একালের ক্রিকেটের বিটলস

স্পিন বোলিং যদি আর্ট হয়, রবিচন্দ্রন অশ্বিন তাহলে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। রবীন্দ্র জাদেজা, অক্ষর প্যাটেল বা জ্যাক লিচ নিতান্তই রাজ মিস্ত্রি। তাঁরা ইটের পর ইট গেঁথে, উইকেটের ইমারত তৈরি করেন বটে। কিন্তু তা কিছুটা একঘেঁয়ে। যদি ‘৪২’ এর মতো না হয়, তাহলে একটা ফ্ল্যাটের দিকে আর কেই বা একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন?

কিন্তু, শহুরে সভ্যতায়, ফ্ল্যাট বা বাড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই রাজমিস্ত্রি বা উপরিউক্ত স্পিনারদের ছোট না করেই বলছি, অশ্বিন একই সরঞ্জাম (আঙুল ও লাল বল)ব্যবহার করেও স্পিন বোলিংয়ের মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। যে উইকেটে বল ঘোরে না, সেই উইকেটেই রবি অশ্বিনের একটা স্পেল দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যায়।

এবার অস্ট্রেলিয়াতেই তো, হয়তো উইকেট পাচ্ছেন না, মার খাচ্ছেন, কিন্তু তবুও মনে হয় দেখেই যাই। আর ঘূর্ণি পিচে তো কথাই নেই। আজ বেন স্টোকস কে যে বলে আউট করলেন, সেটার নন্দনতত্ত্ব বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো লিখে ফেলতে পারতেন দারুণ কিছু।

আসল কথা হলো, বর্তমান ক্রিকেটে অফ স্পিন নামক শিল্পটা আস্তে আস্তে অবলুপ্তপ্রায়। গদা মার্কা ব্যাট , ছোট বাউন্ডারি ইত্যাদির আক্রমণে অফ স্পিন শিল্পটা কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেছে। আজকাল যত নতুন অফস্পিনার উঠছে সকলেই গাঁতিয়ে বল করার দিকেই মনোনিবেশ করেন। কারণ তাঁরা জানেন, গতি বা ফ্লাইটের হেরফের ঘটিয়ে ব্যাটসম্যানকে বোকা বানালেও, গদার কল্যানে তার শেষ ঠিকানা গ্যালারিতেই।

আরেক ধরণের অফস্পিন-জীবি রয়েছে বর্তমান ক্রিকেটে, যাঁদের রহস্য স্পিনার বলা হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় তাঁদের অ্যাকশন আইনবহির্ভূত অথবা তাঁদের রহস্য বল গুলি কয়েক মৌসুম পরেই ধরা পড়ে যায়। তা শিবরাত্তিরের সলতের মতো শুধু দু’জন অফ স্পিনারই এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রয়ে গেছেন।

এক, নাথান লিঁও। এবং, কয়েকদিন আগেই লিঁওকে নিজের দেশের মাটিতেই স্পিন যুদ্ধে বিড়ালে পরিণত করা রবি অশ্বিন।গতির হেরফের, লুপ এবং টার্ন- একজন ভালো স্পিনারের তূণীরে যে তীর গুলো থাকা অত্যাবশক, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সবকয়টিই অত্যন্ত বিষাক্ত।

এটা মেনে নিতে কোনো বাঁধা নেই, যে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে উনি বিদেশের মাটিতে একেবারেই সফল ছিলেননা। দেশের মাঠেও, একমাত্র ঘূর্ণি উইকেট পেলেই স্বমহিমায় উদয় হতেন। সে তো বিরাট কোহলিও ইংল্যান্ডে তাঁর প্রথম সফরে যাচ্ছেতাই ছড়িয়ে এসেছিলেন। একজন খেলোয়াড়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান হয়, ব্যর্থতার গহ্বর থেকে সাফল্যের পাহাড়চূড়ায় সে উঠতে পারছে কিনা, তা দেখে।

বিরাটের মতো, অশ্বিন কিন্তু পেরেছেন। অশ্বিনের দুই পূর্বসূরী, কুম্বলে বা হরভজনের সাথে যদি তাঁর তুলনা করা হয় তাহলে অশ্বিন কিন্তু পিছিয়ে থাকবেননা। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া ফিঙ্গার স্পিনারদের জন্যে খুব একটা প্রিয় মৃগয়াক্ষেত্র নয়। হরভজনের সেখানে গড় ৭৩। কুম্বলের ৩৭। অশ্বিনের ৩৯ সেই হিসাবে যথেষ্ট ভালো, এবং ২০১৫ পরবর্তী অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাঁর গড় ৩২। ইংল্যান্ডের মাটিতে, হরভজন বা কুম্বলের চাইতে অশ্বিন অনেকটাই ভালো।

হরভজন ও কুম্বলে দুজনেই সেখানে ৪০ এর ঘরে। অশ্বিন মাত্র ৩২। আর ইংল্যান্ডের পিচ গত কয়েক বছরে খুব বেশি স্পিন সহায়ক হয়ে গেছে, এমন আরোপ বোধহয় অশ্বিনের চরম সমালোচকরাও লাগাবেন না। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকায় অশ্বিন বাকি দুইয়ের চেয়ে পিছিয়ে। তাও সেটা ২০১৩ সালের ওই অভিশপ্ত সফরটার জন্যে। ২০১৮ তে সেই দেশেই ওনার গড় মাত্র ৩০।

এমন মনে করার কারণ নেই যে অশ্বিনের প্রশস্তি গাইতে গিয়ে কুম্বলে বা ভাজ্জির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। বর্তমান কালে ভারতের পিচ আরো স্পিন সহায়ক হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাটসম্যানদের বিশ্বমানের স্পিন খেলার ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। কুম্বলে-ভাজ্জি তাঁদের সময় দারুণ ছিলেন। অশ্বিন এখন। তবু অশ্বিন আলাদা। কারণ তিনি জাস্টিন বিয়েবারদের আমলেও ক্রিকেটের ‘বিটলস’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link