পাখির পুত্র ক্যানিজিয়া

ঘাড় পর্যন্ত বেয়ে নামা সোনালী চুল, টানা টানা চোখ, খাড়া নাক; ক্যামেরার সামনে প্রাণখোলা হাসি।

এই রূপ দেখে তাঁকে ‘রকস্টার’ বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্তত ফুটবলার বলে মেনে নেওয়াটা তো ঠিক না। না, তিনি তো সাধারণ ফুটবলার ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাখির সন্তান; সন অব বার্ড।

হ্যাঁ, ক্লদিও পল ক্যানিজিয়া। আর্জেন্টিনার এক সময়ের সুপার স্টার, ডিয়েগো ম্যারাডোনার ভাল-মন্দ সকল কাজের সঙ্গী, ফুটবলের এক নস্টালজিয়া ক্লদিও ক্যানিজিয়া।

আর্জেন্টিনার সাবেক এই উইঙ্গার এবং ফরওয়ার্ডের বড় পরিচিতি ছিল তার গতি। জাতীয় দলে খেলেছেনে ম্যারাডোনার সাথে; বলা চলে ম্যারাডোনার ডান হাত ছিলেন। ক্যানিজিয়া শুধুমাত্র একজন ফুটবলারই ছিলেন না। ছিলেন একজন অ্যাথলেটও। অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রাদেশিক পর্যায়ের অ্যাথলেটিক্স টুর্নামেন্টে।

অ্যাথলেটিক্সে জড়িত থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার গতি ছিল অসম্ভব ভাল। তিনি ফুটবলে তার গতির জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি শুধু একজন ফরওয়ার্ডই ছিলেন না, ছিলেন একজন প্লে-মেকারও। গোল করা এবং গোল করানো দুই কাজেই দক্ষতার প্রমান দিয়েছিলেন ক্যানিজিয়া।

অনেক কঠিন মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হওয়ার পরও ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মায়ের আত্মহত্যা তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। কোকেন সেবনের দায়ে নিষিদ্ধ হয়ে ১৩ মাস ফুটবল থেকে বাইরে ছিলেন ক্যানিজিয়া। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আবারো নিজেকে চেনাতে পেরেছিলেন তিনি।

ক্যানিজিয়ার ফুটবলের হাতে খড়ি রিভারপ্লেটের ফুটবল একাডেমিতে। পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন রিভারপ্লেটের হয়ে। ক্যারিয়ারে খেলেছিলেন রিভারপ্লেটের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বোকা জুনিয়র্সেও। রিভারপ্লেটের প্যারফর্মেন্স টেনে নিয়ে যান হেলাস ভেরোনা, আটলান্টা, রোমার মত ক্লাবে। তবে ক্লাব নয়, বিশ্বকাপে জাতীয় দলের হয়ে করা প্যারফর্মেন্স তাকে এনে দিয়েছে কিংবদন্তি ফুটবলারের মর্যাদা।

আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৫০ ম্যাচ। করেছেন ১৬ গোল। মনে হতে পারে গোল সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু তার প্রত্যেকটি গোলই সৃষ্টি করেছে লাখো আর্জেন্টাইন ভক্তদের মনে আনন্দের উচ্ছাস। আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন তিনটি বিশ্বকাপ।

১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে বিবেচনা করা হয়েছিল আন্ডারডগ হিসেবে। খেলেছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল। শেষ আটের ম্যাচে ফেবারিট ব্রাজিলের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক গোল করে দলকে নিয়ে যান সেমি ফাইনালে। গোল না পেলেও ইতালির বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করে দলকে তোলেন ফাইনালে। কিন্তু সাসপেনশনের কারনে খেলতে পারেননি পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনাল।

১৯৯৪ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে দুই গোল করে দলকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে দলে সুযোগ পাননি তিনি। সুযোগ না পাওয়ার কারণটা বড়ই আশ্চর্যজনক। তৎকালীন কোচ ড্যানিয়েল প্যাসারেলা তাকে বলেছিল চুল ছোটো করতে।

কিন্তু, শুধুমাত্র জাতীয় দলে খেলার জন্য তিনি লম্বা চুল বিসর্জন দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তাই ড্যানিয়েল প্যাসারেলার অধীনে জাতীয় দলে উপেক্ষিত ছিলেন ক্যানিজিয়া। পরবর্তীতে মার্সেলো বিয়েলসার অধীনে জাতীয় দলে আবারো ফিরে আসেন তিনি। সুযোগ পান ২০০২ বিশ্বকাপের দলে। কিন্তু সুযোগ পাননি কোনো ম্যাচের একাদশে।

২০০২ বিশ্বকাপেই রেফারির সাথে অসদাচারণের জন্য সাইডবেঞ্চে বসে থেকেই লাল কার্ড দেখেন। তিনিই ছিলেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার যিনি কিনা বেঞ্চে থাকাকালীন সময়ে লাল কার্ড দেখেছেন।

কোকেন গ্রহনের দায়ে ১৯৯৩ সালে নিষিদ্ধ হন ক্যানিজিয়া। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ধারে যোগ দেন পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকাতে। এরপর রোমা থেকে আবারো ধারে এক বছরের জন্য চলে আসেন বোকা জুনিয়রসে। বোকাতে ধারে আসার পেছনে হাত ছিল আর্জেন্টাইন মিডিয়া মোঘল এডোয়ার্ডো আর্নেকিয়ানের। তিনি তার ব্যবসায়িক উদ্দ্যেশে বোকাতে খেলান ম্যারাডোনা, ক্যানিজিয়ার মত ফুটবলারদের।

একবছর পর ১৯৯৬ সালে আবারো ইউরোপে ফিরতে চেয়েছিলেন ক্যানিজিয়া। কিন্তু ১৯৯৬ এর সেপ্টেম্বরে তার মা আত্মহত্যা করায় তখন ইউরোপে ফিরতে পারেন নি। মায়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ায় ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে বিক্ষিপ্তভাবে বোকার হয়ে কয়েকটি মাত্র ম্যাচ খেলেন তিনি।

যার ফলস্বরূপ বাদ পড়ে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ দল থেকে। এর পর ১৯৯৯ সালে আবারো ইউরোপে ফেরেন ক্যানিজিয়া। যোগ দেন পুরোনো ক্লাব আটলান্টাতে। তখন আটলান্টা ছিল সিরি “বি” তে। কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এক মৌসুম পরে আটলান্টা ছাড়েন তিনি। যোগ দেন স্কটিশ ক্লাব ড্যান্ডিতে।

ড্যান্ডিতে এক মৌসুমে ২১ ম্যাচে ৭ গোল করে পরিণত হন ড্যান্ডির তারকা ফুটবলারে। এখানেও থাকেননি এক মৌসুমের বেশি সময়। এক মৌসুম পরে ২০০১ সালে পাড়ি জমান আরেক স্কটিশ ক্লাব রেঞ্জার্সে। রেঞ্জার্সের ঘরের মাঠ ইবরক্স স্টেডিয়ামে কাপ ফাইনালে গোল করেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী সেল্টিকের বিপক্ষে।এই গোলের কল্যাণেই প্রিয় হয়ে ওঠেন রেঞ্জার্স সমর্থকদের। রেঞ্জার্সের পর কাতার এস.সি তে খেলে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন ক্যানিজিয়া।

ক্যানিজিয়া ছিলেন অসম্ভব গতি সম্পন্ন একজন ফুটবলার। তার গতির কারণে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অপরাজেয়। তার গোল করার সক্ষমতার পাশাপাশি গোল করানোর সক্ষমতাও ছিল। তিনি তার সাথে থাকা ফুটবলারদের জন্য তৈরি করে দিতেন অসংখ্য গোলের সুযোগ।

কালের স্রোতে ক্যানিজিয়া এখন আর ফুটবলের সাথে নেই। কিন্তু তাকে নিয়ে ভালোবাসাটা ঠিকই রয়ে গেছে।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link