শচীন ও নবজাত ভারতের নব্বই

শারজাহ, ১৯৯৭! ডিসেম্বরেই এখানে চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টে নিজেদের সবকটি ম্যাচ হেরে রাতের অন্ধকারে মাথা নীচু করে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। অধিনায়ক হিসাবে শচীনের প্রথম পর্বের শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছিল এটি। প্রথম ম্যাচে মিডল অর্ডারে রান পেলেও পরের দুটি ম্যাচে ব্যর্থ হন শচীন। সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন দুরন্ত ফর্মে, সিধুও মোটামুটি রান পান। কিন্তু আজ়হারউদ্দীন সমেত বাকী মিডল অর্ডারের দায়সারা ও ভঙ্গুর ব্যাটিং, আর শোচনীয় বোলিং পারফরম্যান্স অধিনায়ক শচীনের তৎকালীন যাত্রা সমাপ্ত করতে বাধ্য করে।

শারজাহ, ১৯৯৮! এপ্রিলে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে খেলতে আসার আগে ভারতীয় ক্রিকেটে ঘটে গিয়েছে অনেক পরিবর্তন। অধিনায়কের আসনে আবার অধিষ্ঠিত হয়েছেন “ভৎসৃত” হওয়া আজ়হারউদ্দীন। চাপ সরিয়ে শচীনের ব্যাটে দেখা গিয়েছে তান্ডব। তাঁর ও সৌরভের যথোপযুক্ত সঙ্গতে রেকর্ড রান তাড়া করে ভারত ঢাকার ফাইনালে হারিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে। তারপর দেশের মাটিতে তৎকালীন টেস্টসেরা মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ব রেখে জিতেছে টেস্ট সিরিজ়।

শেন ওয়ার্নকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন শচীন, এবং বাকী ভারতীয় ব্যাটাররাও। ছন্দপতন তারপরেই। দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ়ের গ্রুপের সবকটি ম্যাচে জিতেও অস্ট্রেলিয়ার একদিনের দলের অধিনায়ক স্টিভ ওয়ার উজ্জীবিত নেতৃত্বের সামনে দিল্লীর ফাইনালে হার মানে ভারত। তারপর এই দুই দলই আসে শারজাহর ত্রিদেশীয় কোকাকোলা কাপে খেলতে। সেবার ঐ টুর্নামেন্টের তৃতীয় দল ছিল স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বাধীন নিউজ়িল্যান্ড!!

প্রথম ম্যাচেই নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে চরম স্লো পিচে সৌরভ সেঞ্চুরী করেন। এছাড়া শচীন (৪০) ও আজ়হারউদ্দীন (৩১) বাদে ভারতের তেমন কেউ রান না পেলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ অজিত আগরকরের আগ্রাসী বোলিং পারফরম্যান্সে ভর করে ভারত ১৫ রানে হারিয়ে দেয় নিউজ়িল্যান্ডকে। এই ম্যাচেই একদিনের আন্তর্জাতিকে সফল অভিষেক ঘটে ভারতের তরুণ প্রতিভাবান অফস্পিনার হরভজন সিংহের!

দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হারলেও কাসপ্রোইচ-ফ্লেমিং সমেত ক্যাঙারু বোলারদের ঠেঙিয়ে ৭২ বলে ৮০ করা শচীন হন ম্যাচের সেরা। এটা নিয়ে ক্রিকেট ইয়ার বুক বিশেষ কলাম বের করেছিল। তাতে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘হেরে যাওয়া দলের কোনও খেলোয়াড় চট করে ম্যাচের সেরা হন না। হলে বোঝা উচিত ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্সের প্রভাব ঠিক কতখানি ছিল!’

তৃতীয় ম্যাচেও ভারত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ম্যাচ হারে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে। শচীন ও সৌরভ ছাড়া কেউ ৩০+ রানের গন্ডীও পেরোন নি। ভারতে টেস্ট সিরিজ়ে ফর্মে থাকা ভিভিএস লক্ষ্মণকে এখানে আনা হয়েছিল একদিনের আন্তর্জাতিকে স্লো খেলতে থাকা রাহুল দ্রাবিড়ের পরিবর্ত হিসাবে। কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়েও স্লো খেলাতে থাকায় সঠিক টিম কম্বিনেশনের খোঁজে অধিনায়ক আজ়হারউদ্দীনের কপালে চিন্তার রেখাগুলো বেড়েই চলে।

ইতিমধ্যে স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ানরা ভারতের উদ্দেশ্যে ছোট বড় কথাবার্তা বলেই চললেও স্বয়ং স্টিভ মিডিয়াতে বলেন, ‘ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের শক্তি সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সচেতন। একা শচীনই পারে ওদের স্কোরকে যেকোনও কারোর ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে। এখন তো গাঙ্গুলীকে পেয়ে ভারতের ওপেনিংও অনেক জমাট লাগছে। সঙ্গে আজ়হার আর জাডেজা তো রয়েইছে। আমরা সবাইকে নিয়েই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখছি!’

স্টিভের কথার মধ্যে বিপক্ষকে নিয়ে সম্মান থাকলেও নিজেদের নিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছিল আত্মবিশ্বাস!

এগুলো সব প্রাক মরুঝড় কাহিনী। যেভাবে ভাঙা দল নিয়ে অস্থায়ী অধিনায়ক রাহানের নেতৃত্বে ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে টেস্ট সিরিজ় জয়ী ভারতীয় দলের গৌরবগাথা গাওয়া হয় বা হচ্ছে, ধারে ও ভারে এতখানি না হলেও আজ থেকে ২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোকাকোলা কাপ এপ্রিল ১৯৯৮ তে ভারতীয় দলের অত্যাশ্চর্য জয়ের কাহিনীও ততখানিই কৌতুহলদ্দীপক। কারণ একমাত্র একজন ভারতীয়ই শেষ অবধি এই বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে রেখেছিলেন যে গত ডিসেম্বরে ঘটা দলীয় বিপর্যয় আর তার জেরে অধিনায়কত্ব হারাবার গ্লানিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার মোক্ষম সুযোগ এটাই। সঙ্গে দেশের মাটিতে ফাইনাল হারার জ্বালা তো ছিলই!

ভারতীয় দলটা তখন কি রকম ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল জানেন? একদিনের ম্যাচে পুরো দলের ব্যাটিংএর সিংহভাগ রানই আসত দুই ওপেনারের ব্যাটে, এবং খুব কমদিনই যেত যে শচীন রান পাননি আর সৌরভ বড় রান করেছেন বা উল্টোটাও। কারন রান পেলেও সৌরভ তখনও ওপেনার হিসাবে তৈরী হচ্ছেন। মিডল অর্ডারে চরম অধারাবাহিক আজ়হারউদ্দীন, ‘ভারতের বেভান’ অজয় জাডেজা, ‘শ্রমিক’ রবিন (সেই সিরিজ়ে ছিলেন না যদিও), ‘সন্দেহজনক’ নয়ন মোঙ্গিয়া, আনকোরা হৃষিকেশ কানিতকার আর ফুরিয়ে আসতে থাকা ক্লান্ত নভজ্যোৎ সিংহ সিধু! লক্ষ্মণকে আনা হয় দ্রাবিড়ের বদলে, কিন্তু আগেই বলেছি তিনি চরম হতাশ করেন নির্বাচকদের!

দলে কানিতকার ছাড়া একটাও প্রকৃত অলরাউন্ডার ছিলেন না। বোলিংয়ের অবস্থাও তথৈবচ। শ্রীনাথ চোটের জন্য বছরের মধ্যে গড়ে ছয়মাস বিশ্রামে থাকতেন। তাঁর দীর্ঘদিনের বোলিং পার্টনার প্রসাদ উইকেট নেওয়াতে ধারাবাহিক ছিলেন না। সেই টুর্নামেন্টে ভারতের পেস বোলিং মূলত: সামলাচ্ছিলেন ঠিক তার আগের সিরিজ়েই অভিষেক করা তরুণ অজিত আগরকার (যিনিও দ্বিতীয় ম্যাচে চোট পেয়ে ছিটকে যান, ফেরেন একেবারে ফাইনালে) আর হরবিন্দার সিংহ! স্পিনার হিসাবে ছিলেন অনিল কুম্বলে, ঐ টুর্নামেন্টেই অভিষেক করা হরভজন আর বাঁহাতি রাহুল সাংভি! এরপর আশা করব আর কোনও মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন!

এরপর যাবতীয় স্বঘোষিত বা নঘোষিত বিশেষজ্ঞদের মতামতকে দূরে রেখে, পোস্টট্রুথের গ্রাফ এক্সেলের কুৎসাকে সজোরে সরিয়ে, আর এখনকার পিকনিকসম লীগ ক্রিকেটের মায়াবী আলো থেকে ক্ষণিকের জন্য নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে মহাকাশের অসীমের আঁধারে চোখ সইয়ে নিতে নিতে চিন্তা করে দেখুন তো – এই টিম নিয়ে, এই অধিনায়কের অধীনে খেলে, এই বোলারদের দেওয়া পাহাড়ের মত রান তাড়া করতে করতে তার আগে কটা ব্যাটার পরপর দুই চাপের ম্যাচে ১৪৩ আর ১৩৪ করে কাপ নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিল সেই সময়ে?

মানুষটাকে পছন্দ নাই হতে পারে – অপছন্দ হতে পারে তার ব্যাটিং, তার সিদ্ধান্ত বা অন্য কিছু। কিন্তু যেকোনও শিল্পীর সৃষ্টি অনুভব বা উপভোগ করার সময় আমরা যেমন এটা নিয়ে বিশ্লেষণে মাতি না যে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বহুগামী/গামিনী কি না, তেমনই এটাও ভেবে দেখবার সময় এসেছে যে আমরা ভারতীয়রা আদর্শগতভাবে ‘মানুষ’ শচীন তেন্ডুলকারের ব্যবচ্ছেদ করব, না কি ২৪ বছর ধরে মাঠে ঘামরক্ত ঝরানো ক্রিকেটার শচীনের মূল্যায়ন (অথবা কুৎসা)!

একটাই কথা খুব বলতে ইচ্ছা করছে, ‘সুনীল আর কপিলের পর আর সৌরভ-লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়-শেহবাগ-যুবরাজ-কোহলি-রোহিত-ধোনী এই পর্বটার আগে বা সঙ্গে চলে নিজের সঙ্গেই ভারতীয় ক্রিকেটের বেঞ্চমার্কটা কোথায় উঁচু করে দিয়েছেন আপনি, যেখানে এতবছর পরেও কোহলী-রোহিতকে আজ অবধি এভারেস্টসম আপনাকে তাড়া করতে হচ্ছে! অবসরের ১০ বছর পরেও আপনাকে নিয়ে কত গবেষণা, কত নতুন তথ্যের আমদানী..এত গর্ব রাখছেন কোথায়?’

স্বর্গে লারউড আর ভোসের পাশে বসে, চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সস্ত্রীক স্যার ডন নিশ্চিতভাবে কার্ডাসকে বলছেন, ১দেখেছ নেভিল, আমি কি বলেছিলাম? এই ছেলেটার ব্যাটিং একদম আমার যুবা বয়সের মত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link