তিন অধিনায়ক, তিন যুদ্ধ

১৯৯১-৯২ এর অস্ট্রেলিয়া ট্যুর এ পর্যন্ত ভারতের দীর্ঘতম সফর সময়ের বিচারে, ১৯৯১ এর নভেম্বর থেকে ১৯৯২ এর মার্চ। অবশ্য এর মধ্যে বিশ্বকাপও ছিল। আর এই দীর্ঘ সফরটায় বেশিরভাগ ম্যাচ ভারত হেরে গেলেও কিছু হার ছিল যেগুলি আক্ষরিক অর্থেই শেষরক্ষা না হওয়াতে হার হয়, এরকমই একটা ম্যাচ ছিল অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত টেস্ট।

১.

১৯৯১-৯২ এর অস্ট্রেলিয়া ট্যুর এ পর্যন্ত ভারতের দীর্ঘতম সফর সময়ের বিচারে, ১৯৯১ এর নভেম্বর থেকে ১৯৯২ এর মার্চ। অবশ্য এর মধ্যে বিশ্বকাপও ছিল। আর এই দীর্ঘ সফরটায় বেশিরভাগ ম্যাচ ভারত হেরে গেলেও কিছু হার ছিল যেগুলি আক্ষরিক অর্থেই শেষরক্ষা না হওয়াতে হার হয়, এরকমই একটা ম্যাচ ছিল অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত টেস্ট।

টেস্ট সিরিজের শুরু থেকেই কপিল দেব খুব ভাল ফর্মে ছিলেন। পুরো সিরিজে ভারতীয় বোলাররা অস্ট্রেলিয়ার মোট ৭৬ টি উইকেট তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন যার মধ্যে ২৫ টি উইকেট নিয়েছিলেন একা কপিল। সেই কপিলের নেতৃত্বে এবং প্রভাকর, শচীন, রাজুর সহযোগিতায় অ্যাডিলেডে ভারত অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৪৫ রানে অল আউট করে দেয় এবং জবাবে নিজেরা ২২৫ রান করে, বলা বাহুল্য এখানেও সর্বোচ্চ রান ছিল কপিলের (৫৬)। কিন্তু পরের ইনিংসে কপিল ৫ উইকেট নিলেও মার্ক টেলর, ডেভিড বুন এবং আধিনায়ক বোর্ডারের ব্যাটে ভর করে অস্ট্রেলিয়া ৪৫১ রান তোলে এবং যার ফলে ভারতের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৭৪।

ভারতের হার তখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলেন একজন। বোর্ডে ১০০ রান উঠতে না উঠতে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেছেন শ্রীকান্ত, সিধু, শচীন, বেঙ্গসরকার। নামলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। প্রথমে মঞ্জেরেকারকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তীতে মনোজ প্রভকারকে নিয়ে শুরু করলেন পাল্টা লড়াই। বেড়িয়ে এলো এক অনবদ্য দৃষ্টিনন্দনীয় এবং অধিনায়কোচিত সেঞ্চুরি। সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে ম্যাকডারমট, মাৰ্ভ হিউজদের সামলে মনোজ প্রভাকরের লড়াই। ঠিক যেভাবে দেড় বছর আগে তিনি লড়েছিলেন শচীনকে সঙ্গে নিয়ে ম্যানচেস্টারের মাঠে। কিন্তু ম্যানচেস্টারে হার বাঁচাতে পারলেও এবারে পারলেন না।

ভুল বললাম। জয় থেকে মাত্র ৩৮ রান আগে থেমে গেল ভারতের ইনিংস। এক হৃদয়বিদারক দিন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। এক প্রায় অসম্ভব লক্ষ্য তাড়া করে ১০ বছর পরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বপ্নের তীরে এসে তরী ডুবল।

২.

সময়ের পরিবর্তন ২২ বছর আর সেই সঙ্গে চরিত্রের। বাকি সব এক, এমনকি মাঠটাও। এবারে ২০১৪ সালের অ্যাডিলেড। প্ৰথম বারের মতো টেস্টে অধিনায়কত্ব করতে নামলেন বিরাট কোহলি। এটা সেই সিরিজ যেটা ব্যাটসম্যান কোহলিকে টেস্টে অসাধারণ ব্যাটসম্যান থেকে গ্রেট ব্যাটসম্যানে উত্তীর্ণ করে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম ইনিংসে ওয়ার্নার, ক্লার্ক, স্মিথ আর দ্বিতীয় ইনিংসে শুধু ওয়ার্নার, এই চার শতরানে বড় করে বিরাট রানের বোঝা চাপিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন বিরাটের ঘাড়ে। প্রথম ইনিংসে বিরাটের শতরান ও সেই সঙ্গে পূজারা রাহানের যোগ্য সহায়তার পরে শেষ ইনিংসে এবার লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৬৪।

এক কথায় মুরলি বিজয় আর কোহলির অসাধারণ ব্যাটিংয়ে শেষ দিন ভারত এগিয়ে চলে প্রায় অসম্ভব লক্ষ্যের দিকে। ২০০১ এ ভারতে অনুষ্ঠিত সিরিজে অস্ট্রেলিয়া টিমের একটা রোগ ছিল। তারা যে সেশনে আউট হতো একসঙ্গে ৬/৭ জন করে আউট হতো। এখানেও ঠিক তাই হয়। ২৪২/২। ক্রিজে ফর্মে থাকা বিজয়-কোহলি। জয় আর ১২০ রান দূরে। সেখান থেকে কোথাকার কোন লিয়ঁ (যাকে পূর্বসূরি ব্যাটসম্যানরা পেলে ছিঁড়ে খেতেন) কে লায়ন বানিয়ে মাত্র ১৭ ওভারে ৬০ রানের মধ্যে ৮ উইকেট পরে গেল।

অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট, দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি; তা সত্বেও থেকে যেতে হলো ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে। কোথাও যেন ক্রিকেট বিধাতা তাকে মিলিয়ে দিলেন শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে, যিনি বার্বাডোজে, কেপ টাউন বা জোহানেসবার্গে একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। কঠিন পরিস্থিতিতে এক কুম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েও আটকাতে পারেননি পরাজয়ের গ্লানি কখনো সতীর্থদের ব্যর্থতায় তো কখনও চরম সময়ে ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে, যা তার অধিনায়কত্বের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক হয়ে থেকে গেছে।

৩.

চলুন পরাজয়ের গ্লানি থেকে বেরিয়ে একটু সিডনি হারবারের মুক্ত বাতাসে শ্বাস ভরে নেওয়া যাক। ২০০৪। চিন মিউজিক যখন বুমেরাং হয়ে ফিরে এলো। দেশের মাটিতে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের শেষদিন সিরিজ বাঁচানোর জন্য ব্যাটিং করছে। এ দৃশ্য বাস্তবে না দেখলে হয়তো সেটাকে আরব্য উপন্যাস বলেই মনে হতো। শেষবারের মতো স্টিভ ওয়াঘের ব্যাট অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট হার বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।

সঙ্গে থেকে গেল প্রথম ইনিংসে টেলএন্ডার দের দ্রুত আউট করতে না পারা আর পার্থিবের ঐতিহাসিক স্টাম্পিং মিস। জলে গেল শচীন, লক্ষণ, কুম্বলের লড়াই। সৌরভের ভারত সমস্ত বিষয়ে পুরো সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে টেক্কা দিয়েও সিরিজ পকেটে পুড়তে পারলো না হয়তো ক্রিকেট বিধাতা চাননি বলে, তিনি হয়তো চাননি স্টিভের বিদায়টা অসম্মানের হোক।

কিন্তু সম্মান দেখালো সিডনির প্রেস কনফারেন্স রুম। অতিথি দলের অধিনায়ক টেস্ট সিরিজের শেষ প্রেস কনফারেন্সে ঢুকতেই গর্বিত, অন্যকে হেয় করা, উন্নাসিক ও কদর্য মানিসকতার সমগ্র অস্ট্রেলীয় মিডিয়া উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল করতালিতে তাঁকে অভিবাদন করল। কারন? শেষ ১৫ বছরে নাকি কোনো বিদেশি দল অস্ট্রেলিয়াতে এসে এভাবে দাদাগিরি করে অস্ট্রেলিয়াকে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পারেনি। প্রায় ছয় ফুটিয়া বাঙালিটার জোহানেসবার্গের জ্বালা হয়তো কিছুটা মিটিয়ে দিয়েছিল সিডনির প্রেসরুম, টেস্ট না জিতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link