গ্রাহাম অ্যান্থনি রিচার্ড টনি লক, যিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত টনি লক নামে। আরও স্পষ্ট করে বললে তিনি একজন পেশাদার ইংরেজ বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন, তবে সাদামাটা এই পরিচয়ের অনেক উর্ধ্বে তিনি। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সময়কালে ইংল্যান্ডের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এই কিংবদন্তির জন্ম ১৯২৯ সালের পাঁচ জুলাই। নি:সন্দেহে তিনি সর্বকালের সেরা স্পিনারদের একজন, একই সাথে বিতর্কিতও। বিশেষ করে জীবনের শেষটা তাঁর বিতর্কের সাথে সাথে বিষাদের সুরও বাজিয়েছিল।
জিম লেকারের সাথে মিলে টনি লক টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সফল স্পিন জুটি গড়েছিলেন। লেকার ছিলেন নিখুঁত ডানহাতি অফ-স্পিনার, আর লক ছিলেন একজন দুর্দান্ত বাঁ-হাতি স্পিনার যিনি বাতাস থেকে প্রচুর বাড়তি টার্ন পেতেন।
১৯৫৬ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে সেই বিখ্যাত অ্যাশেজ টেস্টে, লেকার অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দুটি উইকেট নিয়েছিলেন। লক তৃতীয় উইকেটটি নেন, কিন্তু লেকার সেই ম্যাচে বাকি ১৭ টি অস্ট্রেলিয়ান উইকেট নেন। লেকার ৯০ রান দিয়ে ১৯ টি উইকেট নিয়েছিলেন, যা আজ অবধি অপ্রতিরোধ্য রেকর্ড। লক সেই একটি উইকেট না নিলে হয়তো সেই টেস্টে একাই ২০ টি উইকেট নিতে পারতেন লেকার।
একই সাথে লক একজন অসাধারণ ফিল্ডার ছিলেন যিনি ৬৫৪ টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে মোট ৮৩১ টি ক্যাচ নিয়েছিলেন যা প্রথম-শ্রেণীর ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। লকের একটি প্রধান সমস্যা ছিল তিনি দ্রুত বল করার সময় কখনও কখনও নো-বল করতেন এবং এমনকি মাঝে মাঝে ডেলিভারি দিতে গিয়ে থেমে যেতেন। তাঁর এসব ঘটনা ওই আমলে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
লকের প্রথমদিকে বোলিং অ্যাকশন ছিল হাই আর্ম স্টাইল, যার ফলস্বরূপ তিনি খুব বেশি টার্ন পেতেন না। তারপর তিনি তার বোলিং অ্যাকশনে পরিবর্তন আনেন। এরপর বেশ কিছুটা সমতল গতিতে বোলিংয়ে ফিরে আসেন যা তাকে অনেক বেশি টার্ন পেতে সাহায্য করে। কিন্তু এর ফলে টেস্ট অভিষেকে তিনবারই অসচেতনভাবে থ্রো করার জন্য আম্পায়ারের ডাক পান।
১৯ বছর খরার পর ইংল্যান্ডের প্রথম অ্যাশেজ জয়ের নায়ক ছিলেন লক এবং লেকার। ১৯৫৩ সালের অ্যাশেজের প্রথম চারটি টেস্ট ড্র হয়েছিল। ওভালে পঞ্চম টেস্টে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া ২৭৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। একটি করে উইকেট নেন লক ও লেকার।
পরে ব্যাটিংয়ে নেমে ইংল্যান্ড ৩০৬ রানে লিড নেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে লক ৪৫ রানে পাঁচ উইকেট এবং লেকার ৭৫ রানে চার উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ১৬২ রানে আটকে দেয়। অবশেষে ইংল্যান্ড আট উইকেটে জিতে অ্যাশেজ ট্রফি পুনরুদ্ধার করে।
তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের শেষ টেস্টে, লক তার সর্বকালের সেরা ব্যাটিং করেছেন। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪১৪ রানের টার্গেট দেয়। কিন্তু আট উইকেট হারিয়ে ২৫৯ রান করা ইংল্যান্ডের জন্য তখন পরিস্থিতি বেশ জটিল দেখায়।
কিন্তু, লোয়ার অর্ডারে নেমে টনি লক এবং প্যাট পোকক যোগ করেন ১০৯ (পোককের অবদান মাত্র) রান, কারণ লক তাঁর সেরা ব্যাটিং করে স্মরণীয় ৮৯ রান করেন। তাঁর সেই ইনিংসটি অমূল্য প্রমাণিত হয়েছিল, কারণ ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত এক উইকেট বাকি থাকতে ড্র করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০,৩৪২ রান সহ লক কোন সেঞ্চুরি ছাড়াই সর্বাধিক রানের অবাঞ্ছিত রেকর্ডটি ধরে রেখেছেন। তার ৬৫৪ টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে তিনি ২৭ টি অর্ধশতক করেছেন, এমনকি তিনি তার শেষ টেস্টে ৮৯ টি রান করেছেন কিন্তু সবসময় লোয়ার অর্ডারে নম্বর থাকার কারণে সেঞ্চুরির দেখা পাননি প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে।
লক তাঁর বোলিং পার্টনার লেকারের ১৯ উইকেট নেয়া ম্যাচে ছিলেন। তিনি নিজেও এক ইনিংসে ১০ টি উইকেট নেওয়ার জন্য বিখ্যাত। ১৯৫৬ সালে কেন্টের বিপক্ষে টেস্টে তিনি প্রথম ইনিংসে ২৯ রানে ছয়টি এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪ রানে ১০ টি উইকেট নেন।
লক-লেকার জুটি বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক টেস্টে ব্যাটসম্যানদের ত্রাস ছিলেন, এমনকি কাউন্টি ক্রিকেটেও তাঁরা ব্যাটসম্যানদেরও আতঙ্কিত করে রাখতেন। দুজনেই কাউন্টিতে সারের হয়ে খেলতেন এবং সারেতে সাত বছরের আধিপত্যের বিস্তার করেছেন। তাদের ক্লাবটি ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ সময়কালে প্রতিটি মৌসুমে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জিততো যেটার নেপথ্যের নায়কও তাঁরা ছিলেন।
ক্যারিয়ারের শেষের দিকে লক পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। ২৮৪৪ টি উইকেট নিয়ে, লক প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সেরা দশ উইকেট শিকারীর তালিকায় নবম স্থানে রয়েছেন টনি লক। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৪৯ টি টেস্টে তিনি সব মিলিয়ে ১৭৪ টি উইকেট শিকার করেছেন এই স্পিনার।
লকের উইকেটের আবেদন এতই জোর গলায় ছিল যে তার দিনগুলিতে একটি পুরানো কৌতুক ছিল যে, লক যখন ওভালে আবেদন করে, তখন কেউ লর্ডসে আউট হয়।
তাঁর জীবনের শেষ দিকে, লক যৌন নির্যাতনের দুটি পৃথক অভিযোগের মুখোমুখি হন। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি পরে নির্দোষ প্রমাণিত হন। তার ছেলে রিচার্ড পরে বলেছিলেন যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রচার করে নাম করার জন্য তার খ্যাতির সুযোগ নিয়েছিল।
যৌন নির্যাতনের অভিযোগটি লক এবং তার স্ত্রী উভয়ের উপরই প্রভাব ফেলেছিল। অভিযোগের কয়েক মাস পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী মারা যান। এরই মধ্যে লকের ক্যান্সার ধরা পড়ে। আইনী খরচ চালানোর জন্য তাঁকে তার ক্রিকেটের কিছু স্মৃতিচিহ্ন বিক্রি করতে হয়েছিল। সমস্ত অভিযোগ থেকে নির্দোষ ঘোষণা করার মাত্র কয়েক মাস পরে লক মারা যান।
কে জানতো এমন বর্ণাঢ্য ক্রিকেটারের জীবনের শেষটা এমন করুণ হবে।