মেজাজটাই তো আসল রাজা

কাউন্টি খেলার মৌসুম। শীতের সকালে লাল বলে চলছে দেদার ক্রিকেটীয় মহড়া। সে সময়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে ল্যাংকাশায়ার লিগ আর কাউন্টির চল ছিল খুব। এক ব্রিটিশ বোলার বেশ লম্বা রান আপে বল করেন, গতিও বেশ ভালো।

ক্রিজে সদ্য এসে দাঁড়িয়েছেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। প্রথমবলটাই মাথা লক্ষ্য করে আগুনে বাউন্সার। ভিভ মাথা বাঁচাতে নীচু হলেন, আগুনে বাউন্সারের লাল বলটা ততক্ষণে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। ভিভ একটু চমকে গিয়েই যেন বলটা খুঁজতে নিলেন, এর মধ্যেই বোলারের টিপ্পনি, ‘কী রে বলটা খুঁজছিস? বলটার রঙ লাল আর মাঝে সাদা সেলাই, কাঠের বল, কিন্তু তুই খুঁজে পাবি না!’

ভিভ রিচার্ডস কোনো কথা না বলে চিকলেট চিবোতে চিবোতে আবার স্টান্স নিলেন, পরের বলটা মারলেন ব্যাটের মাঝখান দিয়ে,বলটা টনটন স্টেডিয়ামের গ্যালারি পেরিয়ে পাশের একটা সড়ক ডিঙিয়ে গিয়ে পড়ল টোন নদীর চড়ায়।

একটা রাজার হাসি হেসে সেই কাউন্টি বোলারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বলের ইতিহাস, ভূগোল তো অনেক শুনলাম, যা! এবার বলটা খুঁজে আন দেখি।’

আন্টিগার ভিভের বাড়ির পাশেই বাড়ি তাঁর অনুজ রিচি রিচার্ডসনের বাড়ি। রিচির ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ভিভ অধিনায়ক। রিচিকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য দলে নিজের ঐতিহাসিক তিন নম্বর পজিশনটা ছেড়ে দিলেন ভিভ।ক্যারিবিয়ান বোর্ড চমকে গেল ভিভের সিদ্ধান্তে।

রিচি ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালো হলেও ভিভের পাশে নেহাৎই শিশু। নব্বই-এর দশকের শুরুর দিক। সেই রিচি এখন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সিলেকশন মিটিং-এ সর্বেসর্বা। ভিভকে বলা হল ম্যালকম মার্শালকে বাদ দিতে। ভিভ নিজের ঔদ্ধত্যে হেসে উড়িয়ে দিলেন প্রস্তাব।

ক্যারিবিয়ান বোর্ডের ভেতর রিচার্ডসনকে ব্রুটাস হয়ে উঠছেন বোঝেননি ভিভ, ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে ফেলা হল ভিভকে, ভিভের ভাগ্য সেই আলোর রেখায় দুলতে লাগল যেখানে কোথাও ছায়ার মতো ছিলেন অসহায় জুলিয়াস সিজার, ভিভের চওড়া বুকে ব্রুটাসের মতো ছুড়ি মেরে গেলেন তাঁর ভ্রাতৃসম রিচি রিচার্ডসন।

যাওয়ার আগে ভিভ মাথা নামালেন না, বলে গেলেন, ‘দেখি তোরা আমাকে ছাড়া কী করতে পারিস, আমার যাওয়ার সময় হলে নিজেই সরে যেতাম, মনে রাখিস তোরা এতগুলো ট্রফি স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে পেরেছিলিস কারণ ব্যাট হাতে তিন নম্বরে আমি নামতাম।’

ব্র‍্যাডম্যানের ব্যাটিং গড়ের ধারেকাছেও নেই তিনি, শচীন টেন্ডুলকারের রানের দূর সীমানাও ছোঁয়নি তাঁর রেকর্ডবুক- তাহলে কে এই ভিভিয়ান রিচার্ডস? কেন পৃথিবীর তাবড় তাবর ক্রিকেট বিশ্লেষক সংস্থা একুশ শতকের শুরুতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর সার্ভে করে যে রেজাল্ট দিয়েছেন তাতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের নামে এসেছে ভিভিয়ান রিচার্ডসের নাম? কেন ভিভের নামটুকু শুনলেও আজও হাত কেঁপে যায় বিশ্বের ত্রাস হয়ে থাকা বোলারদের?

ইমরান খান একবার বলেছিলেন, ‘ব্র‍্যাডম্যানকে দেখিনি, কিন্তু ভিভের চাইতে ভালো কি আর সত্যি সম্ভব? জানা নেই!’

ভিভ আসলে এক যোদ্ধা। বহু বছর আগে ভিভের দাদার ওপর অসহনীয় অত্যাচার চালায় ব্রিটিশরা। দলে দলে কালো চামড়ার মানুষদের এনে ফেলা হয় ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পুঞ্জের অন্ধকারে্ অপুষ্টিতে ভুগে মারা যেতে থাকে হাজার হাজার মানুষ- ভিভ এদের প্রতিনিধি।

এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমার গায়ের রঙ আমার ঔদ্ধত্য, সাদা চামড়ার ব্রিটিশ দেখলেই ইচ্ছে করি বাউন্ডারিতে ছুঁড়ে ফেলি’, আফ্রিকার সংগ্রামে ভিভ রিচার্ডসের অবদানে নেলসন ম্যান্ডেলা পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘কংগ্র‍্যাচুলেশন ভিভ!’, আজও তিনি ম্যান্ডেলার এই কথাটুকুকে নিজের সমস্ত ক্রিকেটীয় রেকর্ডের ঊর্ধ্বে রাখেন।

ব্যাটিং গড় মাত্র ৫০, আধুনিক ক্রিকেটে কালিস, শচীন সকলে চেয়ে কম কিন্তু ভিভ রিচার্ডস নামক বিষ্ময়কে রেকর্ড দিয়ে বিচার করা মুর্খামি। ভিভের বুকে মানব বোমা বেঁধে দিয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠাতেন ক্লাইভ লয়েডভ ভিভের স্ফুরণে ভেঙে যেত প্রতিপক্ষের বোলিং মেরুদণ্ড।

টমসনের মতো বোলারকে ১৫১ কিলোমিটার বলে স্টেপ আউট করে মাঠের বাইরে ফেলার নাম ভিভিয়ান রিচার্ডস। ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে ছয় মারার নাম ভিভ রিচার্ডস, ইমরান খান থেকে ডেনিস লিলি হয়ে ওয়াসিম আকরাম পর্যন্ত বোলিং আক্রমণকে উলঙ্গ করে দেবার নাম ভিভিয়ান রিচার্ডস, সারাবিশ্বের কাছে ক্রিকেটের কালো হীরের নাম ভিভিয়ান রিচার্ডস!

ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের রক্তক্ষয় হলে যেন কোথাও রক্ত ঝরে ভিভের বুক থেকে। শচীন টেন্ডুলকারের সামনে একবার গ্লেন ম্যাকগ্রার ঔদ্ধত্য দেখে ভিভ মুখ খুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওর ঔদ্ধত্য দেখলে ইচ্ছে করে আর একবার ব্যাটটা তুলে নেই!’

রান কিংবা রেকর্ডকে ভিভ বলতেন জহরত, যা থেকে যাবে সিন্দুকে। রাজা ওই সম্পদের মালিক হতে পারেন কিন্তু রাজা রাজা হন তাঁর মেজাজে, তাঁর উপস্থিতিতে। সত্তরের দশকের পর থেকে ক্রিকেটের পৃথিবীতে সবচেয়ে চওড়া ব্যাটের ওপর লেখা থাকে ভিভের নাম। ঐ চিকলেট মুখে নিয়ে মাঠে নামা, ঐ নিজস্ব ভঙ্গিতে ক্রিকেটকে শাসন করা – এই চিত্রনাট্যে কোথায়ই বা রেকর্ডবুক, কোথায়ই বা স্কোরবোর্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link