ফরাসি লিগ কেন কৃষক লিগ!

গত এক দশক ধরে ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগ লিগ ওয়ানকে একপ্রকার নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে পিএসজি বা প্যারিস সেইন্ট জার্মেই। সর্বশেষ এক দশকে কেবলমাত্র মোনাকো এবং গত মৌসুমের চমক লিলে কেবলমাত্র পিএসজির আধিপত্য ভেঙে শিরোপা জিততে পেরেছে। দর্শকরা তাই মজা করে লিগ ওয়ানকে ডাকে কৃষক লিগ নামে।

ইউরোপিয়ান ফুটবলে সেরা পাঁচ লিগ শব্দটা খুব বেশি প্রচলিত। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা, জার্মান বুন্দেলীগা, ইতালিয়ান সিরি আ এবং ফ্রান্সের লিগ ওয়ানকে একত্রে এই নামে সম্বোধন করা হয়। বাকি চার লিগেই শিরোপার জন্য তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হলেও লিগ ওয়ান রয়ে গেছে এক ঘোড়ার দৌড় হিসেবেই। দর্শকেরা তাই লিগ ওয়ানকে বাকি চারটি লিগের সাথে তুলনা করতে নারাজ। দর্শকদের চোখে লিগ ওয়ানে ঐতিহ্যবাহী কোনো ক্লাব নেই। বরং গত কয়েকবছরে পেট্রো ডলার বিনিয়োগ করে সাফল্য কিনে নিয়েছে।

কৃষক লিগ বা ফার্মার্স লিগ শব্দটা দ্বারা দর্শকরা বোঝাতে চান লিগ ওয়ান খেলে এমন সব মানুষ যারা কিনা সারাদিন মাঠে কৃষিকাজ এবং দিনের শেষে সন্ধ্যায় শখের বশে ফুটবল খেলে। অর্থাৎ তাদের মাঝে স্কিলের বালাই নেই। ফুটবলে লাথি মারতে পারে তাই খেলে থাকে। এমন এক ফুটবল প্রতিযোগিতা যেখানে কেবল একটা দলই খেলে থাকে। লিগ ওয়ানকে সবসময় এভাবেই ব্যঙ্গাত্নক চোখে দেখে এসেছে অন্যান্য দেশগুলোর ফুটবল সমর্থকেরা।

অন্যান্য লিগগুলোতে যেমন কয়েকটি দল ইউরোপে টেক্কা দেবার মত দলগঠন করে সেখানে লিগ ওয়ানে কেবল পিএসজিই একমাত্র নিয়মিত ইউসিএলে অংশ নিয়ে থাকে। বাকি দলগুলো কালেভদ্রে অংশ নিলেও বেশিরভাগ সময় বাদ পড়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই। লিগেও যেন তারা লড়াই করে দ্বিতীয় হওয়ার জন্যে।

লিগ ওয়ানে এক ক্লাবের আধিপত্য পিএসজি দিয়েই শুরু নয়। আশির দশকে লিগ ওয়ানের প্রতিশব্দ যেন ছিল অলিম্পিক মার্শেই, টানা পাঁচ মৌসুম শিরোপা জিতেছিল তারা। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্রান্সের মানুষ দেখেছে অলিম্পিক লিঁওর রাজত্ব, টানা সাত মৌসুম তারা ধরে রেখেছিল শিরোপা। পরে মন্টেপঁলিয়েরের উত্থানে শিরোপা জয়ে ছেদ পরে তাদের। ততদিন পর্যন্ত দৃশ্যপটে আগমন ঘটেনি পিএসজির।

মূলত ২০১১ সালে তামিম বিন হামাদের কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট দলটাকে কিনে নিলে বদলে যেতে শুরু করে লিগ ওয়ানের চেহারা। তারা দলে ভেড়ায় ইব্রাহিমোভিচ, কাভানি, লাভেজ্জি, থিয়াগো সিলভা, ভেরাত্তিদের মতো ফুটবলারদের। ব্যস আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, নিয়মিত লিগ জয়ের পাশাপাশি কয়েক মৌসুমের মাঝেই ইউরোপের বড় দলে পরিণত হয় তারা।

শুধু তাই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোতে যেসব ফুটবলার ভালো খেলতেন তাদের দলে টেনে একপ্রকার প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন করে তোলে। রেকর্ড অর্থে কিলিয়ান এমবাপ্পে, ওয়েসাম বেন ইয়েডার, হুয়ান বার্নাটদের দলে ভিড়িয়ে নিজেদের শিরোপা সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে চেয়েছে তারা। এমনকি ২০১৯ মৌসুমে তারা শিরোয়া জিতে নেয় ফেব্রুয়ারি মাসেই, ২০ পয়েন্টের ব্যবধানে।

কৃষক লিগ শব্দটা দর্শকেরা আরো একটা কারণে ব্যবহার করে থাকেন। সেটা হলো মাঝেমাঝেই ফরাসি লিগের তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলাররা প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলের আশায় পাড়ি জমান অন্য লিগগুলোতে। এডেন হ্যাজার্ড লিলে থেকে চেলসিতে যোগ দেন ২০১২ সালে। এনগোলো কান্তে এবং রিয়াদ মাহরেজ লেস্টার সিটিতে, অ্যান্থনি মার্শিয়াল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, ফ্যাবিনহো লিভারপুলে, বাড়ড়ণাডো সিলভা এবং বেঞ্জামিন মেন্ডি যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। এভাবে ফরাসি লিগ থেকে ফুটবলারদের প্রিমিয়ার লিগে যোগদান করা মনে করিয়ে দেয় ফুটবলের একটি বিখ্যাত টার্ম ‘ফিডার ক্লাব’।

‘ফিডার ক্লাব’ শব্দটি দ্বারা মূলত এমন ক্লাবদের বুঝানো হয় যারা নিজেরা তরুণ ফুটবলারদের সুযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে। কিন্তু একটা সময় পর উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে অন্য নির্দিষ্ট ক্লাবের কাছে বিক্রি করে দেয়। একটা সময় আর্সেনাল ছিল বার্সেলোনা এবং ম্যানচেস্টার সিটির জন্য ফিডার ক্লাব। লাল জার্সিতে ক্যারিয়ার শুরু করা থিয়েরি অঁরি, মার্ক ওভারমার্স, ইমানুয়েল পেতিত, সেস ফ্যাব্রেগাস, অ্যালেক্স সংরা পরে মাঠ মাতিয়েছেন কাতালানদের হয়ে। কিংবা কোলো তোরে, সামির নাসরি, আদেয়াবায়োর, বাখারি সাগনাদের ক্যারিয়ার উত্তর লন্ডনের ক্লাবে শুরু হলেও পরবর্তীতে যোগ দিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে।

এছাড়া বর্তমানে সাউদাম্পটনকে অনেকে লিভারপুলের ফিডার ক্লাব বলে থাকেন। ভার্জিল ভ্যান ডাইক, সাদিও মানে, নাথানিয়েল ক্লাইন, দেজান লভ্রেন, অ্যাডাম লালানাদের মতো ফুটবলারদের দলে ভিড়িয়েছে অলরেডরা সাউদাম্পটন থেকেই। ঠিক এমনিভাবেই দর্শকেরা ব্যঙ্গ করে পুরো লিগ ওয়ানের সব দলকে ডাকে প্রিমিয়ার লিগের ‘ফিডার ক্লাব’ হিসেবে।

লিগে নিয়মিত সাফল্য পেলে ইউরোপে বারবার ব্যর্থ হয়ে পিএসজি। সেরা সাফল্য বলতে একবার ফাইনাল খেলেছিল টমাস টুখেলের অধীনে। তবে এবার পুরো ইউরোপে রাজত্ব করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে পিএসজি। কৃষক লিগের দল এই তকমা থেকে বের হয়ে আসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পিএসজি এবং দলের কর্তারা। নেইমার, এমবাপ্পে, ইকার্ডি, ডি মারিয়ারা তো আগে থেকেই ছিলেন এবারের দলবদলে নতুন যোগ দিয়েছেন ডোনারুম্মা, সার্জিও রামোস, উইজনালডাম, লিওনেল মেসিরা। এখন দেখবার বিষয় মেসি-রামোসদের অন্তর্ভুক্তি তাদের কৃষক লিগের অপবাদ থেকে মুক্তি দিতে পারে কিনা।

– গোল.কমের ছায়া অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link