মেসির বার্সা-বিচ্ছেদ: কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

লিওনেল মেসি বার্সেলোনা ছেড়েছেন, খবরটা দুইদিন আগেও যতটা বিশ্বাস্য লাগছিলো, এখন তা সকলের কাছে সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। যদিও মাসখানেক ধরেই মেসি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিতে নেই, তবুও কেউ তাও বার্সেলোনার জার্সি বাদে অন্য জার্সিতে দেখতে পারেননি।

কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাই সত্যি হয়ে ধরা দিলো দিন দুই আগে। লিওনেল মেসির বার্সা-বিচ্ছেদের কোনো কানাঘুষাও ছিল না মিডিয়াতে। সেখান থেকে এক ঘন্টার মধ্যে বার্সেলোনা থেকেই খবর এলো, ‘বিদায় লিওনেল মেসি’। গতকাল প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা এসে অনেককিছুই বলেছেন, কিন্তু তাতে প্রশ্নের ফুলঝুড়ি থামছে না। লিওনেল মেসির বার্সা ছাড়ার পেছনে ন্য কোনো কারবার লুকিয়ে নেই তো?

লিওনেল মেসির সাথে বার্সেলোনা বোর্ডের ঝামেলা আজ থেকে নয়। বেশ কয়েকবছর ধরেই জোসেপ বার্তামেউ বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্ব তার। সেই দ্বন্দ্ব চরমে পৌছেছিল গত মৌসুমের শুরুতে। এক সাক্ষাৎকারে মেসি সরাসরিই বলেছিলেন, এই বোর্ডের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তখন থকেই মেসির বার্সেলোনা ছাড়া মনে হয়েছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু তখনই মেসির পালে হাওয়া দিতে আসেন হুয়ান লাপোর্তা। বার্সেলোনায় আগেও এক মেয়াদে প্রেসিডেন্সি করে গিয়েছেন তিনি। আর তিনি আসতেই যেন মত পাল্টে যায় মেসির। পালটানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বার্তামেউ বোর্ড যেভাবে বার্সেলোনাকে পরিচালনা করছিল তাতে তা ধ্বংসের মুখে পতিত হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লাপোর্তা বোর্ড এসে সেই সমস্যারই মুখোমুখি হলেন। লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনার ফেইস বানিয়ে এতোদিন যে মনোপলিটা চালিয়েছিল বার্তামেউ বোর্ড, বার্তামেউ জায়গা ছেড়ে দিতেই সেই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠল। সেই সাথে যোগ হয়েছিল করোনা মহামারী। বার্সেলোনার স্টেডিয়াম ট্যুর থেকে য্ব বিশাল পরিমাণ অর্থ উঠে আসতো সেটাও বন্ধ।

ফলে সেখান থেকেই শুরু হয় সমস্যা। আগের মৌসুমগুলোতে খেলোয়াড়দের বিশাল বেতন মিটিয়েও লাভের মুখ দেখতো বার্সেলোনা। তাই উচ্চদামে, উচ্চ বেতনে খেলোয়াড় আনতেও কোনো সমস্যা হতো না। যেটা করে গিয়েছেন বার্তামেউ। কিন্তু একবার লসের মুখে পরলে কী হবে সেটা আর ভেবে দেখেননি।

ফলে যা হবার তাই হয়েছে। লা লিগার বেতন কাঠামো নির্ভর করে আগের মৌসুমে কী পরিমাণ লাভ হয়েছে তার উপরে। প্রথম মৌসুমেই বিশাল পরিমা দেনা জমে গিয়েছিল বার্সেলোনার উপরে। কিন্তু সেবার কেউই তেমন কিছু বলেনি, মহামারী তো আর বলে-কয়ে আসে না। তাই তাদের সামনে সুযোগ ছিল কোনোভাবে নিজেদের সামলে নেওয়ার। কিন্তু সে সামলে নিয়েই আর পারেননি লাপোর্তা।

দ্য অ্যাথলেটিকের মতে, ২০১৯-২০ মৌসুমে খেলোয়াড়দের বেতনবাবদ ব্লাউগ্রানা দলটির খরচ হতেছে মোট ৬৭১ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু টানা দুই মৌসুম লসের মুখ দেখায় সেটি কমিয়ে আনতে হবে ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে। এখানেই বেঁধেছে বিপত্তি।

আগে বিশাল বিশাল বেতন দিতে অন্য দলকে পেছনে ফেলে যেসব খেলোয়াড় ভিড়িয়েছে বার্সেলোনা, তারাই এখন বার্সার বোঝা। স্যামুয়েল উমতিতির মতন খেলোয়াড় পান ১২ মিলিয়ন, পিয়ানিচ পান ৯ মিলিয়নের কাছাকাছি। এগুলোই দিনশেষে মরার উপর ঘরার ঘা হয়ে উঠেছে বার্সেলোনার জন্য। যে কারণে ভবেতনের অনেকটা অংশ কেটেও এখন আর মেসিকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তাদের।

তবে এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার বিশাল এক বুদ্ধি লা লিগা নিজেই বাতলে দিয়েছিল বার্সেলোনাকে। সেটা হলো একটা নতুন চুক্তিতে সাহায্য করা। তাতে বার্সারও লাভ, লা লিগারও লাভ। রোনালদো যাওয়ার পর থেকেই লা লিগার মান নামতে শুরু করেছে। এমনকি এশিয়াতে গত তিনবছর খেলা দেখানোর রাইটসও পায়নি তারা। বরং খেলা দেখতে হয়েছে ফেসবুকে।

সে জন্য লা লিগা কর্তৃপক্ষ সিভিসি ইনভেস্টমেন্ট নামকে একটি ফার্মের সাথে নতুন চুক্তিতে আবব্ধ হবে। যাতে করে লা লিগার বিভিন্ন রাইটসের ১০% চলে যাবে তাদের হাতে। সেই চুক্তি অনুসারে তারা এখনই ২.৭ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করবে। নিজেদের টিভি-স্বত্বের ওপর ভিত্তি করে টাকা পাবে তারা। সেই অর্থ এখনই পেলে মেসিকে কেন, পুরো দলের সব খেলোয়াড়কে রাখতেও কোনো বিপত্তি পোহাতে হতো না বার্সেলোনার।

কিন্তু সমস্যার শুরু আরেকটি শর্তে। এই ডিলে রাজি হলে আগামী ৫০ বছরের জন্য প্রতিটি ক্লাবের লাভের ১০% চলে যেত সিভিসির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। অথচ, ক্লাবগুলোর জন্য আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস টিভি ও অডিও রাইটস। হিসাব অনুযায়ী এই ৫০ বছরে এ বাবদ প্রতি ক্লাব থেকে ১-২ বিলিয়ন হাতিয়ে নেবে সিভিসি ইনভেস্টমেন্ট।

এমনকি সেটা লিগ থেকে রেলিগেটেড হওয়া ক্লাবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আগামী ৫০ বছরে যদি আবারও কোনো অর্থনৈতিক বিপত্তি আসে, তাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র সাহায্য করবে না তারা। দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির ফলে লা লিগার সকল ব্যবসাতে ১০% মালিকানা পাবে সিভিসি৷ অর্থাৎ ৫০ বছরের জন্য ক্লাবগুলোর লাভের গুঁড় খাবে তারা।

এটাই ছিল দিনশেষে লা লিগা প্রেসিডেন্ট তেবাসের বাজি। এই চুক্তিতে রাজি হলে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের বিশাল ইউরোপিয়ান সুপার লিগের স্বপ্ন নিমিষেই উড়ে যেত। হুয়ান লাপোর্তা নিজের অধীনে চলে এলে এই প্রজেক্ট এক প্রকার বন্ধই বলা চলে। বলতে গেলে লাপোর্তাকে তেবাস সরাসরিই বলেছিলেন, হয় মেসি নয়তো সুপার লিগ, কোনটা বেছে নিবে তুমি? লাপোর্তা দ্বিতীয়টাই বেছে নিয়েছেন।

দিনশেষে হুয়ান লাপোর্তা কষ্টভড়া বুকে বিদায় বলেছেন লিওনেল মেসিকে। তবে তাই বলে বার্সেলোনার স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে বলা চলে না। ক্ষীন হয়ে টিপটিপ করে এখনও জ্বলছে তাদের আশা। কী সেই আশার বানী? স্পন্সর আর টিভি রাইটস!

ঠিক যেটা নিয়েই সিভিসি কথা তুলেছিল বার্সেলোনার সাথে, ঠিক সেটা নিয়েই সমস্যা শুরু হবে লা লিগা আর স্পন্সরদের মধ্যে। ৪-৫ মৌসুম আগেও লা লিগা ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। একপাশে মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ আরেকদিকে বেল-বেনজেমা-ক্রিশ্চিয়ানো। প্ররতিথিবীর সবার আগ্রহ ছিল এক টিভির সামনেই। সেই জৌলুশ অনেকখানি হারিয়েছে রোনালদো যাওয়ার পরপর। মেসিও স্পেন ছাড়লে সে জৌলুশ আর থাকবে? লাপোর্তার চালটা ঠিক ওখানেই।

মেসি অফিসিয়ালি ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাওয়ার পরেও সবাই আশাবাদী ছিলেন, মেসি থাকবেই। কিন্তু অফিসিয়ালি জানিয়ে দেওয়ার পর তা আর রইছে না। ফলে লা লিগা থেকে আস্তে আস্তে মুখফিরিয়ে নিবে স্পন্সররা। ইতোমধ্যে টিভি রাইটস ডিল নিয়ে লা লিগার সাথে মিটিংয়ে বসার চিন্তাভাবনা করছে অনেকেই। ফলে নিজেদের উপরেও একটা চাপ চলে এসেছে।

আর সেই চাপেই লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাস ছাড় দিতে পারেন লা লিগাকে। আর মেসি যেহেতু এখনও ফ্রি এজেন্ট, সেহেতু তাকে আবার নতুন করে সাক্ষর করাতে কোনো বাধাও নেই বার্সেলোনার।

তবে সবটাই নির্ভর করছে মেসির অন্য দলে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত সে রেইসে এগিয়ে আছে পিএসজিই। মিরাকল কী ঘটবে? নাকি নতুন দলে যোগ নিয়ে নতুন অ্যাডভেঞ্চার শুরু করবেন লিওনেল। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন সেটাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link