ার রেকর্ড! ২০২০ সালে অক্টোবরে শ্রীলঙ্কান আর্মি তে মেজর হিসেবে যুক্ত হন পেরেরা।
সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ! এর আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে গেলেন লংকান ক্রিকেটের এই আগ্রাসী ব্যাটসম্যান। শোনা যাচ্ছিলো আসন্ন বাংলাদেশ সফরে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারের সাথে বাদ পড়বেন তিনিও! হয়তো রাগে, ক্ষোভে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার টাই শেষ করে দিলেন তিনি। তবে পেরেরার না থাকাটা লংকান ক্রিকেটকে ভোগাবে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে।
৩২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার হয়তো লঙ্কান সেনাবাহিনীর কোনো কোরে যোগ দিবেন! কিন্তু মন পড়ে থাকবে ১২ বছর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার করা লঙ্কান ক্রিকেটেই। হয়তো একসময় আক্ষেপ করবেন, যেতে পারতেন অনেক উপরে কিন্তু থেমে গেছেন মাঝ পথেই।