দৃশ্যপটটা গত বারের বিপিএলের। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে শেষ ২৪ বলে ৫৪ রানের সমীকরণ মেলানো তখন রীতিমত অসম্ভবের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে খুলনা টাইগার্সের জন্য। তার উপর ক্রিজে নেই তেমন কোনো স্বীকৃত পাওয়ার হিটার। মিরপুরে এমন ঝিমিয়ে যাওয়া মুহূর্তে হঠাৎ উদয় হলেন অজানা, অখ্যাত এক ব্যাটার হাবিবুর রহমান সোহান।
যার আগমনের শুরুটাই হলো বিভ্রান্তি দিয়ে। ধারাভাষ্যে থাকা আমীর সোহেল বলে উঠলেন, থার্টি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড ক্রিকেটার। ম্যাচে প্রাণ নেই, তাই ও দিকেও কারো আগ্রহ নেই। কিন্তু গ্যালারিতে হঠাতই প্রাণ এনে দিলেন সেই সোহান। ৯ টা বল খেললেন। তাতেই ২ চার আর ৩ ছক্কায় ৩০ রান। ব্যস। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ওখানেই ম্যাচটা জিতে যায় খুলনা টাইগার্স। পরে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা সোহানকে নিয়ে ঘেটে দেখা গেল, ৩৫ নয়, এ এক ২১ বছর বয়সী তরুণ ক্রিকেটার। যার তখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পা-ই পড়েনি।
এক বছর পেরিয়ে গেছে সে সময় থেকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অনভিষিক্তই থেকে গিয়েছেন সোহান। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এ সময়কালে সামর্থ্যের জাগান দিয়েছেন তিনি। তাই তো এবারের বিপিএলেও তাঁর ঠিকানা হয়েছিল খুলনা টাইগার্স শিবিরেই। কিন্তু ব্যাট হাতে যে ৩ ইনিংসে সুযোগ পেলেন, তাতে একবারের জন্য পেরোতে পারলেন না সিঙ্গেল ডিজিট। অবশ্য ঠিকঠাক ব্যাটে সুযোগটাই তো পাচ্ছিলেন না।
কিন্তু সুযোগের সদ্যবহার তিনি করলেন নিজের সপ্তম ম্যাচে এসে। সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে এ দিন সুযোগ পেয়েই খেললেন ৩০ বলে ৪৩ রানের ইনিংস। ৩ চার আর ৩ ছক্কায় সাজানো সে ইনিংস কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা ম্যাচেই চিত্রই বলে দিবে। ক্রিজে এসেছিলেন নবম ওভারে। যখন ৩ উইকেট হারিয়ে রীতিমত ধুঁকছে খুলনা। দলের এমন বেহাল অবস্থার মাঝেই প্রতিপক্ষের উপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছিলেন এ ব্যাটার। প্রথম ১০ ওভারে ৫৬ রান করা খুলনা তাঁর ব্যাটিং তোপেই শেষ পর্যন্ত শেষ ৬০ বলে তোলে ৯৭ রান।
অবশ্য এ দিন শুরুতে নিজেও ব্যাট হাতে স্বস্তিতে ছিলেন না সোহান। প্রথম ১৯ বলে রান করেছিলেন মাত্র ১২। যার মধ্যে একটি বলই তিনি বাউন্ডারিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। তবে এরপরেই পাওয়ার হিটার বনে যান এ ব্যাটার পরের ১১ বলে করে ৩১ রান। যেখানে বাউন্ডারিই হাঁকান ৫ টি। যার মধ্যে ছিল ২ টা চার আর ৩ টা ছক্কার মার। সোহানের এমন বিধ্বংসী রূপেই শেষমেশ লড়াকু এক সংগ্রহ পায় খুলনা।
হাবিবুর রহমান সোহানের বিপিএলে আসার পিছনে অবশ্য অবদান রয়েছে দুর্দান্ত ঢাকার কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের। যিনি গতবার খুলনার কোচ ছিলেন। সুজনের সুনজরে পড়ার কাজটা সোহান অবশ্য নিজেই করেছিলেন। ২০২২ প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে মাত্র ৪ টা ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। তাতেই ১ সেঞ্চুরি এবং ২ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছিলেন ২৫০ রান। সোহানের এই পরিসংখ্যান আপনাকে আরো বিস্ময়ে ভাসাতে পারে, যখন শুনবেন এটা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট ছিল। শুধু তাই নয়, ৬২.৫০ গড়ে ব্যাটিং করা এ ব্যাটারের সে টুর্নামেন্টে স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ১৯০!(১৮৯.৩৯)।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের পর প্রথম বিভাগ ওয়ানডে টুর্নামেন্টেও সোহান দেখিয়েছেন তাঁর ব্যাটিং দ্যুতি। ৬ ম্যাচের পাঁচটাতেই পেয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের দেখা। তাতে ৬৬.৫০ গড়ে সোহানের রান ৩৯৯! আর তাতে ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট প্রায় ১৪৪! ব্যাস এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। লিস্ট এ ক্রিকেটের আগেই বিপিএলে অভিষেক হয় তাঁর।
সোহানের ব্যাটিংয়ে আরেকটি চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হলো, অগোছালো কোনো শট তিনি খেলেন না। বাউন্ডারি মারলেও তাঁর ব্যাটে সেটি নান্দনিকতা সৃষ্টি করে। পাওয়ার হিটিং করেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর মধ্যেও ব্যাটিং ব্যকরণের সব রসদে পূর্ণ থাকে। হাই ব্যাকলিফটে ব্যাট করে থাকেন। আর সব সময়ে ক্ল্যাসিক একটা মুভমেন্টে থাকেন। অন, অফ- সকল প্রান্তেই স্ট্রোক খেলতে পারেন। তাই নজরে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।
গত বছরে লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া সোহান এরই মধ্যে পেয়েছেন ২ টা সেঞ্চুরি। সেই ধারাবাহিকতায় বিপিএলেও চোখে পড়ার মতো একটা ইনিংস খেললেন। সোহান নিশ্চয়ই সেই সংখ্যাটাকে সামনে আরো বাড়িয়ে নিতে চাইবেন। ছুঁতে চাইবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে খেলার স্বপ্নকেও।