হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং ‘কব্জি ঘোরাও জোরে’

উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব- ১৫ দলের ট্রায়াল চলছে, একের পর এক ব্যাটসম্যান-বোলার নেটে আসছেন, ট্রায়ালে সিলেক্টরদের নোটবুকে নাম উঠলে মাঠের এক ধারে সার বেঁধে দাঁড় করানো হচ্ছে। বাঁ-হাতে দুবার বলটা স্পিন করিয়ে দুটো হাত মেলে দিয়ে নিজের ট্রেডমার্ক বোলিং অ্যাকশন দেখিয়ে গুগলিটা ফেলে দিলেন গুড লেংথের একটু ওপরে।

কিন্তু ব্যাটসম্যানের ফ্রন্টফুটের সুইপ পার করে দিল বাউন্ডারি, দ্বিতীয় বলটা লেগস্পিন, কিন্তু এবার স্টেপ আউট করে ছয়, সিলেক্টরের হুইসল – ‘আউট!’ মাথা নিচু করে মাঠের বাইরে চলে গেল মি: চায়নাম্যান। পরদিন এলাকায় হইচই, সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে সবার আদরের কুলদীপ!

এলাকায় ভিড়, এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও মেন্টাল ব্রেকডাউন চরমে, বিষাদে খাচ্ছে না কিচ্ছু, যেন কত ক্ষত বুকে বেঁচে আছে একলা প্রেমিক।

১০ বছর পর ইডেন গার্ডেন্সের পিচে দুটো গুগলি- দুটো লম্বা ছক্কা মঈন আলির, ফের লেগ স্পিন একটু পেস বাড়িয়ে, ফের ছক্কা, দর্শকদের কটুক্তি উড়ে আসছে। ডাগ-আউটে ফিরে সেই কান্না, মনে পড়ছে ১০ বছর আগের দিনটা। মনে পড়ছে সেদিন ঐ অবস্থা থেকে বাড়িতে টাঙানো শেন ওয়ার্নের ছবিটা একটু একটু করে বাঁচিয়ে তুলেছে ওকে।

সৌরভ গাঙ্গুলির কথাগুলো কানে বেজেছে, মনে পড়েছে অনিল কুম্বলে বলেছিলেন যদি একজন খেলোয়াড় লেগস্পিনার হবার স্বপ্ন দেখে তবে বাইশগজে তাকে চরমতম মুহুর্তের জন্য প্রস্তুত রাখতে হয় মনকে, মনে পড়েছে সেই উক্তি, ‘It’s a game, here you can’t win all the time…’।

নেটে নিজেকে নিংড়ে দেবার সময় মনে হয়েছে এই ডেলিভারিটা বাউন্ডারি পেরোলে পরেরটা শক্তিশালী গুগলি দিয়ে ভেঙে দিতে হবে ব্যাটসম্যানের শিরদাঁড়া, একজন লেগ স্পিন বোলারের হাতে অধিনায়ক যখন বল তুলে দেন তার অর্থ দলের ব্রহ্মাস্ত্রকে প্রয়োগের অধিকার তুলে দেওয়া। লেগ স্পিনারকে আনা হয় আক্রমণের জন্য, বিপক্ষকে ভয় পেলে লেগ স্পিনার হওয়া হয় না, এক জীবনে যে লেগ স্পিনার হবার প্রতিভা ঈশ্বর সকলকে দেন না!

কুলদীপ নিজের সমস্ত শিক্ষা দিয়ে লেগ স্পিনটা দিল ডান হাতি বাবর আজমকে, কোহলির ব্রহ্মাস্ত্র বাবর আজমের ঢাল ভেদ করে ছিটকে দিল উইকেট। সারা বিশ্ব দুলে উঠল যেন আঙুলের মোচরে, ফিরে এল ২৭ বছর আগে ওয়ার্নের সেই ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ যা ছিটকে দিয়েছিল মাইক গ্যাটিং-এর অফস্টাম্প।

তিনি দুহাত মেলে যখন ম্যানচেস্টারে ভালবাসা কুড়োচ্ছেন তখন কোথাও জিতে যাচ্ছেন ক্রিকেট ঈশ্বর, জিতে যাচ্ছে আইপিএল-এ কান্নায় ভেঙে পড়ার পর নেটে ঝরানো ঘামটুকু, জিতে যাচ্ছে এক আদিম ক্রিকেটীয় মিথ – ‘To be a leg spinner you have to be brave enough’। সেদিনের সুইসাইডের চেষ্টা কিংবা ইডেনের কান্না কুলদীপকে শিখিয়েছিল নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে, শিখিয়েছিল যত ভয়ংকর ব্যাটসম্যানই সামনে থাক একজন লেগস্পিনার হিসেবে তাকে প্রহারের ভয়কে উপেক্ষা করে আক্রমণ করতেই হবে।

দুটো ওভার বাউন্ডারি মানে ভেঙে পড়া নয় বরং তৃতীয় বলে ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া – ক্রিকেট ঈশ্বর যে তাঁর দক্ষিণহস্ত মেলে রাখেন সাহসীদের ওপর, তাই তো ২৪ বছরের এই বিস্ময় সেদিনের ভেঙে পড়া ছেলেটা থেকে বিশ্বের বিস্ময় হয়ে ওঠা- ‘কুলদীপ চায়নাম্যান যাদব’, যার প্রতিটা ব্যর্থতাকে কব্জির মোচড় নিয়ে এসেছে সাফল্যের সরণীতে, যেন সেই চেনা গান ব্রিটিশ মুলুকে বাজছে নতুন স্লোগানে- হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং ‘কব্জি ঘোরাও জোরে’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link