সাত গোলের ধ্রুপদী থ্রিলার

কথায় আছে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। তবে ম্যানচেস্টার সিটি’র ওস্তাদ পেপ গার্দিওলা নিশ্চয়ই বাংলা প্রবাদটি পড়েননি। তাই তার ট্যাকটিক্সের মার ম্যাচের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছে। ম্যাচ শুরু হওয়ার পর অনেক দর্শক তখনও হয়তো আসনে বসেনি, তার আগেই রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্সকে নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করেছিল ম্যানচেস্টার সিটি।

ম্যাচের মাত্র ৯০ সেকেন্ডের সময় মাঠের বাম প্রান্তে বল পেয়েছিলেন রিয়াদ মাহরেজ। তার দুর্দান্ত এক চিপ পাস থেকে হেডের মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদের জাল কাঁপিয়ে দেন কেভিন ডি ব্রুইনা। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালের ইতিহাসে এটি দ্রুততম গোল। অফিসিয়াল ৯৫ সেকেন্ডের সময় করা গোলটি তাই আপাতত রেকর্ডবুকে স্থান করে নিয়েছে।

শুরুতেই গোল হজম করা রিয়াল এরপর কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই আরো কয়েকটি আক্রমণের শিকার হয়। খেই হারিয়ে ফেলা রক্ষণের ভুলে ১০ মিনিটের মধ্যে আরেকটি গোল হজম করে সফরকারীরা। লেফট উইং থেকে নেওয়া ডি ব্রুইনার ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে ভুল করে বসেন ডেভিড আলাবা। তার ভুলেই বক্সের ভেতর বল পেয়ে যান গ্যাব্রিয়াল জেসুস। সিক্স ইয়ার্ড বক্স থেকে দেখেশুনে বলটি জালে জড়ান এই ব্রাজিলিয়ান। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে পুরো ইতিহাদ।

১০ মিনিটের মাথায় দুই গোল; মনে হতে পারে কার্যত ম্যাচ ওখানেই শেষ। কিন্তু দলটা রিয়াল মাদ্রিদ বলেই হয়তো, আশা জিইয়ে ছিল ভক্তদের। সে আশার পালে হাওয়া দেন দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটাতে থাকা ক্যাপ্টেন করিম বেনজেমা। ম্যাচের ৩১মিনিটের মাথায় সতীর্থ ফারলান মেন্দি’র নিরীহগোছের ক্রসটি পেয়েছিলেন বক্সের একটু ভিতরে৷ কিন্তু চোখে লেগে থাকার মত এক ফিনিশিংয়ে হাফ চান্স থেকেই গোল করে দলকে ম্যাচে ফেরান করিম বেনজেমা।

এক গোলের লিড নিয়েই বিরতিতে যায় সিটিজেনরা। তবে মাহরেজ-ফোডেনরা সহজ কিছু সুযোগ মিস না করলে হয়তো বাড়তে পারতো গোলসংখ্যা। বিশেষ করে ম্যাচের ২৬ ও ২৯ মিনিটে দুটি দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি করে সিটি। প্রথমটি রাইট উইং থেকে উপরে ওঠা মাহরেজ অপর পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকা ফোডেনকে পাস না দিয়ে ডান পায়ে সরাসরি শট নিয়ে মিস করেন।

দ্বিতীয়টিও আসে একটি দ্রুতগতির প্রতি-আক্রমণ থেকে। রিয়ালের কয়েকজন প্লেয়ারকে কাটিয়ে বক্সের সামনে এসে ফোডেনকে পাস দেন ডি ব্রুইনা। বাঁপাশ থেকে বক্সে ঢুকে ফোডেনের নেওয়া শট অল্পের জন্য ডান পোস্টের বাইরে দিয়ে যায়।

তবে বিরতি থেকেই ফিরেই দলের গোলসংখ্যা তিনে নিতে ভুল করেননি ফিল ফোডেন। আগের অনেকবারের মতই এবারও প্রতিপক্ষের ক্রস সামলাতে ব্যর্থ হয় নাচো-মিলিটাও’রা। আর সে সুযোগে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিল ফোডেনের নিচু হেডারে বল খুজে নেয় মাদ্রিদের জাল। এবারের গোলটি করিয়েছিলেন ৫৩ মিনিটের সময় মাঠে নামা ফার্নান্দিনহো।

তবে ভেঙে পড়েনি স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। মাত্র দুই মিনিট পরেই ভিনিসিয়ুস জুনিয়র প্রায় একক প্রচেষ্টায় দলকে গোল এনে দেন। গোল করিয়ে বাহবা কুড়ানো ফার্নানদিনহোর ভুলে মিনিটের মধ্যে আক্রমণের শিকার হয় স্বাগতিকরা। ঠিক মধ্যমাঠে তার কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে লেফট উইং দিয়ে উপরে উঠেন ভিনিসিয়াস।

তার গতির সাথে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টাই করেনি সিটির কোনো ডিফেন্ডার। যে কারণে এক দৌড়ে বক্সে প্রবেশ করে ফেলেন ভিনি। গোলরক্ষকের কাছে এসে যখন শট নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান, তখন সেন্টারব্যাক লাপোর্তা তা ফেরানোর উদ্দেশ্যে স্লাইড দেন।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ভিনির একক বীরত্বে গোল হজমের দুই মিনিটের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনে মাদ্রিদ। সিটি ডিফেন্ডার ফার্নান্দিনহোকে বোকা বানিয়ে ভিনি জুনিয়রের করা এই গোল নিসন্দেহে বারবার দেখতে চাইবে ফুটবল সমর্থকেরা।

তবে ফুটবলশৈলী দেখার বাকি ছিল আরো কিছু অংশ। ভিনি জুনিয়রের দুর্দান্ত ড্রিবলিং দেখার পর পর্তুগিজ বার্নান্দো সিলভা অবশ্য পূরণ করেন সে ইচ্ছে। থিবো কোর্তায়াকে অবাক করে দিয়ে বক্সের ডান কোনা থেকে নেয়া এক বাঁকানো শটে দলকে আবারো এনে দেন দুই গোলের লিড। তার এই গোল ঠেকানো তো দূরে থাক, থিবো কোর্তায়া হাত বাড়ানোর সুযোগ-ও পায়নি।

ম্যাচে তৃতীয় বারের মত দুই গোলের লিড নিয়েও সেটি ধরে রাখতে পারেনি পেপ গার্দিওলা’র শিষ্যরা। তবে ৮২ মিনিটের শেষ গোলটিতে অবশ্য ভাগ্যের দোষটাই বেশি৷ প্রায় মাঝমাঠ থেকে টনি ক্রুসের নেয়া সেটপিস এসে আয়মেরিক লাপোর্তের হাতে লেগে যায়। পেনাল্টি’র বাঁশি বাজাতে দুইবার ভাবতে হয়নি রেফারি-কে।

অবশ্য আগের লিগ ম্যাচেই দুই দুইবার পেনাল্টি মিস করা করিম বেনজেমা এবার গোল করতে পারবেন কিনা সেটি নিয়ে তখনও হয়তো দুশ্চিন্তায় ছিল মাদ্রিদ ভক্তরা। তবে সব চাপ উড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পানেনকা কিকে গোলে পরিনত করেন এই স্ট্রাইকার।

স্কোরলাইনে পুরোপুরি বোঝা না গেলেও ম্যাচে প্রায় একতরফা দাপট ছিল স্বাগতিকদের; বারবার সুযোগ সৃষ্টি করলেও কাজে লাগাতে পারেনি তারা। একবার গোলপোস্টে লেগে, আরেকবার লাইন থেকে বল ক্লিয়ার করেছিলেন দানি কারভাহাল। শেষ পর্যন্ত জিতলেও হয়তো সুযোগ মিস নিয়ে ড্রেসিং রুমে আফসোস করতে পারে ইংলিশ ক্লাবটি।

অন্যদিকে সফরকারী ব্ল্যাঙ্কোসরা গোল করার যে সুযোগ পেয়েছিল তার সবই প্রায় কাউন্টার এটাকে। তবে এমন চাপের পরিস্থিতিতেও তিন গোল করতে পারাটা নির্ঘাত স্বস্তি দিবে তাদের।

অবশ্য পুরো ম্যাচ জুড়েই দুই দলের ডিফেন্ডারদের ছিল বেশকিছু দৃষ্টিকটু ভুল। বিশেষ করে মাদ্রিদ ডিফেন্ডারদের পজিশনিং ছিল খুবই বাজে, যার কল্যানে বারবার ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করতে পেরেছিল সিটিজেনরার। ম্যানসিটি-ও অবশ্য বিপদজনক জায়গায় বল হারিয়েছিল কয়েকবার।

সবমিলিয়ে আক্রমণ, প্রতি আক্রমণের এক গোলবন্যার ম্যাচ দেখেছে বিশ্ব। বারেবারেই উত্তেজনা ছড়িয়েছে দর্শকদের মাঝে। আর চমৎকার পাসিং, শৈল্পিক ড্রিবলিং তো মুগ্ধ করেছেই গ্যালারিতে কিংবা টিভি পর্দার সামনে থাকা অগনিত চোখ জোড়াকে।

গল্পটা অবশ্য শেষ হয়নি এখনো। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালের এই রোমাঞ্চকর উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ আসবে চার এপ্রিল রাত একটায়। এবার অবশ্য ঘরের মাঠেই প্রতিপক্ষকে আতিথেয়তা দিবে স্পেনের জায়ান্টরা।

ঘরের মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তো অল হোয়াইটরা নাকি প্রয়োজনীয় ড্র কিংবা জয় নিয়ে ফিরতে পারবে গার্দিওলা’র দল? আপাতত অবশ্য জানার উপায় নেই, অপেক্ষাতেই থাকতে হচ্ছে ফুটবলের রোমাঞ্চপ্রেমীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link