‘২৩ বিশ্বকাপের অজি-প্রোটিয়া সেমি ‘৯৯ এর স্মৃতিচারণ

ঠিক যেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রতিচ্ছবি। সেবারের অজি-প্রোটিয়া সেমির মহারণের রূপায়ণ যেন ঘটলো এবার কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। কাকতালীয়ভাবে স্কোরকার্ডটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রায় সাদৃশ্যতায়। বার্মিংহামে সেবার রোমাঞ্চ গড়িয়েছিল ২১৩ রানে। আর এবার ইডেনে তুমুল উত্তেজনা ভর করেছিল সেই ২১২ রানকে কেন্দ্র করে। তবে একটুও বৈপরীত্য নেই অস্ট্রেলিয়ার বিজয়গাঁথা আর দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্য বিপর্যয়ের গল্পে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের মতোই এবারও সেমিতেই বিশ্বকাপ স্বপ্ন থেমে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার। আর সকল রোমাঞ্চকর যাত্রা পেরিয়ে ফাইনালের সিঁড়িতে পা রাখলো অস্ট্রেলিয়া। ঠিক ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মতোই, সেই একই প্রতিপক্ষকে আক্ষেপে ভাসিয়ে, ক্যাচ মিসের আক্ষেপে পুড়িয়ে।

‘বাঁছা, তুমি তো বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে’। বিশ্বকাপখ্যাত এই উক্তিটির কথা কারই বা অজানা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্টিভ ওয়াহর ক্যাচ ফেলে দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে এক প্রকার ‘বাঁচিয়ে’ দিয়েছিলেন হার্শেল গিবস। জীবন ফিরে পাওয়া স্টিভ ওয়াহ ঠিক তখন এই কথাটিই গিবসকে বলেছিলেন।

কেননা, সুপার সিক্সের সে ম্যাচটি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল অস্ট্রেলিয়ার জন্য। কারণ হারলেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হতো তাদের। আর সে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৭২ রানের লক্ষ্যে শুরুতেই চাপে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে ছিলেন স্টিভ ওয়াহ। কিন্তু ৩১তম ওভারেই ঘটে সেই কাণ্ড।

ল্যান্স ক্লুজনারের বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন ওয়াহ। ক্যাচটা তালুবন্দিও করেছিলেন গিবস। কিন্তু ভালো মতো না ধরেই তাড়াহুড়ো করে উল্লাস করতে গিয়ে বল মাটিতে ফেলে দেন তিনি। আর সেই ক্যাচ মিসেরই বড় মাশুল দিতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। স্টিভ ওয়াহর ব্যাটে চড়ে ৫ উইকেটের জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। তবে স্টিভ ওয়াহ’র সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিকার অর্থেই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল।

সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আবারো মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। ম্যাচটি টাই হয়। আর টাই হওয়ার জন্য সুপার সিক্সে সেই প্রাপ্ত জয়ের কারণেই ফাইনালে উঠে যায় অস্ট্রেলিয়া। আর গিবসের সেই ক্যাচ মিসেই কার্যত বিশ্বকাপটাই হাত ছাড়া হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের তেমন কিছুরই একটা পুনরাবৃত্তি ঘটলো এবারের বিশ্বকাপেও। এবার অবশ্য টাই হয় নি। কিন্তু গিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দু’বার ক্যাচ মিস করে কুইন্টন ডি কক এবার প্রোটিয়াদের গল্পে যোগ করলেন আক্ষেপ, বেদনা বিধুর এক অধ্যায়। বলাই বাহুল্য, সেদিনের গিবসের মতো এবারও বোধহয় বিশ্বকাপটা হাত থেকে ফেলে দিলেন ডি কক।

আবারো ফেরা যাক, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের দৃশ্যপটে। শন পোলকের বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া সেদিন অলআউট হয়ে গিয়েছিলে মাত্র ২১৩ রানেই। কিন্তু এই রান তাড়া করতে গিয়েই দিশেহারা হয়ে পড়ে প্রোটিয়ারা। তবে ল্যান্স ক্লুজনার  এক প্রান্ত আগলে রেখে ঠিকই জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ম্যাচ জয়ের দোরগড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। দলও প্রায় ফাইনালে ওঠার আগাম উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

কিন্তু সেই গল্পটা অসম্পূর্ণ রেখে যান ক্লুজনার। গড়বড় করে ফেললেন শেষ ওভারে। চার বলে দরকার মাত্র এক রান। স্ট্রাইকে ক্লুজনারই। একটি রান নিতে গিয়েই দেখলেন তাঁর সর্বশেষ সঙ্গী অ্যালান ডোনাল্ড তাঁর সিঙ্গেলে সাড়ায় দেননি। মার্ক ওয়াহ বল ধরে তা ছুড়ে দেন বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের কাছে।

ততক্ষণে ক্লুজনার আর ডোনাল্ড এক প্রান্তে আক্ষেপ আর দুঃখ বিলাপ করছেন। বোলার ফ্লেমিং আস্তে করে বল উইকেটকিপার অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে দিলে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের শেষ চার থেকে বিদায় নিশ্চিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। ম্যাচটি যদিও টাই হয়েছিল। কিন্তু হেড টু হেডে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ফাইনালে।

২০২৩ বিশ্বকাপের সেমি অবশ্য এতটা আক্ষেপে শেষ হয়নি। তবে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ছুটতে থাকা প্রোটিয়ারা হঠাতই ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পায়। আর তাতে জেগে উঠেছিল ৯৯ বিশ্বকাপের প্রতিশোধের মঞ্চও। কিন্তু প্রোটিয়াদের ভাগ্য বিপর্যয়ের স্রোত যেন এখনও বহমান। ২১৪ রানের লক্ষ্যে ১০৬ রানে ২ উইকেট থাকা অজিদের এরপর ৮৭ রানের মাঝে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচটা জমিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

কিন্তু শেষমেশ রক্ষা হয়নি। ডি ককের ক্যাচ মিসে আক্ষেপ সঙ্গী হয়েছে। প্রথমে ব্যাটিং করে ২১৩ রানেই আটকে যাওয়ায় আক্ষেপে পুড়তে হয়েছে। আর দিনশেষে হারের তিক্ততা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে। একদম ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মতোই। বিষণ্ন চোখে, ভারাক্রান্ত মনে আবারো বিশ্বকাপের সেমি থেকে প্রস্থান প্রোটিয়াদের।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link