কেন জার্মানি সব সময় জিতে!

সাফল্য, ঐতিহ্য কিংবা নান্দনিকতা – যে দিক দিয়েই আপনি ফুটবলের সবচেয়ে সেরা দলগুলোর কথা ভাববেন, জার্মানির নাম ভাবনাতে আসবেই। শিরোপা জয় অথবা শৈলী ফুটবল সবকিছু দিয়েই বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের মুগ্ধ করে রেখেছে ডাই ম্যানসক্রাফটরা। জার্ড মুলার, মিরোস্লাভ ক্লোসা, ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মত কিংবদন্তিদের উঠে আসা এই জার্মানি থেকেই।

সর্বোপরি জার্মানির জাতীয় পুরুষ দলের ক্যাবিনেটে চারটি বিশ্বকাপ ট্রফি রয়েছে। এর পাশাপাশি আছে তিনটি ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। এছাড়া নারী দল দুটি বিশ্বকাপ, আটটি ইউরোপীয় শিরোপা এবং একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছে।

সাফল্য সেখানেই থেমে যায়নি, জার্মানির যুব দলগুলো ৩০টি মেজর ট্রফি জিতেছে। প্রতিটি জার্মান দল শিরোপার অন্যতম দাবিদার হয়েই যেকোনো টুর্নামেন্টে যায়। এমনকি যদি তাঁরা তাদের সম্পূর্ণ সেরা ফর্মে নাও থাকে তবু তাদের ট্রফি জয়ের সম্ভাবনা অন্য অনেক দলের চেয়ে বেশি।

প্রশ্ন ওঠাটা তাই স্বাভাবিক, কিভাবে এমন ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব? জার্মানির সফলতার নেপথ্যে কি আছে? মূলত নিজেদের শক্তিশালী ফুটবল অবকাঠামোর কারণেই তর তর করে এগিয়ে যেতে পারছে ইউরোপীয় জায়ান্টরা।

২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হওয়ার পরেই জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফবি) তাদের দেশে প্রতিভা বিকাশ কর্মসূচি চালু করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণ খেলোয়াড়দের দক্ষতার বিকাশের জন্য সারা দেশে প্রায় ৪০০টি ক্যাম্প স্থাপন করে ডিএফবি।

গত দুই দশক ধরে এই প্রোগ্রামটিকে ক্রমাগত উন্নত করা হয়েছে, আধুনিক ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিভা সনাক্তকরণ এবং লালন-পালন করার জন্য একাডেমি, অপেশাদার ক্লাব এবং ফেডারেশন কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো একসাথে যেভাবে কাজ করে, তাতে তাদের সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা ফুঁটে ওঠে।  

১০ বছর আগেও ‘ডাই ম্যানশাফট’-দের নারী ফুটবল দল আজকের মতো পরাশক্তির জায়গায় ছিল না। তারপরও তাদের জন্য অনেক মানসম্মত কোচিং স্টাফ রাখা হয়েছিল। সেখানে প্রশিক্ষক ছাড়াও একাধিক ফিজিও, একজন পূর্ণকালীন ডাক্তার, ভিডিও বিশ্লেষক এবং আরও অনেক কর্মী ছিল।

এত বছর ধরে সাফল্যের কোন সহজ পথ না খুঁজে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ধরে এগিয়েছে জার্মানি। এমন উদ্যোগ নেয়ার ফলেই দলটি সব স্তরের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে সাফল্যের হার অনেক উঁচুতে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

অন্য অনেক দেশও জার্মানির এসব পরিকল্পনা অনুসরণ করছে এবং তাদের প্রেক্ষাপটে সাফল্য অর্জন করছে। অবশ্য জার্মানির চেয়ে ভাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে এমন দেশও আছে ফুটবল বিশ্বে। আর তাই নিজেদের ফুটবল কাঠামো আরো একবার ঢেলে সাজাতে উন্মুখ হয়ে আছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। তারা তাদের অ্যাকাডেমিগুলোকে নতুন স্তরে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক।

শুধু মাঠের বাইরের এসব আধুনিক সুবিধা নয়, মাঠের ভিতরে খেলোয়াড়দের মানসিকতাও জার্মানির সাফল্যের অন্যতম কারন। জার্মান ফুটবলারদের জয়ের যে ক্ষুধা, জিততে চাওয়ার মনোভাব – এমনটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুরূহ। তাদের দলগুলি সর্বদা অবিশ্বাস্য টিম স্পিরিট দ্বারা পরিচালিত। ব্যক্তি সাফল্যের চেয়ে দলগত সাফল্যের দিকেই বেশি নজর দিয়ে থাকেন জার্মান ফুটবলাররা।

সবমিলিয়ে, যখন জার্মানির কথা ভাবা হয় তখন সেই বিজয়ী মানসিকতার মত অনন্য এক বৈশিষ্ট্যর কথা মনে পড়ে। এই মানসিকতাই দেশটির বিভিন্ন স্তরের দলকে বিজয়ী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রাখে।

জার্মানি পরাজয় নিতে পারে, তারা জয়ের নেশায় মরিয়া। এমনকি এক ম্যাচ জেতার পরে উদযাপনের চেয়ে পরবর্তী ম্যাচের দিকেই বেশি মনোযোগ থাকে তাদের। এক দুইটি ম্যাচ জয়ের পর নয়, ডাই ম্যানসক্রাফটরা শুধুমাত্র শিরোপা মঞ্চেই উদযাপন করতে পারে।

এছাড়া কঠিন নিয়মনীতি অনুসরণ করে দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করা জার্মান ফুটবলারদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তারা সবসময় সময়ানুবর্তী। এছাড়া দলের সাথে থাকার সময় মেনে চলতে হয় বেশকিছু রীতি। তারা একই পোশাক এবং জুতা পরে।

এমনকি কারো পায়ে ভিন্ন জুতা থাকলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। যে কারো কাছে এমনটা বেশি বেশি মনে হতে পারে কিন্তু একজন জার্মান এসবকে সাফল্যের একটি অংশ হিসেবেই মনে করে।

সর্বোপরি বলা যায়, জয়ের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা, শিরোপা জয়ের প্রতি বাসনা, উন্নত ফুটবল কাঠামো এবং খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা মেনে চলাই জার্মানির ভুরি ভুরি সাফল্যের পিছনের কারন। এই পথে যতদিন হাঁটতে পারবে তারা, ততদিনই অর্জনের খাতায় যোগ হবে কত শত শিরোপা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link