Social Media

Light
Dark

দুই নৌকায় পা দেওয়ার ফুটবলার

রিয়াল বার্সার দৈরত্বের কারণে সচরাচর এই দুই দলের মধ্যে সরাসরি দলবদল দেখা যায় না। লুইস ফিগোর বার্সেলোনা ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার পর যে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল তা কি সহজে ভলা যায়! তবে সরাসরি দলবদল না হলেও স্প্যানিশ এই দুই জায়ান্ট ক্লাবের জার্সি গায়ে তুলেছেন এমন সাহসী ফুটবলারের সংখ্যাটাও কম নয়। ফিগো, রোনালদো, ইতোর মত তারকা ফুটবলার সহ ৩০ এর বেশি খেলোয়াড়কে দেখা গেছে যারা এই দুই পরাশক্তির হয়েই খেলেছেন।

এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন হলেন তরুণ ফুটবলার ইকার ব্রাভো। বার্সার লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে আসা এই তরুণ সম্ভবনাময় ফুটবলার ২০২১-২২ মৌসুমে চুক্তির ব্যাপারে একমত হতে না পারায় বার্সেলোনা ছেড়ে ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে যোগ দেন জার্মান ক্লাব বায়ার্ন লেভারকুসেনে। স্প্যানিশ এই ফুটবলার কিছুদিন আগে লেভারকুসেন থেকে ধারে রিয়ালে যোগ দিয়েছেন।

ইকার ব্রাভোর মতই ব্লাগুরানা এবং লস ব্লাঙ্কোস উভয়েরই জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন এমন ১৫ ফুটবলার নিয়েই আমাদের আজকের আয়েজন।

  • লুইস ফিগো

তালিকায় সবার প্রথমে যার নাম আসবে তিনি হলেন পুর্তগালের কিংবদন্তি ফুটবলার লুইস ফিগো। ব্লাগুরানা সমর্থকদের নয়নের মণি ফিগো যখন ২০০০ সালে বার্সা ছেড়ে রিয়ালে যোগদান করেন তখন মুহূর্তের মধ্যে তিনি বার্সা সমর্থকদের চোখের বিষে পরিণত হন।

সেই সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে তাকে ধরা হত যার স্বীকৃতি সরূপ ২০০০ সালের ‘ব্যালন ডি আর’ জিতে নেন এই ফুটবলার। এই দলবদলের কারনেই রিয়ালের ক্লাব প্রেসিডেন্ট পদটি পান ফ্লোরেনটিনো পেরেজ। রিয়ালের প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী পেরেজ লস ব্লাঙ্কোস সমর্থকদেরকে আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি এই দলবদল সম্পন্ন করবেন আর তা পূরণ করার ফলেই তিনি ক্লাবের প্রেসিডেন্টে পদে নির্বাচিত হন।

রিয়ালে পাড়ি জমানোর পর ফিগো যখনই নু ক্যাম্পে ফিরে গেছেন তখনই বার্সা সমর্থকদের রোষানলে পরতে হয়েছে তাকে। ২০০২ সালের এক এল ক্লাসিকোতে ফিগো যখনই কর্নার নিতে যেতেন ব্লাগুরানা সমর্থকরা তখনই তার দিকে কিছু না কিছু ছুড়ে মারত। সেই সময়ে তার সতীর্থ মাইকেল সালগাডো এই সম্পর্কে বলেন ‘দ্বিতীয় বা তৃতীয় কর্নারের পর আমি লুইসকে বললাম দুঃখিত বন্ধু তোমাকে একাই কর্নার নিতে হবে এই ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। ফিগো সাধারণত শর্ট কর্নার নিলে বল রিসিভ করার জন্য টাচ লাইনের কাছে আমি থকতাম, কিন্ত বার্সা সমর্থকরা যেভাবে পয়সা, বোতল, ছুড়ি ইত্যাদি ছুড়ে মারতে লাগলো তাতে আমার পক্ষে সেখানে দাড়িয়ে থাকা আর সম্ভব ছিল না।’

ফিগো দুই ক্লাবের হয়ে প্রায় ২০০’র বেশি ম্যাচ খেলেছেন এবং দুই ক্লাবের হয়েই লিগ শিরোপা জয় করেছেন। এছাড়া ২০০২ সালে রিয়ালের হয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাও জেতেন।

  • রোনালদো

ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো দুই ক্লাবের হয়ে খেললেও ফিগোর মত কোন পরিস্থিতিতে তাকে পরতে হয়নি বরং দুই ক্লাবের সমর্থকরাই তাকে প্রাণ ভরে নিজেদের সমর্থন দিয়েছে।

স্যার ববি রবসনের হাত ধরে পিএসভি থেকে বার্সায় এসে মাত্র এক মৌসুম কাটিয়েই ইটালিয়ান পরাশক্তি ইন্টার মিলানে চলে যান তিনি, তবে এই এক মৌসুমেই নিজের জাত চেনান এই সুপারস্টার। ১৯৯৬-১৯৯৭ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৯ ম্যাচে ৪৭ গোল করেন ফেনমেনো, তবে মৌসুম শেষে চুক্তি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় নু ক্যাম্প থেকে তৎকালীন দলবদলের রেকর্ড ফি দিয়ে তাকে সান সিরোতে নিয়ে আসে ইন্টার মিলান। স্পেনে তিনি যে দুর্দান্ত ফুটবলের প্রদর্শনী দেখিয়েছিলেন তার নিদর্শনস্বরূপ সেই বছরের ব্যালন ডি আর জিতে নেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার।

২০০২ সালে তিনি আবার স্পেনে ফিরে আসেন, তবে এবার তার গায়ে ছিল রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি। পেরেজের গ্যালাক্টিকো প্রজেক্টের অংশ হিশেবে লস ব্লাঙ্কসদের হয়ে খেলতে এসে নিজের প্রথম মৌসুমেই লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি পাশাপাশি নিজের দ্বিতীয় ব্যালন ডি আরটিও জিতেন এই ব্রাজিলিয়ান স্টাইকার। তবে রিয়ালে থাকাকালিন সময় তিনি মাত্র একটি লিগ শিরোপার দেখা পান আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাটিও তার অধরাই থেকে যায়। মূলত এসময় থেকেই ইঞ্জুরি এবং স্বাস্থ্যগত কারণে তার খেলার ধারও দিন দিন কমতে থাকে।

  • মাইকেল লাউন্ড্রপ

স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চল থেকে উঠে আসা ফুটবলদের মধ্যে অন্যতম সেরা হিসেবেই গণ্য করা হয় এই ড্যানিস ফুটবলারকে। টানা চারটি লিগ শিরোপা জেতা ইয়োহান ক্রয়েফের বার্সা ড্রিম টিমের গুরুত্বপূর্ন সদস্য ছিলেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। ফুটবল মাঠে তার ভিশন এবং বদ্ধিমত্তার কারণে ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্লে মেকারদের এক জন হিসেবে তাকে ধরা হয়।

জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক বেকেনবাওার তার সম্পর্কে বলেন ‘১৯৬০’র দশকের সেরা খেলোয়াড় হল পেলে, ৭০’র দশকে ক্রয়েফ, ৮০’র দশকে ম্যারাডনা এবং ৯০’র দশকের সেরা ফুটবলার হল লাউন্ড্রপ।’

বার্সায় দুর্দান্ত পাঁচটি মৌসুম কাটানোর পর ক্লাবের ম্যানেজার ইয়োহান ক্রয়েফের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে নু ক্যাম্প ছেড়ে সরাসরি রিয়ালে পাড়ি জমান তিনি। পাঁচ মৌসুম ধরে লিগ শিরোপার খরা কাটনো রিয়াল মাদ্রিদের ভাগ্য বদলে দেন লাউন্ড্রপ, লস ব্লাঙ্কোসদের জার্সি চাপিয়ে নিজের প্রথম মৌসুমেই দলকে উপহার দেন কাউঙ্খিত লিগ শিরোপার।

বার্সা এবং মাদ্রিদ উভয় দলের হয়েই তিনি ৫-০ তে দুইটি এল ক্লাসিকো জেতেন। মাদ্রিদে দুই মৌসুম কাটানোর পর এই তারকা ফুটবলার জাপানের ক্লাব ভিসেল কোবেতে পাড়ি জমান।

  • লুইস এনরিকে

স্পেনের হয়ে ৫০টির বেশি ম্যাচ খেলা মিডফিল্ডার লুইস এনরিকে বার্সা ও রিয়াল উভয় দলের হয়েই ২০০’র বেশি ম্যাচ খেলেছেন। মাদ্রিদে ৫টি মৌসুম কাটিয়ে ৩টি শিরোপা জিতলেও ১৯৯৬ সালে তিনি ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে বার্সায় যোগ দেন। দল ত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে তাকে রিয়ালে ঠিকমত মূল্যায়ন করা হয়নি।

ব্লাগুরানা সমর্থকদের মন জয় করতে বেশ বেগ পেতে হয় এই ভারসেটাইল মিডফিল্ডারকে। তবে একবার তাদের হৃদয়ে জায়গা পাওয়ার পর আর পিছনে তাকাতে হয়নি এই স্প্যানিশ ফুটবলারকে। বার্সার অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরা এই খেলোয়াড় এল ক্লাসিকোতে নিজের সাবেক দলের বিপক্ষে বরাবরই গোল করেছেন।

খেলোয়াড় হিসেবে দুইটি লিগ শিরোপাসহ অগণিত ট্রফি জয়ের পর বার্সার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দেখা পান আরো দুইটি লিগ শিরোপার এর পাশাপাশি ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাও জিতেন। বর্তমানে তিনি স্পেইন জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

  • স্যামুয়েল ইতো

ক্যামেরুনের কাদজি স্পোর্টস একাডেমিতে খেলার সময় রিয়াল মাদ্রিদের স্কাউটদের নজরে পড়েন এই স্টাইকার। মাদ্রিদে থাকাকালীন সময়ে মূল দলে তিনি তেমন একটা সুযোগ পাননি। তিন দফায় তাকে ধারে অন্য ক্লাবে খেলতে পাঠানো হয়, মজার ব্যাপার রিয়ালের হয়ে তিনি ম্যাচও খেলেছিলেন তিনটি।

২০০০ সালে রিয়াল ছেড়ে লা লিগার দল মায়োর্কায় যোগ দেন তিনি। সেখানে চার মৌসুমের বেশি সময় খেলে ৫৪ গোল করেন এই ফুটবলার এরপর ২০০৪ সালে তিনি পাড়ি জমান বার্সেলোনায়।

বার্সায় যোগ দিয়ে প্রথম মৌসুমেই ২৯ গোল করার পর দ্বিতীয় মৌসুমে করেন ৩৪ গোল। ২০০৯ সালে ইন্টারে যাওয়ার আগে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ব্লাগুরানাদের হয়ে ১৩০ গোল করেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার। ইন্টার মিলানে মরিনহোর অধীনে খেলে ট্রেবল জিতেন তিনি।

  • বার্ন্ড সুস্টার

জার্মান এই ফুটবলার শুধু বার্সা থেকে রিয়ালে সারাসরি পাড়িই জমাননি বরং এরপর রিয়াল থেকে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে পাড়ি জমিয়ে ব্যাপারটাকে আরো এক ধাপ উপরে নিয়ে গেছেন। ‘দা ব্লন্ড এঞ্জেল’ নামে পরিচিত এই মিডফিল্ডারকে ১৯৮০ সালে জার্মান ক্লাব কোলোন থেকে নিজেদের দলে ভেড়ায় বার্সা।

২০ বছর বয়সে নু ক্যাম্পে এসে তিনি আটটি মৌসুম কাটান এই কাতালান ক্লাবটিতে, এই ৮ মৌসুমের ৭ টি তেই কমপক্ষে ১০ টি করে গোল আছে তার। ১৯৮৮ সালে রিয়ালে যোগ দিয়ে পর পর দুই বছরে দুইটি লিগ শিরোপার দেখা পান এরপর ১৯৯০-৯১ মৌসুমে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে গিয়ে নিজের ঝুলিতে ভড়েন দুইটি কোপা দেল রের শিরোপা।

স্পেনে ১২ বছর কাটানোর পর ১৯৯৩ সালে নিজ দেশ জার্মানির ক্লাব বায়ার্ন লেভারকুসেনে যোগ দেন এই ফুটবলার।

  • গোরগে হাজি

রোমানিয়ার এই কিংবদন্তি ফুটবলার বার্সা এবং রিয়াল দুই ক্লাবেই দুই মৌসুম করে কাটান। ‘কারপাথিয়ান্সের ম্যারাডোনা’ নামে পরিচিত এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অবশ্য দুই দলের কোনটির হয়েই লিগ শিরোপার দেখা পাননি।

১৯৯০’র বিশ্বকাপে রোমানিয়া জাতীয় দলের হয়ে ভাল খেলার সুবাদে রিয়ালের রাডারে আসেন তিনি, লস ব্লাঙ্কোসদের জার্সি গায়ে দেখিয়েছেন দৃষ্টি নন্দন ড্রিবলিং। রিয়ালের হয়ে ফুটবল মাঠে জন্ম দিয়েছেন দুর্দান্ত সব মুহূর্তের তবে এই মুহূর্তগুলো আসতো কালে ভদ্রে নিয়মিত একই লেভেলে পারফর্ম করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। দুই বছরে মাত্র একটি সুপার কাপ ছাড়া আর কিছুই জিততে না পেরে ১৯৯২ সালে পাড়ি জমান ইটালিয়ান ক্লাব ব্রেসিয়ায়। ইতালিতে নিজের প্রথম মৌসুমেই দলের অমনমন দেখতে হয় তাকে তবে দ্বিতীয় মৌসুমে সিরি বি থেকে দলকে আবারো সিরি আ তে নিয়ে আসতে সাহায্য করেন হাজি, আর এরপর আবার স্পেনে পাড়ি জমান তবে গায়ে এবার কাতালান ক্লাব বার্সার জার্সি।

ক্রয়েফের বার্সায় মূল একাদশে কখনোই নিয়মিত ছিলেন না এই রোমানিয়ান ফুটবলার। ব্লাগুরানাদের হয়ে আর একটি সুপার কাপ জিতে ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ক্লাব গ্যালাতাসারেইতে যোগ দেন। তুরস্কের এই ক্লাবটিতে নিজেকে নতুন করে খুজে পান তিনি আর হয়ে উঠেন ক্লাবটির কিংবদন্তি খেলোয়াড়।

  • আলফ্রেডো ডি স্টেফানো

আসলে বার্সার হয়ে কখনো একটিও অফিসিয়াল ম্যাচ খেলেননি এই কিংবদন্তি ফুটবলার তবে কাতালান ক্লাবটিতেও খেলার কথা ছিল তার, তাকে হাতছাড়া করার এই আক্ষেপ বার্সাকে আজো পোড়ায়।

১৯৫৩ সালে ডি স্টেফানো যখন কলম্বিয়ান ক্লাব মিলোনারিয়োস ছাড়ার সিধান্ত নেন তখন রিয়াল বার্সা দুই ক্লাবই তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। দুই দলই একসময় দাবি করে যে তারা এই স্টাইকারকে দলে ভিড়িয়েছে ফলে এই খেলোয়াড়কে নিয়ে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয় এই দুই পরাশক্তিকে। লম্বা আইনি লড়াইয়ের পর স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন এই সিধান্ত নেয় যে ডি স্টেফানো এক মৌসুম রিয়াল তো পরের মৌসুম বার্সায় খেলবেন এবং তার বর্তমান চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া বহাল থাকবে।

বার্সার হয়ে তিনি বেশকিছু প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন এমনকি ব্লাগুরানাদের সাথে অনুশীলনেও অংশ নেন তবে ফেডারেশনের সিধান্ত অনুযায়ী প্রথমে রিয়াল তাকে খেলানোর সুযোগ পায়। মৌসুমের প্রথম কিছু ম্যাচে খুব একটা ভাল খেলতে পারেননি ডি স্টেফানো ফলে বার্সা তাদের চুক্তির অংশ রিয়ালের কাছে বিক্রি করে দিতে রাজি হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল এর ঠিক চার দিন পর ‘দা ব্লন্ড অ্যারো’ নামে পরিচিত এই ফুটবলার হ্যাট্রিক করে বসেন।

রিয়ালের হয়ে ৩৯৬ ম্যাচে ৩০৮ গোলের পাশাপাশি আটটি লিগ শিরোপা এবং পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেন তিনি। ডি স্টেফানো আসার আগে কখনো লিগ শিরোপার দেখা না পাওয়া রিয়াল মাদ্রিদ তার আসার পর জিততে থাকে একের পর শিরোপা। ১৯৬৪ সালে মাদ্রিদ ছেড়ে তিনি যখন কাতালান ক্লাব এস্পানিয়োলে যোগ দেন তখন ফুটবল মানচিত্রে রিয়াল মাদ্রিদ এক বিশাল নাম আর এর পিছনে যেই মানুষটির সবচেয়ে বড় অবদান তিনি হলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।

  • হাভিয়ের স্যাভিওলা

২০০১ সালে আর্জেন্টিনার ক্লাব রিভার প্লেট থেকে বেশ নাম ডাক নিয়েই বার্সায় এসেছিলেন এই স্টাইকার। তিন মৌসুম ধরে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে করেছেন একের পর গোল কিন্ত এরপরই তার পারফর্মেন্স নিম্নগামী হতে থাকলে ক্লাবটিতে ব্রাত হয়ে পরেন তিনি। মোনাকো এবং সেভিয়ায় ধারে খেলার পর আবার বার্সায় ফিরে আসেন তিনি তবে এবার এক মৌসুম কাটানোর পর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তার।

এরপর ২০০৭ সালে ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে তিনি রিয়ালে যোগ দেন, তবে এখানে তার সময়টা খুব একটা ভাল কাটেনি। লস ব্লাঙ্কোসদের মুল একাদশে কখনোই নিয়মিত হতে পারেননি স্যাভিওলা, ২০০৯ সালে রিয়াল যখন আয়াক্স থেকে ডাচ স্টাইকার ক্লাস ইয়ান হান্টেলারকে দলে ভেরায় তখন একাদশে জায়গা পাওয়া তার জন্য আরো কঠিন হয়ে যায়।

সেই বছরই পুর্তগিজ ক্লাব বেনফিকায় পাড়ি জমান তিনি এরপর মালাগার হয়ে খেলার জন্য আরেকবার স্পেনে ফিরে আসেন তবে এক মৌসুম পরেই গ্রীক ক্লাব অলিম্পিয়াকসে চলে যান। গ্রীস থেকে ইটালিয়ান ক্লাব ভেরোনা হয়ে আবার নিজ দেশ আর্জেন্টিনার ক্লাব রিভার প্লেটে ফিরে যান এই স্টাইকার যেখানে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত খেলেন তিনি।

  • জোসেপ সামিটিয়ের

১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩২ সাল অবধি বার্সেলোনার জার্সি গায়ে খেলেন কাতালুনিয়ায় জন্ম নেয়া এই স্প্যানিশ ফুটবলার। এরপরের দুই বছর তিনি রিয়াল মাদ্রিদে কাটান, পরবর্তীতে ম্যানেজার হিসেবে তিনি বার্সা এবং অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে দায়িত্ব পালন করেন।

সম্প্রতি লুইস সুয়ারেজের কল্যাণে বার্সার সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় পঞ্চম স্থানে নেমে যাওয়া এই ফুটবলার ব্লাগুরানাদের হয়ে মোট ১৮৪টি গোল করেন। মিডফিল্ডার থেকে স্টাইকারে পরিণত হওয়া এই ফুটবলারকে লোকে ‘দা গ্রাসহপার ম্যান’ ডাকত তার খেলার ধরনের কারণে, এছাড়াও ‘দা সাররিয়ালিস্টিক’ নামেও তাকে ডাকা হতো কারণ তিনি বিখ্যাত চিত্র শিল্পী সালভাদোর দালির সাথে সময় কাটতেন বলে, স্প্যানিশ এই শিল্পীর খুব কাছের বন্ধু ছিলেন সামিটিয়ের। সেই সময়ের বিখ্যাত গায়ক কার্লোস গার্দেল এই ফুটবলারকে উৎসর্গ করে একটি গানও গেয়েছিলেন।

১৯২০ সালে তাকে ঘিরে বার্সা যেই দল গঠন করে তাদের খেলা দেখার জন্য এতো পরিমাণে দর্শক সমাগম হত যে মাঠে তাদের সবাইকে জায়গা দেওয়া যেত না। এই কারনেই ১৯২২ সালে কাতালান ক্লাবটি ক্যাম্প দে লেস কোর্টস নামে নতুন একটি স্টেডিয়াম তৈরি করে।

ব্লাগুরানারা সামিটিয়েরকে কিংবদন্তি হিসেবে আজো মনে করে তবে তিনি ক্লাবে থাকাকালিন সময় বেশকিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। বার্সার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় ক্লাবটির আরেক কিংবদন্তি লাজলো কুবালাকে তিনি দলে ভেড়ান তবে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর দলবদলের ব্যাপারে তার অবস্থান অনেকের কাছে সন্দেহজক লেগেছে। অনেকেই মনে করেন যে এই দলবদল করার সময় তিনি মাদ্রিদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন আর তাই ডি স্টেফানোর মত দুর্দান্ত এক ফুটবলারকে পাওয়ার থেকে বার্সা বঞ্ছিত হয়েছে।

১৯৬০ সালে মাদ্রিদে কাজ করার জন্য তিনি বার্সা ত্যাগ করলেও ক্লাবের সকলের কাছেই তিনি একজন কিংবদন্তি হিসেবে গণ্য হন। ১৯৭২ সালে তিনি মারা গেলে কাতালুনিয়া রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৯৯৩ সালে ক্যাম্প নুতে আসার পথে পড়ে এমন একটি রাস্তার নামকরণ তার নামে করা হয়।

  • হুলেন লপেতেগি

স্প্যানিশ এই গোলরক্ষক বার্সা এবং রিয়াল উভয় দলেই তিন বছর করে সময় কাটান। এসময় মূলত ব্যাকআপ গোলরক্ষক হিসেবে খেলা এই ফুটবলার দুই ক্লাব মিলিয়ে মোট ছয়টি ম্যাচ খেলেন।

মাদ্রিদের বি টিমে নিয়মিত খেলা এই গোলরক্ষক তার কারিয়ারে মূল গোলরক্ষক হিসেবে বেশি ম্যাচ খেলেছেন লংরোনেস এবং রায়ো ভাল্কানোর হয়ে খেলার সময়, রিয়াল এবং বার্সা ছাড়ার পর এই দুই ক্লাবে যোগ দেন তিনি।

স্পেন জাতীয় দলের হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলা লপেতিগে একসময় ম্যানেজার হিসেবে জাতীয় দলের দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর্দা উঠার কিছুদিন আগেই অবশ্য তাকে বরখাস্ত করা হয় কারণ টুর্নামেন্ট শেষে তিনি রিয়ালের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রাজি হয়েছিলেন যা স্প্যানিশ ফেডারেশন মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। তাদের যুক্তি ছিল এমন কোচকে তারা রাখতে চাননা যার দলের উপর পূর্ণ মনোযোগ নেই। রিয়ালে ডাগ আউটেও খুব বেশিদিন টিকতে পারেননি লপেতিগে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের পারফর্মেন্স দিন দিন খারাপ হতে থাকে, যার মধ্যে এল ক্লাসিকোতে বার্সার কাছে ৫-১ গোলের বিশাল হারও রয়েছে তাই নিয়োগের মাত্র চার মাস পরেই তাকে ছাটাই করে ফেলে ক্লাবটি।

  • আলবার্ট সেলাদেস

কাতালুনিয়ায় জন্ম নেওয়া এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ৯০’র দশকে বার্সার একাডেমি থেকে উঠে আসেন। লুই ভ্যান গালের ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমের লিগ শিরোপাজয়ী বার্সেলোনা দলে মূলত সুইপার ডিফেন্ডার হিসেবে খেলেন তিনি। চার বছর বার্সায় কাটালেও কখনোই দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি এই স্পানিয়ার্ড তবে তার শিরোপাভাগ্য বেশ ভাল ছিল বলতেই হবে। দুইটি লিগ টাইটেল, দুইটি কোপা দেল রে, একটি উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ এবং একটি উয়েফা সুপার কাপ জেতা এই ফুটবলার ১৯৯৯ সালের এল ক্লাসিকোর ম্যাচ নির্ধারণী গোলটি করে বার্সাকে জিতিয়ে দেন।

২০০০ সালে তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন, এখানে তিনি আরো দুইটি লিগ শিরোপার পাশাপাশি একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন।

লপেতিগে যখন রিয়ালের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন সেখানে তার সহকারী হিসেবে যোগ দেন সেলাদেস, তবে লপেতিগেকে বরখাস্ত করা হলে তাকেও ক্লাব ত্যাগ করতে হয়। ২০১৯ সালে ভ্যালেন্সিয়ার ম্যানেজার হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও মৌসুমের শেষ হবার আগেই পদ হারান তিনি।

  • রবার্ট প্রসিনেকি

ক্যারিয়ারজুড়ে এক ডজনের বেশি ক্লাবে খেলা এই জার্নিম্যান ফুটবলার রিয়াল বার্সা দুই দলের হয়েই খেলেছেন। ১৯৯১ সালে রিয়াল মাদ্রিদে যোগদানের পর প্রথম মৌসুমের পুরোটাই ইঞ্জুরির কারণে ভেস্তে যায়। এই সময় ক্রয়েশিয়ান এই মিডফিল্ডার মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলেন, এর একটি ম্যাচ ছিল বার্সার বিপক্ষে যেখানে ফ্রি কিক থেকে তিনি এক দুর্দান্ত গোল করেন।

পরবর্তী দুই মৌসুমে তিনি দলের নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেন এবং বেশ কিছু শিরোপাও জেতেন, এরপর ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে তাকে ধারে খেলার জন্য রিয়াল ওভিয়েদোতে পাঠানো হয় যেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে বার্সেলোনায় যোগ দেন।

১৯৯৫ সালে বার্সায় যোগ দিলেও ইঞ্জুরির কারণে তিনি মূল একাদশে জায়গা করে নিতে পারেননি তাই নু ক্যাম্পে মাত্র এক মৌসুম কাটিয়ে তিনি চলে যান স্পেনের আরেক ক্লাব সেভিয়ায়।

  • মিকুয়েল সোলার

স্প্যানিশ এই ফুটবলার মিডফিল্ড এবং লেফটব্যাক দুই পজিশনেই খেলেছেন। সোলার শুধু রিয়াল বার্সায় খেলেই ক্ষান্ত হননি বরং দুই ক্লাবের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ এবং এস্পানিওলেও খেলার সাহস দেখিয়েছেন।

১৯৮৩ সালে কাতালান ক্লাব এস্পানিওলেই এই ফুটবলারের ক্যারিয়ার শুরু হয়। এখান থেকে ১৯৮৮ সালে তিনি নগর প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সায় পাড়ি জমান, ব্লাগুরানাদের হয়ে তিনটি দারুণ মৌসুম কাটান এই স্প্যানিয়ার্ড। ১৯৯১-৯২ মৌসুমটা অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে কাটিয়ে আবার বার্সায় ফেরেন তিনি তবে এবার মূল একাদশে জায়গা পেতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে তাই মৌসুম শেষে সেভিয়ায় যোগ দেন তিনি যেখানে নিজেকে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

সেভিয়ায় ভাল খেলার সুবাদে রিয়াল মাদ্রিদের নজর কাড়েন তিনি এবং ১৯৯৫ সালে লস ব্লাঙ্কসদের জার্সি গায়ে তোলেন। তবে রিয়ালে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি এই ফুটবলার, মাত্র ১৪টি ম্যাচ খেলে এক মৌসুম শেষেই মাদ্রিদ থেকে বিদায় নেন সোলার। ক্যারিয়ারের শেষ সময়টা রিয়াল জারাগোসা এবং মায়োর্কায় কাটিয়ে কোচিং ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করেন এই স্প্যানিয়ার্ড।

এই ১৫ ফুটবলার ছাড়াও আরো অনেক ফুটবলারই বার্সা রিয়াল এই দুই নৌকায় পা দিয়েছে। ১৮৮৬ সালে আলফন্সো আলবেনিজের মাধ্যমেই এর যাত্রা শুরু হয়। দুই ক্লাবের হয়েই শিরোপা জেতা এই ফুটবলার এক সময় রিয়ালের ক্লাব ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তাকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া লিগ অফ নেসন্সে স্পেনের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা গেছে।

আলবেনিজ থেকে শুরু হয়ে হাল আমলের ইকার ব্রাভো এখানেই কি এই জার্সি বদলের গল্পের শেষ? মোটেই না বরং সামনে হয়তো আমরা আরো কোন রোমাঞ্চকর গল্পের দেখা পাব তাই আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link