রেটিং-র‌্যাংকিংয়ের বিচিত্র দুনিয়া

রেটিং বা রেটিং পয়েন্ট ব্যাটসম্যান, বোলার , অলরাউন্ডার বা কোন দলকে দেওয়া হয় ম্যাচের সময়। এই রেটিং পয়েন্ট তৈরির গণনা পদ্ধতি একটু জটিল। আর এই কোন একটা সময় পরে সব খেলোয়াড়েরা যে রেটিং পয়েন্ট পেল সেটার উর্ধ্বক্রম বা অধঃক্রম অনুসারে বানানো হয় র‍্যাংকিং।

মুত্তিয়া মুরালিধরণের বোলিং অ্যাকশন কিংবা সাকলাইন মুস্তাকের দুসরার চাইতেও ক্রিকেটে যদি রহস্যময় আর জটিল কিছু থেকে থাকে, সেটা আইসিসির র‍্যাংকিং পদ্ধতি।

অনেকেই আছেন প্রতিবার আইসিসি তাঁদের র‍্যাংকিং হালনাগাদ করার পর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আর প্রশ্ন করেন-এটা কিভাবে হল? সেই প্রশ্ন থেকেই অনেকেরই মাথা খারাপের মত অবস্থা হয়ে যায়। আজকে বরং সেই খেলোয়াড়দের র‍্যাংকিং ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।

প্রথমেই আসি, আইসিসির র‍্যাংকিং সিস্টেম কী?

আইসিসির র‍্যাংকিং সিস্টেম মূলত বিশ্বের সেরা দল কিংবা সেরা খেলোয়াড়ের একটা চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি; মোট তিন ফরম্যাটে আইসিসির এই র‍্যাংকিং প্রকাশিত হয়ে থাকে। পুরুষ আর মহিলা দুই বিভাগেই আবার আইসিসির আলাদা আলাদা র‍্যাংকিং থাকে।

আইসিসির র‍্যাংকিং তৈরির পদ্ধতিতে দল আর খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যাবহার করা হয়। এমনকি দলের র‍্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির চাইতে টেস্টের র‍্যাংকিং তৈরির পদ্ধতি একেবারে আলাদা। তবে আজকে এই লেখাতে আমরা শুধু দেখবো খেলোয়াড়দের র‍্যাংকিং কিভাবে করা হয়।

শুরুতেই বলে নিই, ‘র‍্যাংকিং’ এর ‘রেটিং’ মোটেও একই নয়। এটা বলে নেওয়ার কারণ আমাদের এই লেখাতে বেশ কয়েকবার এই দুটি শব্দ আসবে। অনেকেই মনে করেন এই দুটি শব্দ বুঝি একই অর্থ বহন করে। কিন্তু ‘আইসিসির র‍্যাংকিং’ এর ক্ষেত্রে এই দুটি শব্দের আবেদন সবসময়ই ভিন্ন।

রেটিং বা রেটিং পয়েন্ট ব্যাটসম্যান, বোলার , অলরাউন্ডার বা কোন দলকে দেওয়া হয় ম্যাচের সময়। এই রেটিং পয়েন্ট তৈরির গণনা পদ্ধতি একটু জটিল। আর এই কোন একটা সময় পরে সব খেলোয়াড়েরা যে রেটিং পয়েন্ট পেল সেটার উর্ধ্বক্রম বা অধঃক্রম অনুসারে বানানো হয় র‍্যাংকিং।

উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, যদি বাংলাদেশ একটা নির্দিষ্ট সময় পরে টেস্টে ১২০ রেটিং পয়েন্টের অধিকারী হয় আর এই রেটিং পয়েন্ট যদি অন্য সব দেশের তুলনায় বেশি হয় তাহলে বাংলাদেশ হবে আইসিসির এক নম্বর টেস্ট দল।

এখন আসি আইসিসির সেই খেলোয়াড়দের র‍্যাংকিং পদ্ধতি নিয়ে। খেলোয়াড়দের এই র‍্যাংকিংয়ের প্রথম দেখা যায় ১৯৮৭ সালে। সেসময় এই র‍্যাংকিং নিয়ে বলা হচ্ছিল, এই র‍্যাংকিং এর মূল উদ্দেশ্য বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে চিহ্নিত করা। কিন্তু তখন সেটা বেশিরভাগই নির্ভর করত ব্যাটিং গড় কিংবা বোলিং গড়ের ওপর।

তো শুরুর সেই পদ্ধতিতে একটা বড়সড় ত্রুটি ছিল। একজন খেলোয়াড়ের গড় তো আর তাঁর সাম্প্রতিক ফর্মকে তুলে ধরেনা। এমনকি এই গড়ের মধ্যে খেলোয়াড় কোন কন্ডিশনে খেলছেন, প্রতিপক্ষ কতটা শক্ত ছিল; এসব কিছুও থাকেনা। তখন যেটা হল, আইসিসি একেবারে নতুন এক র‍্যাংকিং পদ্ধতির প্রচলন করে যেটা এখন ব্যাবহার করা হয়। এই পদ্ধতি আবার তিন ধরণের- ব্যাটসম্যান, বোলার আর অলরাউন্ডারের র‍্যাংকিং এর জন্যে তিনটি একেবারে ভিন্ন ধরণ! বাহুল্য কিন্তু বলে রাখি, উইকেট-কিপার কিংবা ফিল্ডারের জন্যে আলাদা কোন র‍্যাংকিং নেই।

এখন আইসিসির খেলোয়াড় র‍্যাংকিং পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে?

আগেই বলেছি, আইসিসির এই র‍্যাংকিং নির্ণয় দেওয়া হয় রেটিং পয়েন্টের ভিত্তিতে। র‍্যাংকিং কিভাবে দেওয়া হয় এই প্রশ্ন জানতে হলে আসলে আমাদের জানতে হবে রেটিং পয়েন্ট কিভাবে দেওয়া হয়। রেটিং পয়েন্ট দিতে গেলে বেশ কিছু ‘ফ্যাক্টর’-এর বিন্যাস আর সমাবেশ করা হয়। একজন খেলোয়াড়ের জন্যেই কাজটা সেই ফ্যাক্টরগুলো থেকে রেটিং পয়েন্ট নির্ণয় করা কঠিন, কিন্তু যখন দেখা যায় একসাথে অনেক খেলোয়াড় খেলছে তখন সেই কাজটা রীতিমত দুর্বোধ্য হয়ে যায়।

বেসিক আউটলাইন

তিন ফরম্যাটে রেটিং নির্ণয়ে কিছু ভিন্নতা থাকলেও কিছু ফ্যাক্টর আছে যেগুলো তিন ফরম্যাটেই কমন। এগুলোই হল র‍্যাংকিং এর বেসিক বলে ধরে নিতে পারি আমরা-

১। খেলোয়াড়দের রেট করার ক্ষেত্রে ০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রেটিং দেওয়া হয়। ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে ব্যাটিং পারফরম্যান্সের হিসাবে আর বোলারদের ক্ষেত্রে বোলিং পারফরম্যান্সের হিসাবে রেটিং দেওয়া হলেও অলরাউন্ডারদের রেটিং পয়েন্ট নির্ণয় একটু ভিন্ন!

২। রেটিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে পরপর দুটো ম্যাচের পারফরম্যান্স খুবই জরুরী। ধরা যাক একটা ম্যাচে সাকিব ও তামিম ভাল পারফর্ম করল। তার পরের ম্যাচে যদি তামিম আগের ম্যাচের চাইতেও ভাল পারফর্ম করেন তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্ট বৃদ্ধি পাবে, যদি আগের ম্যাচের চাইতে খারাপ করেন তাঁর রেটিং কমে যাবে। বুঝতেই পারছেন, রেটিং পয়েন্ট বাড়াতে হলে বা কমাতে হলে খেলোয়াড়কে শুধু ভাল বা খারাপ খেললেই হবেনা। তাকে ভাল বা খারাপ খেলতে হবে আগের ম্যাচের সাপেক্ষে।

৩। আইসিসির রেটিং পয়েন্ট নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ম্যাচ শেষেই প্রত্যেক ইন্ডিভিজুয়াল খেলোয়াড়ের জন্যে পারফরম্যান্স যাচাই করা হয়, প্যারামিটারগুলো খতিয়ে দেখা হয়।

৪। আইসিসির এই পারফরম্যান্স এনালাইসিস করে রেটিং পয়েন্ট দাঁড় করানোর ব্যাপারে কোন মানবছোঁয়া থাকেনা। পুরো ব্যাপারটার জন্যে আইসিসির একটি নিজস্ব কম্পিউটারাইজড অ্যালগরিদম আছে। সেই অ্যালগরিদমই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই রেটিং পয়েন্ট গণনার কাজটি করে থাকেন। বুঝতেই পারছেন, কেউ সেরা হয়ে গেলে সেটাতে আইসিসিকে গালমন্দ করার কিছু নেই।

৫। আইসিসির এই অ্যালগরিদম প্রত্যেক ম্যাচ শেষেই খেলোয়াড়কে একটি নিজস্ব রেটিং পয়েন্ট দেওয়া। আগেই বলেছি, রেটিং পয়েন্ট নির্ভর করে খেলোয়াড়ের সেই ম্যাচের পারফরম্যান্সের উপরে ভিত্তি করে নয়। বরং নির্ভর করে সেই ম্যাচে তিনি আগের ম্যাচের তুলনায় কেমন পারফর্ম করেছেন তার ওপর। যা হোক, প্রতি ম্যাচ শেষেই খেলোয়াড়েরা নতুন রেটিং পয়েন্ট পেলেও র‍্যাংকিংয়ের জন্যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে প্রতি ম্যাচ শেষেই হালনাগাদ করা হয়না। এই দুই ফরম্যাটের র‍্যাংকিং পরিবর্তন করানো হয় সিরিজ শেষে। টেস্ট ম্যাচের ক্ষেত্রে অবশ্য নিয়মটা আলাদা। সেখানে র‍্যাংকিং এর হালনাগাদ করা হয় ম্যাচশেষেই।

৬। যারা নতুন খেলোয়াড় , তাঁদের রেটিং পয়েন্ট শুরু হয় শূন্য থেকে। তাঁদের রেটিং পয়েন্ট বাড়াতে হলে ক্রমাগতভাবে পূর্ববর্তী ম্যাচের তুলনায় ভাল খেলতে হবে। দ্বিতীয় ম্যাচে পারফর্ম করতে হবে অভিষেক ম্যাচের চাইতেও বেশি ভাল। আবার তৃতীয় ম্যাচে পারফর্ম করতে হবে দ্বিতীয় ম্যাচের তুলনায় আরো বেশি ভাল। মানে ক্রমাগত একই রকম ভাল পারফর্ম করলে খেলোয়াড়ের রেটিং ভাল হবে না, তাকে ছাড়াতে হবে আগের ম্যাচের পারফর্ম্যান্স। তাহলেই তাঁর রেটিং বাড়বে, র‍্যাংকিংয়ে উঠতে পারবেন।

৭। যদি কোন খেলোয়াড় কোন ম্যাচ মিস করেন তাহলে তিনি রেটিং পয়েন্ট মিস করবেন, তাঁর রেটিং পয়েন্ট কমে যাবে। এভাবে তিনি যে কয়টি ম্যাচ মিস করবেন, সে কয়টি ম্যাচেই তাঁর রেটিং পয়েন্ট কমবে। তাঁর মানে, ম্যাচ মিসের জন্যে আইসিসি কোন ছাড় দেয়না সেটা যত গুরুতর কারণেই হোক না কেন।

৮। যদি কোন খেলোয়াড় অবসর নেন, তাহলে আইসিসি র‍্যাংকিং থেকে তাঁর নাম সরিয়ে ফেলে আর অবসর না নেওয়া খেলোয়াড়েরা র‍্যাংকিংয়ে এক ধাপ করে সামনে এগিয়ে আসেন।

টেস্ট ম্যাচে খেলোয়াড় র‍্যাংকিং

আগেই বলেছি, খেলোয়াড় র‍্যাংকিং করা হয় রেটিং পয়েন্টের ভিত্তিতে আর রেটিং পয়েন্ট দেওয়া হয় কিছু ‘ফ্যাক্টর’ যাচাই করে। সেসমস্ত ‘ফ্যাক্টর’ই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১) ব্যাটসম্যানের জন্যে ফ্যাক্টরসঃ

রেটিং পয়েন্ট দিতে ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্স যাচাইয়ে যেসব ফ্যাক্টর দেখা হয় –

ক) ব্যাটসম্যানের করা রানঃ

এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ফ্যাক্টর। ব্যাটসম্যানের করা রান যে রেটিং পয়েন্টে অবদান রাখবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

খ) বোলারের সেসময়ের রেটিং পয়েন্টঃ

ব্যাটসম্যানের রেটিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা কাজ করে, যাদের বিপক্ষে তিনি রান করলেন সেই বোলারদের রেটিং পয়েন্ট কত। সোজা কথায়, বিপক্ষ দলের বোলিং অ্যাটাক ঠিক কতটা শক্তিশালী। প্রতিপক্ষ বোলারদের রেটিং যত ভাল হবে, ব্যাটসম্যানের রেটিং তত বাড়বে আর বিপরীতটাও সত্যি।

গ) লেভেল অফ রান স্কোরিংঃ

এটা শুনতে হয়তো আপনার একটু কনফিউজিং লাগছে। ব্যাখ্যা করা যাক তাহলে। যদি কোন ব্যাটসম্যান একটা লো-স্কোরিং ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন তাহলে এটাকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হয় আর রেটিং পয়েন্ট বেড়ে যায় অনেক বেশি। কিন্তু সেই একই রকম সেঞ্চুরি যদি ব্যাটসম্যান কোন হাই-স্কোরিং ম্যাচে করেন তাহলে লো-স্কোরিং ম্যাচের মত ঐ পরিমাণে রেটিং পয়েন্ট বাড়ে না তাঁর। এটাকেই বলে ‘লেভেল অফ রান স্কোরিং’।

উদাহরণ-

ঘটনা-১

তামিম ৯০ বলে ১০০ করলেন কিন্তু বাংলাদেশ করেছে মাত্র ২০০।

ঘটনা-২

তামিম ৯০ বলে ১০০ করেছে কিন্তু বাংলাদেশ করেছে ৬০০।

এখানে ঘটনা-১ এর সেঞ্চুরিটাকেই বেশি দামী মনে করা হবে। আর ঘটনা-১ এর ম্যাচেই রেটিং পয়েন্ট বাড়বে বেশি।

ঘ)  অপরাজিত ইনিংসঃ

যদি কোন ব্যাটসম্যান কোন ম্যাচ শেষে অপরাজিত থাকেন, তাহলে তাকে বোনাস রেটিং পয়েন্ট দেওয়া হয়।

ঙ) ম্যাচের ফলাফলঃ

যদি ব্যাটসম্যান ভাল পারফর্ম করেন আর তার জন্যে তাঁর দল জিতে যায় তাহলে ব্যাটসম্যান বোনাস রেটিং পয়েন্ট পান। এই বোনাসেরও আবার পার্থক্য আছে। যে দলের বিপক্ষে তাঁর দল জয় পেয়েছে তাঁদের র‍্যাংকিং যদি ব্যাটসম্যানের নিজের দলের র‍্যাংকিং থেকে উপরে হয় তাহলে বোনাস রেটিং পয়েন্টের পরিমাণ যত হয়, নিচের র‍্যাংকিং এর দলের বিপক্ষে জয় পেলে তত হয়না।

২) বোলারের জন্যে ফ্যাক্টরসঃ

ব্যাটসম্যানের মতই বোলারের রেটিং পয়েন্ট নির্ণয়েও বেশ কিছু ফ্যাক্টরকে দেখা হয়-

ক)উইকেট নেওয়া আর রান দেওয়া

এটাও ঐ ব্যাটসম্যানের রান করার মতই সহজ একটি ফ্যাক্টর, যে কারনে একজন বোলারকে দলে নেওয়া হয়- উইকেট নেওয়া আর রান কম দেওয়া।

খ) আউট করা ব্যাটসম্যানের রেটিং পয়েন্ট

বোলার কেমন ব্যাটসম্যানের উইকেট পাচ্ছেন সেটাও একটা জরুরী বিষয়। যে ব্যাটসম্যানের উইকেট নিচ্ছেন তিনি সেই ব্যাটসম্যানের রেটিং পয়েন্টের ওপরে বোলারের রেটিং পয়েন্ট নির্ভর করে। ধরা যাক, কোন এক ম্যাচে কেউ ৫ উইকেট পেল । যদি এই ৫ উইকেটের ৪টি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট হয় তাহলে বোলারের রেটিং পয়েন্ট বেশি বাড়বে। কিন্তু যদি চার উইকেট লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট হয় তাহলে বোলারের রেটিং কম বাড়বে।

আবার ধরা যাক, কোন ম্যাচে তাসকিন অজিঙ্কা রাহানের উইকেট নিলেন আর মুস্তাফিজ বিরাট কোহলির উইকেট নিলেন। তাহলে মুস্তাফিজের রেটিং বাড়বে তাসকিনের চাইতে বেশি। কারণ সহজ, বিরাট কোহলির রেটিং অজিঙ্কা রাহানের চাইতে বেশি।

গ) লেভেল অফ রান স্কোরিং

বোলার রেটিং এর ‘লেভেল অফ রান স্কোরিং’ টার্মটা ব্যাটসম্যান রেটিং এর ‘লেভেল অফ রান স্কোরিং’ এর মতই।

ধরা যাক, কোন ম্যাচে বোলার ৪৫ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিল যেখানে প্রতিপক্ষ দলের রান ৪০০। আবার কোন এক ম্যাচে বোলার ৪৫ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিল যেখানে প্রতিপক্ষ দলের রান ১৫০। এখানে কিন্তু, প্রথম ম্যাচেই বোলারের রেটিং বাড়বে সবচেয়ে বেশি। কারণটাও বেশি, সাই স্কোরিং ম্যাচেই রান কম দেওয়া আর উইকেট নেওয়া বেশি কষ্টের।

ঘ) ওয়ার্কলোড

কোন এক ম্যাচে বোলার যদি তাঁর ম্যাচের বাকি বোলারের চাইতে বেশি ওভার বল করে তাহলে সেই বোলার অতিরিক্ত রেটিং পয়েন্ট পায়। এমনকি, যদি সেই বোলার উইকেট নাও পায়, তবুও এই ‘ওয়ার্কলোড’ জনিত রেটিং পয়েন্ট তাঁর নামের পাশে যোগ হয়।

ঙ) ম্যাচের ফলাফল

এই ফ্যাক্টরটা ব্যাটসম্যানের সেই শেষ ফ্যাক্টরটির মতই। বোলার যদি তাঁর দলের হয়ে ম্যাচ জিততে পারে তাহলে সে অতিরিক্ত পয়েন্ট পায়। এখানেও বিপক্ষ দলের র‍্যাংকিং দেখা হয়। ধরা যাক কোন ম্যাচে বোলার তাঁর দলের চাইতে উপরের র‍্যাংকিং এর দলের সাথে ম্যাচ জিতল, আবার আরেক ম্যাচে সে তাঁর দলের চাইতে নিচের র‍্যাংকিং এর দলের সাথে ম্যাচ জিতল। এক্ষেত্রে প্রথম ম্যাচেই তাঁর বোনাস রেটিং হবে সবচাইতে বেশি।

ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে অতিরিক্ত ফ্যাক্টরস

যেমনটা আমি আগেই বলেছি, টেস্ট আর ওয়ানডে/টি-টোয়েন্টিতে রেটিং পয়েন্ট পদ্ধতি একই হলেও ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ছোটোখাটো কিছু ফ্যাক্টরকেও ধর্তব্যে আনা হয়-

ক) দ্রুত রান তোলার জন্যে রেটিং পয়েন্ট(ব্যাটসম্যান)

টেস্টে দ্রুত রান তোলার ব্যাপারটা সেরকম গুরুত্বপূর্ণ  না হলেও ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে দ্রুত রান তোলার ব্যাপারটা একটু বেশিই গুরুত্ব বহন করে। ম্যাচের ফল নির্ধারণেও এটা একটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই এই দ্রুত রান তোলার ওপর রেটিং পয়েন্টের ভিন্নতা আছে।

ধরা যাক, কোন একটা ম্যাচে তামিম ১০০ বল খেলে ৫০ রান করলেন আর সাকিব ২৫ বল খেলে ৫০ রান করলেন। দুজনের রান সমান হলেও সাকিবের রেটিং পয়েন্ট বেশি বৃদ্ধি পাবে। কারণ দ্রুত রান তোলাটাও রেটিং পয়েন্টে একটা ‘ফ্যাক্টর’।

খ)ইকোনমি রেট (বোলার)

ব্যাটসম্যানের দ্রুত রান তোলার মত বোলারের ইকোনমি রেটও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।রেটিং পয়েন্টেও এর আলাদা আবেদন রয়েছে। দুইজন বোলার যদি সমসংখ্যক ওভার বল করে সমান উইকেট পায় তাহলে যার ইকোনমি রেট কম সে বেশি রেটিং পয়েন্ট পাবে।

গ) পয়েন্ট হারানো

কোন খেলোয়াড় ম্যাচ না খেলার জন্যে রেটিং পয়েন্ট হারাবেন। ওয়ানডেতে আর টি-টোয়েন্টিতে এ হিসাব ভিন্ন। ওয়ানডেতে এক ম্যাচ না খেলার জন্যে খেলোয়াড়টির মোট রেটিং পয়েন্টের ০.৫% আর টি-টোয়েন্টিতে মোট রেটিং পয়েন্টের ২% কাটা যাবে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন একজন খেলোয়াড়ের টি-টোয়েন্টিতে রেটিং পয়েন্ট ধরা যাক ৫০০। যদি সে এক ম্যাচ না খেলা তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্ট হবে ৫০০-৫০০ x ২%=৪৯০

অলরাউন্ডারদের রেটিং পয়েন্ট

অলরাউন্ডারদের রেটিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতি একটু ভিন্ন আর সে কারণে তাঁদের রায়ংকিং পদ্ধতি ব্যাটসম্যান কিংবা বোলারের মত নয়। এটা অবশ্য আমি প্রথমেই বলে নিয়েছি। যা হোক, অলরাউন্ডারদের রেটিং পয়েন্ট নির্ণয় করার ফর্মুলা হল,

অলরাউন্ডিং রেটিং পয়েন্ট = [(ব্যাটিং রেটিং পয়েন্ট x বোলিং রেটিং পয়েন্ট)/১০০০}

খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন অলরাউন্ডার যেহেতু ব্যাট আর বল দুটোই করেন, তাই তাঁর রেটিং পয়েন্ট নির্ণয়ে এই দুটোই গণনা করা হয়। ব্যাটিং আর বোলিং রেটিং পয়েন্ট উপরে বর্ণিত আলোচনার মতই। আর এরপর উপরের সহজ ফর্মুলা ব্যাবহার করে অলরাউন্ডারের রেটিং পয়েন্ট নির্ণয় করা হয়। কারো যদি ব্যাটিং আর বোলিং রেটিং দুটোই বেশি থাকে, তাহলে অলরাউন্ডিং রেটিং পয়েন্ট তাঁর জন্যে অনেক বেশি হবে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

রেটিং পয়েন্ট নিয়ে সাধারণ আলোচনা শেষ । আমি এ পর্যায়ে র‍্যাংকিং আর রেটিং পয়েন্ট নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেব।

প্রশ্ন- আইসিসি কিভাবে ঠিক করে কোন খেলোয়াড়কে তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে?

আইসিসি স্বীকৃত ম্যাচ খেলছে এমন সব খেলোয়াড়কেই আসলে আইসিসি র‍্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসে। তবে আইসিসির তালিকাতে আসতে একজন খেলোয়াড়কে-

ক) র‍্যাংকিং নেওয়ার সময়সীমার মধ্যে ম্যাচ খেলতে হবে (টেস্টের জন্যে সেটা ১২-১৫ মাস আর ওয়ানডে/টি-টোয়েন্টির জন্যে সেটা ৯-১২ মাস)

খ) খেলোয়াড়কে সমসাময়িক খেলোয়াড় হতে হবে এবং অবসর নেওয়া যাবেনা।

আইসিসি মূলত রেটিং পয়েন্টের ভিত্তিতে ১০০ জন খেলোয়াড়কে র‍্যাংকিং এ জায়গা দিয়ে থাকে। তবে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের রেটিং পয়েন্ট আইসিসির ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে। তাই অনেক খেলোয়াড়েরই র‍্যাংকিংয়ে আসতে কিছুটা সময় লেগে যাবে।

এক্ষেত্রে পার্থিব প্যাটেল ভাল উদাহরণ হতে পারেন। ২০০৮ সালে তিনি ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েন আর ২০০৯ সালে প্রকাশিত র‍্যাংকিংয়ে তিনি জায়গা হারান। কারণ র‍্যাংকিং দেওয়ার যে সময়সীমা সেই ১২ মাসে তিনি কোন ম্যাচ খেলেননি। যা হোক, ম্যাচ মিস করতে থাকলে তাঁর রেটিং পয়েন্ট কমতে তাহলে কিন্তু ২০১৬ সালে আবারও দলে জায়গা পেলে তিনি র‍্যাংকিংয়ে চলে আসেন।

প্রশ্ন- যদি কোন খেলোয়াড় ম্যাচ খেলেন কিন্তু ব্যাট/বল কিছুই না করেন তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্টের কি হবে?

যদি ব্যাটসম্যান ম্যাচ খেলেন কিন্তু ব্যাট না করেন তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্টের কোন পরিবর্তন হবেনা (এমনটা তো হতেই পারে যে দল ২ উইকেটে জয় লাভ করেছে আর তিনি ছিলেন ৫ নম্বর ব্যাটসম্যান। তাহলে তিনি তো ব্যাট করার সুযোগই পাবেন না)। কিন্তু বোলারের ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু ভিন্ন। যদি বিপক্ষ দলের স্কোর ১৫০ এর নিচে হয় আর বোলার বল না করেন তাহলে বোলারের রেটিং পয়েন্ট অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু যদি বিপক্ষ দল ১৫০+ স্কোর করে আর বোলার ম্যাচে বল না করেন তাহলে বোলারের রেটিং পয়েন্ট কাটা যাবে।

প্রশ্ন- উইকেট-কিপারদের কেন র‍্যাংকিং দেওয়া হয়না?

উইকেট-কিপার কিংবা ফিল্ডারদের র‍্যাংকিং না দেওয়ার কারণ হল কোন একটা ক্যাচ বা স্ট্যাম্পিং এর যে সুযোগ তৈরি হওয়া সেটা উইকেট-কিপার বা বোলার কারো ওপর নির্ভর করেনা। এটা নির্ভর করে বোলারের ওপর। আবার উইকেট-কিপার / ফিল্ডারদের কোনটা ‘মিসড চান্স’ সেটা নির্ধারণ করারও কোন প্যারামিটার নেই। একটা ক্যাচ কতটা কঠিন সেটা তো অ্যালগরিদম দিয়ে যাচাই করা যায়না, তাই?

প্রশ্ন- একজন খেলোয়াড় ভাল নাকি খারাপ সেটা কি রেটিং পয়েন্ট দিয়ে যাচাই করা যায়?

রেটিং পয়েন্ট মূলত নির্দিষ্ট সময় ধরে খেলোয়াড় কত ভাল খেলছেন সেটারই নির্দেশক মাত্র। তবুও আমরা কিছু প্যারামিটার সেট করে দিতে পারি-

ক) ৯০০ এর ওপর রেটিং পয়েন্ট একটা সুপার অ্যাচিভমেন্ট ধরা হয়। খুব অল্পসংখ্যক খেলোয়াড় এটা ছুঁতে পারেন আর তার চাইতেও অল্প সংখ্যক খেলোয়াড় এটা ছুঁয়ে চালিয়ে যেতে পারেন।

খ) ৭৫০ রেটিং পয়েন্ট র‍্যাংকিং এ সেরা দশে ঢুকে যাবার জন্যে যথেষ্ট ভাল।

গ) ৫০০ বা তাঁর বেশি রেটিং পয়েন্টকে বেশ ভাল ধরা হয়।

উপসংহার

উপরে আমরা আলাদা আলাদা ফ্যাক্টর ধরে রেটিং পয়েন্ট বর্ণনা করলাম। এটা হয়তো কিছুটা সহজ লাগছে কিন্তু এই ফ্যাক্টরগুলো যখন একসাথে ঘটবে তখন কি হবে? কোন ফ্যাক্টরের জন্যে হয়তো খেলোয়াড় রেটিং পয়েন্ট হারাবে, কোন ফ্যাক্টরের জন্যে হয়তো খেলোয়াড় রেটিং পয়েন্ট অর্জন করবে। তখন হিসাবটা আইসিসির জন্যে একটু জটিল হয়ে যায়। আর তার চাইতেও জটিল হয় যখন একসাথে অনেক খেলোয়াড়ের রেটিং পয়েন্টের পরিবর্তন হয়। তাই আইসিসি এ কাজটি করে অটোমেটেড উপায়ে। এতে ভুল হবার তাই কোন সম্ভাবনা নেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...