আশির ত্রৈরথ – জিকো, প্লাতিনি, ম্যারাডোনা

ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ বর্তমানে ইংলিশ লিগ এর মত জনপ্রিয় কিংবা লা লিগার মত শক্তিশালী না। বর্তমান সময় ইতালির এই লিগ খানিকটা পুনর্জন্ম দেখলেও ঠিক সেটা ইংল্যান্ড বা স্পেনের শীর্ষ লিগের রূপ নেয়নি। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন জনপ্রিয়তা আর শক্তির দিক থেকে সিরি ‘এ’ ছিল সবার উপরে। আশির দশকের শুরুতে সিরি ‘এ’ তে বিদেশি খেলোয়াড় কেনার নিয়ম চালু হবার পর থেকেই সিরি এ দলগুলা বিভিন্ন দেশের সেরা খেলোয়াড়দের কেনা শুরু করে। তার হাত ধরে সিরি ‘এ’ তে একে একে আসতে থাকে ফুটবলের কিছু উল্লেখযোগ্য নাম।

একবিংশ শতাব্দিতে এসে আমরা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দ্বৈরথ দেখছি। এই দুইজন অতিমানবের প্রতিযোগিতা দেখে অবাক হই, ফুটবলে এরকম কিছু এর আগে কেউ কখনো দেখেছে? সত্যি কথা বলতে, না! কিন্ত প্রতিযোগিতা না থাকলেও তুলনা ছিল একই প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে। সিরি ‘এ’ তে সেরকম একটা আবহ তৈরি হয় তিন মহারথীর আগমনে।

সে সময়ে ফুটবল ইতিহাসের তিনজন সেরা নাম্বার টেন খেলেছিলেন একই লিগে। জিকো, প্লাতিনি, ম্যারাডোনা সিরি ‘এ’ মাতিয়েছেন যথাক্রমে উদিনেস, জুভেন্টাস ও ন্যাপোলির জার্সি গায়ে। তিনটি ভিন্ন ফুটবল দর্শন থেকে এলেও মাঠে তাদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের প্রশংসা ছিল সর্বত্র। এমন তিনজন খেলোয়াড়ের একই লিগে খেলাটা ফুটবল প্রেমিদের জন্য স্বপ্নের মতোই ছিল। কিন্তু যখনই সেই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়, তখনই  তাদের নিয়ে তৈরি হয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।

আপনি যদি খেলোয়াড়ি দক্ষতার কথা মাথায় রাখেন, তাহলে এই তিনজন কে আলাদা করা কঠিন। মাঠে তাদের পজিশন একই – স্ট্রাইকারের পিছনে খেলেছেন, বল জোগান দিয়েছেন, নিজেরা গোল করেছেন। এই তিনজন প্লেমেকারের আরেকটি বড় মিল ছিল – তিনজনই ফ্রি-কিকে খুবই সফল ছিলেন। আর তিনজনই নিজ নিজ দেশ ও ক্লাবের হয়ে পড়েছেন দশ নাম্বার জার্সি। তিনজনকেই সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের সংক্ষিপ্ত তালিকায় পাওয়া যায়।

আসলে তারা কেমন খেলতেন? কেন তাদের মধ্যে তুলনা তৈরি হয়েছিল? এর আসল কারণ ছিল তাদের সেরা সময় প্রায় একই সময়ে সহাবস্থান করে। তিনজনের মধ্যে প্লাতিনিই সবার আগে আসেন সিরি এ-তে, তবে জিকোর আগমণেই শুরু হয় জিকো প্লাতিনি দ্বৈরথ।

  • হয় জিকো, নয় অস্ট্রিয়া

জিকো আর প্লাতিনির ক্যারিয়ার প্রায় একই সময়ে শুরু হয়। ১৯৯১ এ জাপানে যাওয়ার আগে জিকো তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেন। প্রায় ১৮ বছর টপ লেভেলে থাকা অবস্থায় খেলেছেন দুইটা ক্লাবে। ফ্লামেঙ্গোর দুই মেয়াদের মাঝে দুই মৌসুম খেলেছেন উদিনেসে।

১৯৮৩ সালে তার উদিনের ক্লাবে যোগ দেয়াটা ছিল নাটকীয়। ৮২ বিশ্বকাপে নজরকাড়া পারফর্মেন্স এর পর জিকোকে কেনার জন্য মুখিয়ে থাকে এসি মিলান, এএস রোমার মত ধনী  ক্লাবগুলো। কিন্তু তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ৪মিলিয়ন ডলারে যখন জিকোকে কেনার কথা ঘোষণা করে উদিনেসে তখন ঘটে যায় বিপত্তি। মিলান রোমার চাপে ইতালিয়ান ফুটবল এর এই ট্রান্সফারটা বন্ধ করে দেয়া কোন একটা অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে। আর তাতেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে উদিনেসের জনগণ।

‘ও জিকো, ও অস্ট্রিয়া’ অর্থাৎ ‘হয় জিকো, না হয় অস্ট্রিয়া’ স্লোগানে তারা একেবারে সরকারকে হুমকি দিয়ে বসে। ঘটনা হচ্ছে, উদিনেস শহরটা অস্ট্রিয়া-ইতালি বর্ডারের একটা শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটা ইতালির দখলে আসে। জিকোর ট্রান্সফারে তাদের উপর অনৈতিক নিষেধাজ্ঞাটাকে তাই তারা ফুটবলের চেয়েও রাজনৈতিকভাবে নেয়। তোপের মুখে কিং আর্থার ‘জিকো’ কে আটকানো গেলনা। তিনি আসলেন রাজার মতই।

উদিনেসে আসার আগে মাতিয়েছেন ফ্লামেঙ্গোর জার্সি গায়ে। সেখানেই তিনি নিজেকে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে তৈরি করেছেন। তবে ফ্লামেঙ্গোর হয়ে চূড়ান্ত সাফল্য আসে ১৯৮১ তে। সেবার ঘরোয়া লিগের পাশাপাশি কোপা লিবার্তোদোরেস জেতে ফ্লামেঙ্গো। এরপর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ফাইনালে দেখা হয় ইউরোপিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের। সেই ম্যাচে জিকোর অনবদ্য প্রদর্শনীতে ফ্লামেঙ্গো লিভারপুলকে হারায় ৩-০ গোলে। ৮২ বিশ্বকাপের আগে  এমন সাফল্য তাকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি এনে দেয়।

৮২ ব্রাজিলের নাম্বার টেন ছিলেন জিকো। সেবার ব্রাজিল অনাকাঙখিতভাবে বিদায় নিলেও জিকো তার ম্যাজিক দেখাতে ভুল করেননি। ৪ গোল, ৪ অ্যাসিস্টের মধ্যে ছিল অসাধারণ ফুটবল শৈলী। ফ্রি কিক, ওভারহেড কিক, লং রেঞ্জ থেকে গোল – সবই ছিল। তার তৈরি করা গোলগুলার মধ্যে সবচেয়ে মনে রাখার মত ছিল ইতালির বিপক্ষে সক্রেটিসের গোলটা। তিনজন আজ্জুরি ডিফেন্ডারকে দুর্দান্ত ক্রুইফ টার্নে মুহুর্তেই অকেজো করে সামনে এগোতে থাকা সক্রেটিজকে বাড়িয়ে দেন বল – এরপর সেটাকে গোলে পরিণত করতে ভুল করেননি সক্রেটিজ। এরকম আরো অনেক মুহুর্ত ছিল মনে রাখার মত। কিন্তু জিকো সেবার পারেনি সোনালি ট্রফিটা ছুঁতে। ৮৬ তেও না।

এই ৮২ এবং ৮৬ এর মধ্যেই উদিনেসে খেলেছেন দুই মৌসুম। ১৯৮৩ এর ওয়ার্ল্ড সকার প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার জিকো ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন – তাও সর্বোচ্চ স্কোরার প্লাতিনির চেয়ে চার ম্যাচ কম খেলেন। অর্থাৎ প্রথম মৌসুমেই জিকোর সাথে প্লাতিনির দ্বৈরথটা শুরু হয়।

জিকো খুব দ্রুতই ফ্যান ফেভারিটে পরিণত হন। তার ফ্রিকিক নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়ে যায় ইতালিয়ান মিডিয়ায়। তবে দুর্দান্ত সময় কাটানোর পরও জিকো দুই মৌসুমের বেশি ছিলেননা ক্লাবের এম্বিশন কম থাকার কারণে। পরের মৌসুমে জিকো প্লাতিনির দ্বৈরথ রূপ নেয় ম্যারাডোনা-জিকো- প্লাতিনি ত্রৈরথে।

  • তুরিনের রাজা মিশেল প্লাতিনি

জিকোর সময়টা সিরি ‘এ’ তে কম হলেও প্লাতিনি তার সেরা সময়ের প্রায় পুরোটাই কাটান জুভেন্টাসে। ১৯৮২ তে জুভেন্টাসে যোগ দেয়ার আগে প্লাতিনি খেলেছেন দুইটা ফ্রেঞ্চ ক্লাবে। তার শৈশবের ক্লাব ন্যান্সিতে খেলেছেন প্রায় সাত বছর। ১৯৭২ এ তার সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু হলেও ১৯৭৪ থেকেই প্লাতিনি তার সেরাটা দিতে শুরু করে।

ন্যান্সিতে ১৮১ লিগ ম্যাচে করেন ৯৮ গোল। তবে ন্যান্সিতে প্লাতিনির সেরা সাফল্য আসে ১৯৭৮ ফ্রেঞ্চ কাপের ফাইনালে নিসে কে হারিয়ে। প্লাতিনির মত খেলোয়াড়কে আসলে মধ্যম সারির দলে মানায় না। সে সময়ের ফ্রেঞ্চ লিগের সবচেয়ে সফল দল সেন্ট এটিয়েনে প্লাতিনিকে কিনে নেয় ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে। সেখানে লিগ ওয়ান জেতেন  প্লাতিনি।

১৯৮২ তে তুরিনে আসার আগে খেলেছেন দুইটা বিশ্বকাপ। ৭৮ বিশ্বকাপে তার গোলেই ১৯৬৬ এর পর বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই হয় ফ্রান্স। সেবার গ্রুপ থেকে বিদায় নিলেও ৮২ তে সেমি ফাইনাল খেলেন প্লাতিনি। জার্মানির সাথে হেরে বিদায়ের পর আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি বুঝতাম আমরা কতটা শক্তিশালি ছিলাম তাহলে কখনোই ম্যাচটা হারতাম না ।’ তার এই কথার প্রতিফলন আসে ১৯৮৪ ইউরোতে। ফ্রান্সের মিডফিল্ডের ম্যাজিক স্কোয়ারে ভর করে সেবার ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্স। আর প্লাতিনি একাই করেন ৯ গোল।

জুভেন্টাসে প্লাতিনি খেলেছেন পাঁচ বছর। সেখানে তিনবার ব্যালন ডি অর জিতেন প্লাতিনি। জুভেন্টাসের ৮৪ আর ৮৬ এর সিরি ‘এ’ জয়ের মূল নায়ক ছিলেন প্লাতিনি। তার একমাত্র গোলে ১৯৮৫ ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে লিভারপুলকে হারায় জুভেন্টাস। সিরি এ তে থাকা অবস্থায় ক্লাবের হয়ে সম্ভব সব শিরোপাই জিতে নেন। সেখানে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তার প্রতিযোগীতা ছিল জিকোর সাথে, পরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা।

  • এল পাইব দে ওরো – ম্যারাডোনা

পুরো ক্যারিয়ারে বিশ্বের বড় ক্লাবগুলোর সবচেয়ে আরাধ্য খেলোয়াড় ছিলেন ম্যারাডোনা। সেই সুবাদে ট্রান্সফার ভেঙ্গেছেন দুইবার যেটা এর আগে কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। বোকা জুনিয়র, বার্সেলোনা, ন্যাপোলি, সেভিয়ার মত নামী ক্লাবগুলোতে কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময়, এর মধ্যে সিরি ‘এ’ তেই ম্যারাডোনা নিজেকে ইতিহাসের সেরা একজন ফুটবলারে পরিণত করেন।

ফুটবলের বিস্ময়বালক দিয়েগো, সতেরোতেই খেলতে পারতেন বিশ্বকাপ – কিন্তু আর্জেন্টাইন কোচ মেনোত্তি ১৯৭৮ বিশ্বকাপের জন্য তাকে বিবেচনায় আনলেননা। উপেক্ষার জবাব আসে পরের বছর – যুব বিশ্বকাপ তো জিতেছেন, নিজেও জিতে নেন গোল্ডেন বল। এই অর্জন তাকে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র থেকে নিয়ে আসে বোকা জুনিয়রে। সেখানে একমাত্র দলীয় অর্জন আসে ১৯৮১ তে লিগ জিতে।

এরপরের বছর বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে তৈরি করলেন। অবশ্য স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আগেই ম্যারাডোনার বার্সেলোনা ট্রান্সফার নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। বিশ্বকাপে বার্সা সমর্থকদের সুযোগ হয় তাদের ভবিষ্যত তারকাকে দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ম্যারাডোনা সেই বিশ্বকাপে নিজের সেরাটা দেখাতে সমর্থ হন নি। দ্বিতীয় রাউন্ডে জিকোর ব্রাজিল এবং চ্যাম্পিয়ন ইতালির কাছে হেরে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।

সেটা অবশ্য ম্যারাডোনার বার্সা যাত্রাকে ঠেকাতে পারেনি। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে কোপা দেল রে আর সুপার কাপ জেতান দলকে। কিন্তু এর আগে ম্যারাডোনা ইতিহাস সৃষ্টি করেন এল ক্লাসিকোতে। মাদ্রিদ গোলকিপার অগাস্টিনকে ড্রিবল করে পরাস্ত করে খালি গোল পেয়ে যান। গোলা না করে দিয়েগো বল নিয়ে থেমে যান, তাকে থামাতে দৌড়ে আসে হুয়ান হোসে যার স্লাইড ট্যাকেলকে সাইডস্টেপিং করে বলকে জালে পাঠিয়ে দেন।

এরপর যেটা ঘটল সেটা বার্নাব্যুতে আগে কখনো ঘটেনি। ম্যারাডোনার অনবদ্য প্রদর্শনিকে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সম্মান দেখায় মাদ্রিদ ফ্যানরা। এরপর শুধু রোনালদিনহো আর ইনিয়েস্তা এই সম্মান পান। এতটুক পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এরপর ইনজুরি আর শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা তার বার্সা ক্যারিয়ারকে লম্বা করতে দেয়নি। আর তখনই তারকা ঠাসা সিরি এ তে তাকে কেনার জন্য লাইন ধরে ইতালিয়ান ক্লাবগুলো।

জিকোর মত ম্যারাডোনাও বেছে নেন মধ্য সারির ক্লাব। ন্যাপোলি, যাদের কখনো স্কুডেতো জেতা হয়নি। আগের মৌসুমেই ন্যাপোলি রেলিগেশন এড়ায় কোনভাবে – আর ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে তারা ভেঙ্গে দেয় ট্রান্সফার রেকর্ড। প্রায় ৭৫০০০ দর্শক ম্যারাডোনাকে বরণ করে নেয়, ন্যাপোলিটানদের বিশ্বাস ছিল যে ম্যারাডোনা তাদের ত্রানকর্তা হিসেবে এসেছে।

এখন মিউনিসিপাল এর কোন সমস্যাই আর সমস্যা না। সিরি আ তে কখনো দক্ষিণ ইতালির ক্লাবগুলো ডমিনেট করতে পারেনি। কিন্তু ম্যারাডোনার ছোঁয়ায় পুরো ন্যাপলি যেন সোনাতে পরিণত হলো। ন্যাপোলিটানদের বিলাসবহুল গাড়ি বাড়ি ছিলনা, কিন্তু তাদের ম্যারাডোনা ছিল – এটাই তাদের গর্বের জায়গা।

ম্যারাডোনা আসার পরের মৌসুমেই অল্পের জন্য লিগ হারায় ন্যাপোলি। কিন্তু ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে আর আঁটকে রাখা যায়নি ন্যাপোলিকে। জুভেন্টাসের তাঁবুতে আঘাত হেনে প্রথম বারের মত স্কুডেত্ত জিতে নেয় ন্যাপোলি। অবশ্য ওই মৌসুমের আগেই ম্যারাডোনা তার পীকে পৌছে যায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। আগের বিশ্বকাপে যেমন জিকো সেরা ফর্মে ছিলেন এবার সে জায়গায় ছিলেন ম্যারাডোনা।

সেখানে ম্যারাডোনা একাই করেন পাঁচ গোল, পাঁচ এসিস্ট। কিন্তু এই তথ্য যথেষ্ট না ম্যারাডোনাকে তুলে ধরার জন্য। সেবার ম্যারাডোনা ছিল ফুটবল মাঠে বিচরন করা সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে কুশলী, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে কার্যকরী খেলোয়াড়টা। ‘বেস্ট এভার’ ফুটবলারের সেরা গোলটাও আসে সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে। ফিফার ভোটে নির্বাচিত হওয়া গত শতাব্দীর সেরা গোল করার পথে ম্যারাডোনা ড্রিবলে পরাস্ত করেন গুনে গুনে ছয়জনকে।

নিজের অর্ধে বল পেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ টার্নে গিয়ার উপরে তোলেন ম্যারাডোনা। এরপর প্লে’বেকে শুরু হয় ট্যাঙ্গোর তালের সুর। টেম্পোটাকে অ্যাডজাস্ট করে নিলেন ম্যারাডোনা। মাঠের সবার গতিকে স্লো করে দিলেন। সিনেমার যোদ্ধারা যেমন সামনে আসতে থাকা শত্রু পক্ষের যোদ্ধাকে কাটতে কাটতে এগিয়ে যায় ম্যারাডোনাও এগিয়ে গেলেন সেভাবে। বল যখন জালে ঢুকল তখন গানটা বন্ধ করলেন। টেম্পোকে আগের জায়গায় এনে দিলেন। এরপর সতীর্থদের সাথে যোগ দিলেন উদযাপনে। সেবার বিশ্বকাপ জিতে নিজেকে নিয়ে যান অসীমের সীমানায়।

১৯৮৬-৮৭ এর পর ন্যাপোলি আবারো লিগ জিতে ১৯৮৯-৯০ তে। বিশ্বকাপের বছরে লিগ জিতে আবারো আর্জেন্টিনাকে উঠান ফাইনালে। এবার ৮৬ এর ভার্সনটা না থাকলেও যেভাবে খেলেছেন শক্তিশালী ব্রাজিল আর ইতালির বিরুদ্ধে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন। ইতালির সাথে ম্যাচটা নিয়ে মাঠের বাইরে চলছিল নাটক কারণ ম্যাচটা ছিল ন্যাপোলির স্টেডিয়ামে। দক্ষিণ ইতালিকে মধ্য আর উত্তর ইতালির লোকজন ইতালিয়ানই মনে করতোনা। তাই একটা সন্দেহ ছিল যে এই ম্যাচে না আবার ইতালির পরিবর্তে আর্জেন্টিনার পক্ষে সমর্থন দেয় ন্যাপোলিবাসী। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেদিন কোন আনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেনি। যদিও তা ইতালির বিদায় এড়াতে পারেনি। ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারে জার্মানির কাছে।

এরপর ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারটা ক্রমশ অন্ধকারের দিকে যেতে থাকে। নিষিদ্ধ ড্রাগে আসক্ত হয়ে যান। ১৯৯১ সালে ড্রাগ পজিটিভ প্রমাণিত হওয়ায় ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হোন যেটা তার ন্যাপোলি ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দেয়। বিদায়টা হতাশাজনক হলেও ন্যাপোলি পরবর্তিতে তার সম্মানার্থে ১০ নাম্বার জার্সিটা উঠিয়ে রাখে।

  • ত্রৈধবিন্দু

জিকো আর প্লাতিনির ক্যারিয়ার ম্যারাডোনার একটু আগে শুরু হলেও ঘটনাক্রমে তিনজনের সেরা ফর্ম প্রায় একই সময়ে এসে মিলিত হয়। জিকো যে সময়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা খুব একটা ইউরোপে আসতেন না, এজন্য জিকোকে আরো বেশি সময় ইউরোপে দেখার সুযোগটা হয়নাই। তবে এটা ঠিক যে সত্তর দশকের শেষ দিকে আর আশির শুরুতে জিকোকে বিশ্বের সেরা ফুটবলার ভাবা হতো। জিকো ৮২ বিশ্বকাপ জিতলে হয়ত আজকে তার নাম পেলে ম্যারাডোনার সাথে উচ্চারিত হতো। একই কথা প্লাতিনির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, ৮২ বা ৮৬ বিশ্বকাপ জিতলে তার অবস্থানও আরো উপরে থাকতো।

৮২ সালের বিশ্বকাপে জিকোর চার গোল, চার অ্যাসিস্টের বিপরীতে ৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ছিল পাঁচ গোল, পাঁচ এসিস্ট। অন্যদিকে, বিশ্বকাপে এককভাবে প্লাতিনির পরিসংখ্যান এই দু’জনের মতো না হলেও ৮৪ ইউরোতে তার নেতৃত্বে এবং একক নৈপূণ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্স। ওই টুর্নামেন্টে প্লাতিনি একাই নয় গোল করেন। এর আগে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক ফুটবলে কিছুই জিতেনি। তাই এটা বিশেষ কিছুই ছিল না। দিনশেষে এই তিনজনই আশির দশকেই তাদের জাতীয় দলে নিজের সেরাটা দিয়েছেন।

ম্যারাডোনা আর জিকোর মধ্যে ব্যাক্তিগত দ্বৈরথ শুরু হয় দক্ষিণ আমেরিকা থেকেই। তবে এই দুইজনের দ্বৈরথে ম্যারাডোনা কখনোই জিকোর বিপক্ষে জয় নিয়ে ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে জুভেন্টাসের হয়ে প্লাতিনি জিকোর উদিনেসের সাথে প্রায় সব ম্যাচেই জয় নিয়ে ফেরেন। তবে প্লেয়ার হিসেবে দুজনের কদরই সমান ছিল লিগে। এই দুজনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচটি ছিল ৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নেমে জিকোর ট্রেডমার্ক থ্রুবল সতীর্থকে খোঁজে নিলেও তাকে ফাউল করায় পেনাল্টি পায় ব্রাজিল। কিন্তু জিকোর দুর্ভাগ্য, পেনাল্টিকে গোলে পরিণত করতে ব্যার্থ হন। পরে পেনাল্টি শুটাউটে ম্যাচ জিতে নেয় ফ্রান্স।

এদিকে ম্যারাডোনা আর প্লাতিনির সিরি ‘এ’ দ্বৈরথে তাদের স্ট্যান্ডার্ড আলাদা করা কঠিন। প্লাতিনি লিগের সেরা দল নিয়ে সবকিছু জিতলেও মিডটেবিলের ক্লাব ন্যাপোলিকে নিয়ে ম্যারাডোনার অর্জন তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। পরিসংখ্যানে প্লাতিনি ম্যারাডোনার চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ম্যারাডোনাকেই বেটার প্লেয়ার হসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু নিজ নিজ দলের জন্য দুজনেই ছিলেন সাফল্যের মূল কারিগর।

১৯৮৪-৮৫ ছিল একমাত্র মৌসুম যখন এই তিন ফুটবল গ্রেট একই লিগে খেলেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ওই মৌসুমে শক্তিশালী জুভেন্তাসকে টপকে অনাকাঙখিত ভাবে লিগ জিতে হেলাস ভেরোনা। অবশ্য ব্যাক্তিগত নৈপূণ্যে তারা প্লাতিনি এগিয়ে ছিল বাকি দুজনের তুলনায়। জুভেন্তাস এর হয়ে প্লাতিনি হারায় ম্যারাডোনার ন্যাপোলি আর জিকোর উদিনেসেকে। অন্যদিকে সেবার ন্যাপোলি আর উদিনেসে্র  ম্যাচে জিকো আর ম্যারাডোনাকে আলাদা করা সম্ভব হয়নি। সিরি এ সাফল্যের দিক থেকে জিকো পিছিয়ে পড়লেও ৩১ বছর বয়সে খেলতে এসে উদিনেসের কিংবদন্তি হিসেবেই বিদায় নেন ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেন। অন্যদিকে প্লাতিনি আর ম্যারাডোনা দুজনেই নিজেদের সিরি ‘এ’ কিংবদন্তি হিসেবে তৈরি করেন।

সিরি ‘এ’ সাফল্যে এগিয়ে থাকলেও দিনশেষে প্রতিভা আর বিশ্বকাপ সাফল্য ম্যারাডোনাকে প্লাতিনির চেয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্যদিকে ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবলের পতাকা নিয়ে চলা জিকো তাঁর অসাধারণ ফুটবল শৈলিতেই বেঁচে আছেন দর্শকদের হৃদয়ে। যারা আশির দশকে ফুটবলের ফলোয়ার ছিলেন তাদের জন্য এই ‘ত্রৈরথ’ এখন আবেগের উপলক্ষ্য নিয়ে আসে। তাদের মুখ থেকে মনের অজান্তেই বের হয়ে আসে, ‘আমাদের সময়ে জিকো, প্লাতিনি, ম্যারাডোনারা ছিল।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link