মিলখা সিংকে কে না চেনে। ভারতের ইতিহাসের সেরা অ্যাথলেট। কিন্তু ভারতের ক্রীড়াঙ্গনেই আরেকজন মিলখা সিং ছিলেন, এবারের জন ক্রিকেটার। যদিও, প্রথম জনের মত দ্বিতীয়জন এতটা আলোচিত ছিলেন না। তবুও, ক্রিকেটার তো ছিলেন!
অমৃতসর গোবিন্দসিং মিলখা সিং এর কখনওই বড় ভাই কৃপাল সিং এর মত গ্লামার ছিল না। কিন্তু তামিলনাড়ুর ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি বরাবরই ছিলেন পরিচিত মুখের একজন। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ স্টাইলিশ, চিরাচরিত বাঁহাতিদের মত সুন্দর ব্যাটিং এর ধারক। বেশিরভাগ সময়ই ইনিংসের শুরুতে তিনি ভাল শুরু পেতেন, রান করতে থাকতেন। কিন্তু তারও ছিল ক্রিকেটারদের সেই অমোঘ সমস্যা- ভাল শুরু করে বড় করতে না পারা। খুব সম্ভবত এই কারণেই তিনি নিজের নাম খুব বেশি উপরে তুলতে পারেননি।
অন্তত ‘মিলখা সিং’ নামটা তো কিছুটা উঁচু স্থানের দাবিই রাখে!
তা অ্যাথলেট মিলখা সিং এর মত এভারেস্ট ছুঁতে না পারলেও পাহাড়ের চাইতে কম কিছু ছিলেন না আমাদের এই ক্রিকেটার মিলখা সিং। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর রান ছিল ৪৩২৪, তাও মাত্র ৩৫ ম্যাচে। রঞ্জি ট্রফিতে ৪১ ম্যাচে ২১৫১ রানও কিন্তু খুব খারাপ এমনটা কেউ অন্তত বলতে পারবেনা।
- ইন্ডিয়ান স্টারলেট
১৯৫৯-৬০ এর দিকের ঘটনা। ভারতের কিছু তরুণ খেলোয়াড় নিয়ে একটা দল গড়া হয়, নাম দেওয়া হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টারলেট’। ইন্ডিয়ান স্টারলেট সেসময় বেশ কিছু প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে। সেই দলের পাকিস্তান সফরে ডাক পেয়েছিলেন মিলখা সিং, বয়স তখন সাকুল্যে ১৮ বছর। সফরটা অবশ্য মিলখা সিং এর অনুভূতির বিভক্তি হয়েই থাকবে। কেননা প্রথম তিন ইনিংসে মিলখা সিং করেছিলেন সব মিলিয়ে ৬৮ রান। তবে সেখান থেকেই মোড় ঘুরিয়ে পরের ইনিংসগুলিতে মিলখা সিং এর রান ছিল ১০৩*, ৯৭*, ১০১ আর ১০০!
পুরো সফর শেষে মিলখা সিংয়ের ব্যাটিং গড় ১১৭!
- স্বপ্নের টেস্ট অভিষেক
ইন্ডিয়ান স্টারলেটের ঐ সফরের পর মিলখা সিং ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ এর পুরস্কারও পেয়ে গেলেন । আর অনুমিতভাবেই টেস্ট ক্যাপটাও তৈরিই করে রাখা হয়েছিল মিলখা সিং এর জন্যে। সদা পোশাকে মিলখা সিং এর প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া, সেও ১৯৫৯-৬০ এর সময়টাতেই। কিন্তু, ইন্ডিয়ান স্টারলেটের হয়ে করা দানবীয় পারফরম্যান্স তিনি পঙ্গাল টেস্টে ফেরাতে পারলেন না।
তবে এক পঙ্গাল টেস্টের ব্যার্থতা ঢাকার সুযোগ ছিল আরেক পঙ্গাল টেস্টে, মিলখা সিং সেখানেও পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যার্থ হলেন। এরও এক বছর পর দিল্লীতে তিনি করলেন ৩৫ যেটা কিনা সাদা পোশাকে তাঁর ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রান হয়ে রইল!
- কুঁড়িতেই শেষ
মিলখা সিং এর শেষ টেস্ট ছিল বোম্বেতে, প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। এই টেস্টটা ভারতের হয়ে না হোক, তামিল নাড়ুর কাছে একটা বিশেষ মর্যাদা রাখে। মিলখা সিং তো ছিলেন, দলে ছিল তাঁর বড় ভাই কৃপাল সিং। এছাড়াও তামিলনাড়ুর আরেকজন ক্রিকেটারও এ দলে ছিল। ‘বিশেষ মর্যাদা’র কারণ এই যে ভারতের ইতিহাসে তামিড়নাড়ুর তিনজন একইসাথে ভারতীয় দলে খেলার ঘটনা এটাই প্রথম!
ব্যাস, সাদা পোশাকে মিলখা সিং এর রথ এখানেই থেমে গেল। ১৫.৩৩ গড়ে ৯২ রান- অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আসা মিলখা সিং এর ক্যারিয়ার সামারি এটুকুই। এটুকু যদি আক্ষেপের কারণ হয়, তবে সবচেয়ে বড় আক্ষেপটাই এখনও বলা হয়নি-
সাদা পোশাকে নিজের শেষ ম্যাচ খেলার সময় মিলখা সিং এর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর!
- দুলীপ ট্রফি
ইন্ডিয়ান স্টারলেটের সেই সফরের পর মিলখা সিং প্রথমবারের মত নজর কাড়া কিছু করেন ১৯৬১-৬২ সালে, দুলীপ ট্রফিতে। সেটা ছিল মিলখা সিং এরই দুলীপ ট্রফিতে প্রথম ম্যাচ। দলের কেউ যখন ৪০ এর বেশি করতে পারছে না, মিলখা সিং একাই তখন করে ফেললেন ১৫১ রান। মিলখা সিং এর তো বটেই, এটা ছিল দুলীপ ট্রফিরই ঐ আসরের প্রথম সেঞ্চুরি।
মিলখা সিং এর সেঞ্চুরির সুবাদে সাউথ জোন ৩০২ রানের পাহাড় গড়ে ফেলে, আদতে যেটা বেশ শক্ত স্কোরই লাগছিল। সেই শক্ত স্কোর দুর্দান্ত হয়ে যায় যখন প্রতিপক্ষ নর্থ জোন দুই ইনিংসে করে মাত্র ৪৮ আর ১৬৬!
- পরিবার
মিলখা সিং এর পরিবার ছিল ক্রিকেটেরই পরিবার। তাঁর বাবা রাম সিং এর কথাই ধরা যাক। কখনও টেস্ট না খেললেও রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ১০ হাজার রান আর ১০০ উইকেটের ‘ডাবল’ ছুঁয়েছিলেন তিনি। বড় ভাই কৃপাল সিং তো নিজেই ছিলেন একজন নামকরা ক্রিকেটার। ক্রিকেটের ছায়াতল থেকে বাদ যাননি ছোটভাই সত্যেন্দ্বর সিংও।
মোটামুটি শুরু থেকেই ক্রিকেটের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছিলেন মিলখা সিং। তাই খুব অল্প বয়সেই মাদ্রাজের এক ক্রিকেট লিগে সুযোগ পেয়ে গেছিলেন তিনি, তাঁর অগ্রজ আর অনুজ। নিজে সেই লিগে খেলেছিলেন ‘স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র হয়ে, অগ্রজ কৃপাল খেলেছিলেন ‘ইআইডি পারি’র হয়ে আর অনুজ সত্যেন্দ্বার সিং খেলেছিলেন ‘অলওয়ারপেট সিসি’র হয়ে!
- মহাপ্রয়াণ
৭৫ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর জীবনের ব্যাট তুলে রেখে ওপারের প্যাভিলিয়নে পাড়ি দেন মিলখা সিং। নিজে হয়তো ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন ছিলেন না, কিন্তু তামিলনাড়ুর হয়ে তাঁর অবদান ছিল মনে রাখার মতই। বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) তাই শোকবার্তা পাঠাতে এদিন একদমই ভুল করেনি!