দুস্তর পারাবার পাড়ি দেওয়া হয়নি!

যে উদ্ধত ভঙ্গিতে ভারত বিপক্ষকে ক্রমাগত গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে ‘সোনার শহর’ জোহানেসবার্গে সোনার কাপটা হাতে তুলে নেওয়ার জন্য এসেছে প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া ও সেই পথেরই পথিক। ভারতের অভিযানে যে দলটা সেঞ্চুরিয়নের এক শনিবারের বারবেলায় তাঁদের নি:স্ব করে ছেড়েছিল, সেই তাঁদের বিরুদ্ধেই যুযুধান এর মঞ্চ এবারে প্রস্তুত ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে।

মহাযুদ্ধের আগে দুই শিবিরের সৈনিকরাই যখন তাদের নিজ অস্ত্রে শান দিতে ব্যস্ত তখন তাবড় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শুধুই ভারতের ‘খুদে জিনিয়াস’ কে নিয়ে মুগ্ধতা, সেই হল্যান্ড ম্যাচ থেকে শুরু করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত দেখলে দেখা যাবে তাঁর ব্যাটে রান আসেনি মাত্র দুটো ম্যাচে, সেই সুপার সিক্সের কেনিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কারোর কারোর তখন এটাই মনে হতে শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয়বার কাপ জয়ের মধ্যে ব্যবধান হতে পারেন শুধু ভারতের ১০ নম্বরধারী।

অজিরা অবশ্যই হিসেবে রাখছেন সবাইকেই, অজি দ্রোণাচার্য জন বুকাননের নোটবুকে এ বিশ্বকাপে তিন সেঞ্চুরি করা সৌরভ গাঙ্গুলি বা ভারতের তিন পেসার যে আলাদা করে থাকবেন তা বলাই বাহুল্য। ভারত যেমন কাঁটা বিছানো পথে শুরু করেছিল, বিপর্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আজ সোনায় রূপোয় মোড়া কাপটা ছোঁবার স্বপ্ন দেখছে, অজিরা কিন্তু বীর আলেজান্ডারের মতোই বিশ্বকাপ যত এগিয়েছে বীরদর্পে এগিয়ে গেছে, আর বিপক্ষরা শুধু তক্ষশীলার রাজা অম্ভির মতো বশ্যতা শিকার করে গেছে, নিউজিল্যান্ড বা কেনিয়ার মতো কোনো কোনো দল হয়তো পুষ্কলাবতীর অষ্টকের মতো বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে আলেকজান্ডার থুড়ি অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ থামানো যায়নি। আর দুদলের মধ্যেই তখন এমন একটা ভাব – ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সুচাগ্র মেদিনী’।

চুম্বকে এই যখন দুই দলের নির্যাস, তখন জোহানেসবার্গের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেহালার সৌরভ গাঙ্গুলি না তাসমানিয়ার লন্সস্ট্রোনের রিকি পন্টিং রাজদণ্ডটা তুলে ধরবেন সেটাই তখন দেখার পালা। এদিকে ভারতের দেশজুড়ে তো আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে সেই কবে থেকেই, ‘বিশ সাল বাদ’!

অস্ট্রেলিয়া যদিও সেই অস্ট্রেলিয়াতেই আছে, সেঞ্চুরিয়নের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভারত আর ২৩ মার্চ মহাযুদ্ধের শেষ মহড়ায় নামার আগের ভারতের মধ্যে কিন্তু তফাৎ টা আকাশ পাতাল। তখনকার ভারত অধিনায়ক ফর্ম টর্ম হারিয়ে নিজেকে যখন ফিরে পাওয়ার চেষ্টায়, সেই অধিনায়কই এ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করে আর সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরে ফুটছেন, সঙ্গে টগবগিয়ে ফুটছে তাঁর গোটা দলও, ভেতরে ভেতরে কাপ ফাইনালের উত্তেজনা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে মাঠে নামার আগেই বেশি মাত্রায় আড্রিনালিন ক্ষরণ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, আর সামনে অস্ট্রেলিয়া বলে ‘দেখিয়ে দেওয়া’ বা আগ্রাসন দিয়ে মাত করার গরজটা যেন মাঠে নামার আগেই ভারতীয় দলের একটু বেশিই বলে মনে হচ্ছিল।

আগের দিন জোহানেসবার্গে বৃষ্টি হওয়ায় আর্দ্র পিচে সৌরভ টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার পর জাহিরের প্রথম ওভারেই অতিরিক্ত আগ্রাসনের ফল গোটা অসি ইনিংস জুড়ে ভারতকে ভোগ করতে হল। সামনে অস্ট্রেলিয়া তো কি, বিপক্ষকে পাল্টা জবাব দেওয়ার রণনীতি কাপ ফাইনালে ভারতীয় বোলারদের অনভিজ্ঞতার কারণে আর খাটলো না, ফলত গিলক্রিস্ট-হেডেনকে যেচে স্লেজিং করতে গিয়ে প্রথম ওভারেই ১৫ রান বেরিয়ে গেল।

সেই প্রথম ওভার থেকেই যে বিধ্বংসী মেজাজে অসিরা শুরু করলো তাতেই সৌরভ ব্রিগেডের বোলারকুল হতোদ্যম হয়ে পড়ছিল। হরভজন পরপর দু ওভারে দুই অসি ওপেনারকে ফেরত পাঠানোর পর যখন মনে হচ্ছিল এবার ম্যাচে ফেরত আসতে পারে ভারত, ঠিক সেখান থেকেই এক অত্যাশ্চর্য ধ্বংসলীলায় মাতলেন অসি নেতা পন্টিং আর তাঁর সঙ্গী ড্যামিয়েন মার্টিন। সিমিং উইকেটে ভারতীয় বোলারদের নিধনপর্ব যখন সাঙ্গ হলো ক্যাঙ্গারুদের স্কোরবোর্ড তখন বলছে ২ উইকেটে ৩৫৯!

অজি অধিনায়ক যখন বীরদর্পে ব্যাট তুলে দর্শক অভিবাদন গ্রহণ করতে করতে ফিরছেন তাঁর নামের পাশে তখন ১২১ বলে ১৪০, আর সঙ্গী মার্টিন ও অপরাজিত ৮৮তে। যে দক্ষযজ্ঞ ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে ঘন্টা দুয়েক ধরে তাঁরা দুজনে চালালেন তারপরে তাঁর বিপক্ষ দলনেতা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখলে সত্যিই করুনা হচ্ছিল, সময় সময় মনে হচ্ছিল কেন তিনি মহাগুরুত্বপূর্ণ যজ্ঞে টসে জিতেও ফিল্ডিং নিলেন, কেন তিনি কুম্বলেকে খেলালেন না, কেন তিনি নিজে বল হাতে তুললেন না, যেখানে তিনি নিজেও বল হাতে ম্যাচ ঘোরানোর ক্ষমতা রাখেন, সেই হারারে ম্যাচে তাঁর ডানহাতের বলই কিন্তু খেলা ঘুরিয়েছিল।

আসলে কখনো সখনো এমন দিন আসে যেখানে সব কিছুই তালগোল পাকিয়ে যায়। না, তাঁর ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তেও সম্ভবত কোনো ভুল ছিল না, আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় একটু আর্দ্র পিচে আগে ব্যাটিং করলে ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি দের সামনে তাঁর দলবল ১৮০ তে গুটিয়ে যেতেই পারতো, আর যে পেস ব্রিগেড গোটা টুর্নামেন্টে সোনা ফলিয়ে এসেছে তাঁরা হঠাৎ ফাইনালে এসে চোক করে যাবে, তাও আবার সহায়ক কন্ডিশনে, এটা ভারত অধিনায়কের কল্পনারও বাইরে ছিল সম্ভবত। মোঙ্গিয়ার মত কাউকে বসিয়ে কুম্বলেকে খেলানো বা নিজের বল করার সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে মস্তিস্ক অত্যধিক আড্রিনালিন ক্ষরণে তালগোল পাকিয়ে যায় হয়ত তাঁর, যার ফলশ্রুতি কাপ ফাইনালে ৩৬০ তাড়া করার পাহাড়প্রমাণ চাপ, যা বোধহয় একবিংশ শতকের প্রথম পর্বে ঐ ভিডিও গেমেই সম্ভব ছিল!

কাপ ফাইনালের ওই ৩৬০ টার্গেট ভারতের কাছে যেন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার…’। যতটা খারাপ শুরু করা যায় প্রথম ওভারে ঠিক সেটাই করলো ভারত, ম্যাকগ্রাকে পুল করতে গিয়ে ধরা পড়লেন একশো কোটির সবচেয়ে বড় আশা ভরসা টেন্ডুলকর, ওখানেই যেন কর্ণের রথের চাকা অর্ধেক বসে যায়। সৌরভ, শেবাগরা পাল্টা আক্রমনে গিয়ে লড়াই জারি রাখলেও তা অসি প্রাচীর ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিল না।

ভারতীয় ইনিংস চলাকালীন একবারই আশার আলো দেখা গিয়েছিল, যখন ১৭ ওভার শেষে বৃষ্টি নামলো, তখন একশো কোটির প্রার্থনা আর যেন বৃষ্টি না থামে, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার ৩৫৯ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে, পরেরদিন আবার নতুন ম্যাচ। কিন্তু বরুণদেব একশো কোটির প্রার্থনায় মোটেই কান দিলেন না, তিনি বোধকরি ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পড়েছিলেন, তাই মিনিট পঁচিশের মধ্যেই ওয়ান্ডারার্সের আকাশে তখন খটখটে রোদ, আর নীল জার্সির ড্রেসিংরুমে গাঢ় মেঘ যেন আরো তীব্রতর।

শচীন রমেশ টেন্ডুলকরের বান্দ্রার বাড়িতে যথারীতি বিশ্বকাপের সোনার ব্যাটটা যখন যাচ্ছে তখন জন রাইট নামের এক কিউই ভদ্রলোক, যিনি কিনা এই ভারতীয় দলের কোচ ও বটে, তাঁর গ্রুপ লিগে হল্যান্ড ম্যাচের আগে একটা ছোট্ট বৈঠকের কথা মাথায় আসছিল, যে বৈঠকেই শচীনের বিশ্বকাপে ওপেন করার সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়ে যায়।

সাদা চোখে দেখলে ভারতের কাপ অভিযানে এতদূর পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট ও হয়ে যায়। আর ঐ কিউই ভদ্রলোক শুধু শচীনের ওপেন করানোর সিলমোহর দিয়েই ক্ষান্ত হননি, গোটা টুর্নামেন্ট বাড়ির ‘বড়কত্তার’ মতো দলের বুনোটটা একদম এককাট্টা করে রাখতে আর ছেলেদের মনোবল তুঙ্গে রাখতে বিশাল ভূমিকা নিয়েছিলেন, সঙ্গে পেয়েছিলেন এক সাহসী, জেদি, দলের জন্য নিজেকে সপেঁ দিতে প্রস্তুত এক অধিনায়ককে, যা টিম ইন্ডিয়ার সুখী সংসার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ধরে রেখেছিল।

একটা ফাইনালে হার সেই সংসারকে সাময়িক বিপর্যস্ত করে দেয়, আসলে সেই হারারে থেকে যে টিমটা সমতলে রোলস রয়েসের মতো ছুটে চলছিল, পাহাড়ি রাস্তায় বাঁকের মুখে পড়ে সে খাদে পড়ার অবস্থায় চলে আসে। যেখানে দেড় মাস ধরে এই রোমাঞ্চকর মহা অভিযানে শচীনের শোয়েবকে মারা ছক্কাটা মিথ্যে হয় না, সৌরভের দাঁতে দাঁত চেপে সেমিফাইনাল ম্যাচ বের করাটা মিথ্যে হয় না, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় শেন বন্ডদের সামনে ঢাল তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, যুবরাজ-কাইফদের দুর্ধর্ষ ফিল্ডিং, নেহরার ব্রিটিশবধ বা শ্রীনাথের লঙ্কাবিজয় মিথ্যে হয় না।

মান-সচক্ষে সবকটাই চিরসত্যি, যেমনটা সত্যি সৌরভদের নাকের ডগা দিয়ে রিকি পন্টিংয়ের ধ্বংসলীলা চালিয়ে কাপ নিয়ে চলে যাওয়া। ২৩ মার্চ ২০০৩-এর পরের ৩০ বছর পর সৌরভ গাঙ্গুলি যদি ‘ভুতের রাজা’র থেকে কোনো বর পান, নির্ঘাত সেদিনের স্ক্রিপ্টটাই পাল্টে দিতে চাইবেন, দুঃস্বপ্নেও নির্ঘাত ঐ সত্যি টা হয়তো আর কখনো দেখতে চাইবেন না। সৌরভের বর প্রাপ্তি না হয় ভবিষ্যতের গর্ভে, ফাইনালের দিন ওয়ান্ডারার্স যা যা দেখিয়েছিল সেই সত্যিটা পাল্টে দেওয়ার দায়িত্ব না হয় ভাবি কালের হাতেই তোলা থাকলো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link