একটি অপমান ও একটি খ্যাতনামা ভেন্যুর জন্ম

খানিকটা সময় তর্ক-বিতর্ক চললো দু'পক্ষের মাঝে। ওয়াংখেড়ে বলে বসলেন আপনি যদি এভাবে করতে থাকেন তাহলে আমাদের নিজস্ব স্টেডিয়াম বানাতে হবে। প্রতিত্তোরে অনেকটা উপহাস করে বিজয় বলেছিলেন, ‘আপনাদের মত মারাঠি লোকদের জন্য এটা সাধ্যের বাইরে; স্টেডিয়াম বানানো এত সহজ না।’

ভার‍তের ২০১১ বিশ্বকাপ জয়, শচীন টেন্ডুলকারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ, ১৯৮৫ সালে সুনিল গাভাস্কারের ৬ বলে ৬ ছক্কা – মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম সাক্ষী হয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক ম্যাচের। এই স্টেডিয়ামে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক মূহুর্ত।

আছে স্টেডিয়াম তৈরির অজানা এক গল্প আছে, আছে অজানা এক ইতিহাস।

ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ইতিহাস টানলে আসবে আরেক স্টেডিয়াম নাম ব্রাবোর্ন; ওয়াংখেড়ের অনেকটা কাছেই অবস্থিত এই স্টেডিয়ামটি। ১৯৩৩ সালে ব্রাবোর্নেই ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরই ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া (সিসিআই) গঠন করা হয়। সিসিআই তখন জোর প্রয়াস করছিল নিজস্ব একটি স্টেডিয়াম তৈরি করতে। তবে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) তখন জমির বেশ অভাব। স্টেডিয়াম তৈরি করতে অনেক জায়গার প্রয়োজন।

সিসিআইয়ের তাই প্রয়োজন ছিল জায়গা নেওয়া। আর এই জায়গা পেতে হলে সরকারকে মানাতে হবে সবার আগে!

সে সময় সিসিআইয়ের সেক্রেটারি ছিলেন অ্যান্থনি ডি মেলো। অ্যান্থনি আর বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর্য স্থাপক অ্যান্টনি ক্রুসো বেশ ভাল বন্ধু ছিল। ক্রুসো তখন গভর্নরের একটি ছবি আঁকছিল। সে সময় বোম্বের গভর্নর ছিলেন লর্ড ব্রাবোর্ন।

গভর্নরকে উদ্দেশ্যে করে হঠাৎ ক্রুসো একটি প্রশ্ন করলেন। কেনো আপনি এই মানুষগুলোকে ফ্রিতে জমি দিচ্ছেন না? ক্রিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটা খেলা; ইংলিশরা এটা খেলতে পছন্দ করে। গভর্নর বললেন, ‘জমি খুবই দামি। কারণ এটা পাহাড় কেটে বানাতে হচ্ছে। এটা খুবই মূল্যবান; ফ্রিতে দিতে পারব না।’

এরপর ক্রুসো যেন মহামূল্যবান এক প্রশ্ন করে বসেন। ‘আপনার কি চাই? সরকারের জন্য টাকা নাকি ইতিহাসে আপনার নাম জনপ্রিয় হিসেবে থাকতে?’

গভর্নর খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এর মানে কি?’

ক্রুসো বললেন, ‘আমি ওদেরকে বলবো এই স্টেডিয়াম আপনার নামে দিতে।’ ব্রাবোর্ন তখন আর না করতে পারেননি। লোভাতুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন তিনি। সিসিআইকে ৯০ হাজার বিঘা জমি দেওয়া হলো; ১৩.৫ রুপি স্কোয়ার প্রতি! সিসিআই চেয়েছিল ওই স্টেডিয়ামটিকে ‘লর্ডস অব ইন্ডিয়া’ হিসেবে গড়ে তুলতে।

গ্রেগসন, বেটলে ও কিংসকে দায়িত্ব দেওয়া হল স্থপতি হিসেবে। অপরদিকে, শাহপুরজী পলোনজীকে দেওয়া হয় নির্মাণের দায়িত্ব।

২২ মে, ১৯৩৬। বোম্বের গভর্নর লর্ড ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলেন। এই স্টেডিয়ামটি এখন ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম নামেই সবার কাছে পরিচিত।

সত্তরের দশকে ক্রিকেট তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বোম্বে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কিংবা বিসিএ (বর্তমান মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) সে সময় বোম্বেতে সব ধরনের ম্যাচ আয়োজনের দায়িত্বে থাকত। বিসিএ ম্যাচ আয়োজনের সব কিছু করলেও সে সময় তাদের নিজস্ব কোনো স্টেডিয়াম ছিল না। যার কারণে সিসিআইয়ের অধীনে থাকা ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামেই সব ম্যাচ খেলা হত।

দুই অ্যাসোসিয়েশনের মাঝে লভ্যাংশ বন্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে থাকত সবসময়ই। সিসিআই’র আধিপত্যর কারণে বিসিএ নিজেদের শেয়ার, টিকেট কখনোই ঠিকমত বুঝে পেত না। বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক সাইমন ইংলিশ তাঁর বই সাইটলাইন্সের লিখেছেন, ‘সিসিআই টেস্টের মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ক্লাবটা তখন বেশ লোকসানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। টিকেটধারীদের জন্য আলাদা কোনো রুমও ছিল না।’

এতে অবশ্য বিসিএ বেশ ক্রুদ্ধ হন। সে সময় বিসিএ’র সভাপতি ছিলেন রাজনীতিবিদ শেষরাও ওয়াংখেড়ে। তখন কিছু মন্ত্রী আসল শেষরাও এর কাছে। তাদের পক্ষ থেকে শেষরাওকে বলা হল, ‘আসেন একটা ম্যাচ খেলা যাক। চ্যারিটি ম্যাচ – যা আয় হবে কোনো একটা চ্যারিটিতে দেওয়া হবে।’

মন্ত্রীদের কথা শুনে ওয়াংখেড়ে সাহেব বললেন, সমস্যা নেই আমি কথা বলছি। ওয়াংখেড়ে তখন সিসিআইয়ের সভাপতির কাছে গেলেন। সে সময় সিসিআই সভাপতি ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্ট। বিজয় মার্চেন্টের বাড়িতে সাক্ষাত করলেন ওয়াংখেড়ে। কিন্তু যখনই তিনি ওই ম্যাচের কথা উল্লেখ করে স্টেডিয়াম চাইলেন তখনই বাঁধলো বিপত্তি। বিজয় বললেন, না, স্টেডিয়াম দেওয়া সম্ভব না।’

এরপর খানিকটা সময় তর্ক-বিতর্ক চললো দু’পক্ষের মাঝে। ওয়াংখেড়ে বলে বসলেন আপনি যদি এভাবে করতে থাকেন তাহলে আমাদের নিজস্ব স্টেডিয়াম বানাতে হবে। প্রতিত্তোরে অনেকটা উপহাস করে বিজয় বলেছিলেন, ‘আপনাদের মত মারাঠি লোকদের জন্য এটা সাধ্যের বাইরে; স্টেডিয়াম বানানো এত সহজ না।’

এই এক লাইনই গায়ে লেগে গেল ওয়াংখেড়ের। মারাঠিদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই ক্ষোভ নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আর মনে মনে পণ করে ফেললেন নিজেদের স্টেডিয়াম করেই ছাড়বেন।

তৎকালীন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বসন্তরায় নায়েকের সাথে সাক্ষাৎ করলেন তিনি। জানালেন নিজেদের পরিকল্পনার কথা। নায়ক বললেন, ‘রাজ্য সরকারের কাছে তো এত বড় ফান্ড হবে না।’

ওয়াংখেড়ে বললেন, ‘আপনি শুধু অনুমতি দিন বাকি সব আমি দেখে নিব।’ অনুমতি পাওয়া গেল। স্টেডিয়াম বানানোর জন্য তো এখন জায়গার প্রয়োজন; অনেক বড় জায়গা। চার্চগেট আর মেরিনলাইনের মাঝে একটা জায়গা ছিল যেখানে বিসিএ নিজেদের একটা ক্লাব হাউজ তৈরি করছিল। ছোট একটা ক্লাব হাউজ, যেখানে একটা স্ট্যান্ড থাকবে প্রায় ৭ হাজার লোক বসার মত। সেখানে বেশ ভাল জায়গা ছিল, পাশে হকি খেলার মাঠ। একজন ডিজাইনার ছিলেন, যিনি ক্লাব হাউজটি তৈরি করছিলেন।

ওই ডিজাইনারকে বলা হল এখানেই এক বছরের মধ্যে একটা বড় স্টেডিয়াম বানিয়ে দিতে হবে! শশী প্রভু – ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের স্থপতি; ক্লাব হাউজ থেকে বানিয়ে দিলেন বিশাল এক স্টেডিয়াম!

স্টেডিয়াম তৈরির যথেষ্ট জায়গা অবশ্য সেখানে ছিল না। প্রায় ২০ একরের মত জায়গার দরকার ছিল। কিন্তু শশী প্রভুর কাছে ছিল মাত্র ১৩ একর। গড়ওয়ার ক্লাব হাউজের জন্য ৫.৫ একর জমির দরকার ছিল। অর্থাৎ স্টেডিয়াম বানাতে শশীর হাতে ছিল মাত্র ৭.৫ একর। ৭.৫ একর জমিতে শশীকে এমন এক স্টেডিয়াম বানাতে হত যার একপাশে থাকবে রেললাইন। আরেক পাশে থাকবে বেশ কিছু আবাসিক ভবন। আর এটা এরাবিয়ান সাগরের কাছেও হতে হবে!

১১ মাস ২৩ দিন পর তৈরি হল স্টেডিয়াম। ১ কোটি ৮৭ লাখ রুপিতে তৈরি করা হয় ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম; সময়ের হিসেবে অনেক অর্থ। বিসিএ প্রেসিডেন্ট শেষরাও ওয়াংখেড়ের নামেই নামকরণ করা হল – ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম।

১৯৭৫ সালে প্রথমবার স্টেডিয়ামটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের মধ্যকার ম্যাচ আয়োজন করে। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম তৈরির পর থেকে আর কখনোই ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য প্রথম পছন্দ ছিল না। ১৯৭৪ সালের পর মাত্র ১১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করেছে ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম। শেরশাহ ওয়াংখেড়েকে করা অপমানের চড়া মূল্যই দিতে হল সিসিআইকে!

সেদিন কে জানতো, একটা অপমান কতশত নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...