‘মূল ছবিটা ইয়োহান ক্রুইফই এঁকে দিয়েছিলেন। তারপর বার্সেলোনা ডাগআউটে আসা সব কোচ একে কেবল মেরামত কিংবা একটু-আধটু উন্নতই করতে পেরেছেন।’
ওপরের কথাটা বার্সাকে চার মৌসুমে ১৪ শিরোপা জেতানো, ইউরোপে আবারও সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়া, চার বছরে চোখ ধাঁধানো ফুটবল উপহার দেয়া কোচ পেপ গার্দিওলার। আধুনিক ফুটবলেরই অন্যতম সেরা কোচের মুখে এমন স্তুতি তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! তবে ক্রুইফের ব্যাপারে যেন এমন স্তুতিও কম হয়ে যেতো, বার্সেলোনা তো বটেই, গোটা ফুটবলেরই সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিটি যে তিনিই ছিলেন!
খেলোয়াড়ি জীবনটা ছিলো আর দশজন ফুটবলারের মতোই, পাওয়া-না পাওয়ার গল্পে ঠাসা। আসল জাদুর শুরুটা হয় তিনি ডাগআউটে আসার পর। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, ন্যু ক্যাম্পের ডাগআউটে আসার পর।
তদ্দিনে বার্সার অহম পুড়ছে হেস্পিরিয়া ম্যুটিনির আগুনে। ক্লাবের ২১ জন খেলোয়াড় আর তৎকালীন কোচ লুইস আরাগোনেস মিলে রীতিমতো বিদ্রোহই করে বসেছিলেন সভাপতি হোসে লুইস নুনিয়েজের বিরুদ্ধে। কারণটা ছিলো যেখানে পুরোপুরি অর্থনৈতিক!
তবে সেটাই ১৯৪১/৪২ মৌসুমের পর ক্লাবকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থতিতিতে ফেলতে যথেষ্ট ছিলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নুনিয়েজের কাছে সম্ভাব্য একটা তুরুপের তাসই কেবল ছিলো, ততদিনে কোচ হিসেবেও আয়াক্সকে ইউরোপসেরা বানিয়ে দেয়া ইয়োহান ক্রুইফ।
ক্লাবের দুঃসময়ে আবারও দায়িত্ব বর্তালো ক্রুইফের কাঁধে। ঠিক যেমন করে বর্তেছিলো বছর এগারো আগে, খেলোয়াড় হিসেবে! এবারের কাজটা কঠিন ছিলো, হেস্পিরিয়া ম্যুটিনি তো আছেই, ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের টাইব্রেকারে একটিও গোল করতে না পারার দুঃস্বপ্নকেও ঝেটিয়ে বিদায়ের দায়িত্বটাও ছিলো কাঁধে।
হেস্পিরিয়া-পরবর্তী মেরামতকাজটা শুরু হলো সাথে সাথেই। একুশ বিদ্রোহী খেলোয়াড়ের পনেরো জনকেই বিদায় করলেন। দলে এলেন ১২ জন খেলোয়াড়, যাদের মধ্যে উইঙ্গার জিকি বেগিরিস্টাইন, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হোসে মারি বেকারো, স্ট্রাইকার হুলিও সালিনাস ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ইউসেবিওরা পরবর্তীতে ক্রুইফের ‘ড্রিম টিম’-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছিলেন।
সে সময়ে খেলোয়াড় দলে আনার ক্ষেত্রে ক্রুইফের কৌশল নিয়ে ইউসেবিও মন্তব্য করেছিলেন, ‘খেলোয়াড় হিসেবে তার ন্যু ক্যাম্পের দিনগুলোই স্প্যানিশ ফুটবল আর বার্সেলোনিজমোকে বদলে দিয়েছিলো। কোচ হিসেবে এসে তিনি এমন খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়েছিলেন, যারা তরুণ, ক্ষুধার্ত আর যাদেরকে ক্লাবের সাম্প্রতিক বাজে ইতিহাস মোটেও পিছুটেনে ধরবে না।’
তবে একটা কাজ করেছিলেন রীতিমতো তাক লাগানো, প্রধান বিদ্রোহকারী অ্যালেক্স্যাঙ্কোকে রেখে দিয়ে। ক্রুইফের ব্যাখ্যা ছিলো, ‘দলের অধিনায়ক হিসেবে সে খেলোয়াড়দেরকে মনঃক্ষুণ্ণ করেনি। নেতার কাজটাই করেছে। বার্তাবাহককে প্রায় সময়েই প্রাণ হারাতে হয়, তবে সেটা আমি করতে যাচ্ছি না। যদিও নিয়মিত নয়, সে একজন নেতা এবং সেখানে ঐক্যটা সৃষ্টি করেছিলো সে।’
ক্রুইফের এ সিদ্ধান্তে নাখোশ ছিলেন সভাপতি নুনিয়েজ। কিন্তু তৎকালীন বার্সা কোচ ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। এটা অন্য এক বার্তাও দিয়েছিলো সভাপতিকে। ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এখানে তুমি নও, আমিই বস!’
সভাপতির প্রতি কোচ ক্রুইফ আরেকটা লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছিলেন। ‘যদি কথা বলতেই হয় তবে আমি তোমার অফিসে যেতে পারবো, কিন্তু তুমি আমার ড্রেসিংরুমে আসতে পারবে না।’ ক্রুইফ-নুনিয়েজের এই সমঝোতা ক্লাবের জন্যে পরে সুফলই বয়ে এনেছিলো।
এতকিছুর পর ঔদ্ধত্বের প্রতিফলনটা মাঠে না দেখালে তার কোন মূল্যই থাকতো না। ক্রুইফ অতি অবশ্যই সেটা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
জুলাই ১৯৮৮-তে, দলের সবাইকে ডাকলেন। নিজের খেলার পদ্ধতিটা বর্ণনা করতে লেগে গেলেন ক্রুইফ।
সেদিনের স্মৃতি রোমন্থনে ইউসেবিও বলেন, ‘একটা ব্ল্যাকবোর্ডে, তিন ডিফেন্ডার, চারটা মিডফিল্ডার, দুজন পুরোদস্তুর মিডফিল্ডার আর এক সেন্টার ফরোয়ার্ড আঁকলেন। আমরা সবাই একে অপরের দিকে মুখ দেখাদেখি করলাম, ভাবলাম ‘এটা কি!’ তখন ছিলো ৪-৪-২ কিংবা ৩-৫-২ এর যুগ। দলে ক’জন স্ট্রাইকার বা ডিফেন্ডার আছে তা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। তিনি একাই নতুন একটা খেলোয়াড়ি দর্শন নিয়ে এসেছিলেন স্পেনে। এটা একটা বিপ্লবই ছিলো বটে!’
ফর্মেশনটা গুরু রাইনাস মিকেলস সত্তরের দশকে আয়াক্স আর নেদারল্যান্ডসে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে যে খেলাতেন, তারই একটা নতুন রূপ ছিলো। নতুন এই ফর্মেশনের সুবিধা সম্পর্কে পরে ক্রুইফ বলেছিলেন, ‘যদি আপনার চারজন ডিফেন্ডার দুইজন স্ট্রাইকারকে সামলায় তাহলে মাঝমাঠের আটজনকে ঠেকাতে আপনার কাছে বাকী থাকবে মোটে ছয়জন খেলোয়াড়! এভাবে জিততে পারবেন না আপনি। একজন ডিফেন্ডারকে আমাদের আরেকটু সামনে খেলাতেই হবে। একটা ১-০ গোলের জয়ের চেয়ে আমি ৫-৪ গোলের জয়কে আমি বেশি ভালোবাসি।’
রক্ষণচিন্তা ক্রুইফের কাজ ছিলো না মোটেও, কোচ হওয়ার পরও নয়! একবার গোলরক্ষক আন্দোনি জুবিজারেতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সেটপিসে কিভাবে রক্ষণকাজটা করবো?’ ক্রুইফের প্রত্যুত্তর ছিলো, ‘আমি কি জানি! তুমি সিদ্ধান্ত নেবে। কর্নার কি করে ঠেকাতে হয় তাতে আমার চেয়ে বেশি আগ্রহ তোমারই থাকার কথা।’
তবে আরেকটু উপরে খেলা খেলোয়াড়রা পদ্ধতিটার স্বাধীনতা বর্ণনা করেছিলেন। ইউসেবিওর কথায়, ‘বার্সা ছাড়া অন্য সব পদ্ধতিতেই আমি কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলাম।’
‘আমার টেকনিক, দূরদৃষ্টি আর বলকে দ্রুত আগে বাড়ানোর বুদ্ধি বার্সার সঙ্গে দারুণভাবে মিলে গিয়েছিলো। অন্য সব জায়গায় এটা কেবলই পাস দেয়া কিংবা বলকে আগে বাড়াতেই থাকা-এর ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলো না। এখানে একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে আমাকে সবসময়ই ব্যস্ত থাকতে হতো, আর আমার হাতে প্রচুর বিকল্প থাকতো। বিশেষ করে কিছুটা ওয়াইড পজিশনে থাকা খেলোয়াড়দের থেকে, যাদেরকে ক্রুইফ আরও কাছে রাখতে চাইতেন।’
সাম্প্রতিক সময়ে বার্সেলোনার ট্রেডমার্ক ধরা হয় বলের দখলে শ্রেষ্ঠত্বকেই। যার শুরুটা হয়েছিলো ক্রুইফের ৩-৪-৩ এর হাত ধরে।
ক্রুইফের ভাষায়, ‘এটা একেবারে মৌলিক একটা ব্যাপার যেখানে আপনি বলের উপর আধিপত্য বিস্তার করবেন, বলটাকে ভালোভাবে আগে বাড়াবেন। আপনার কাছে এমন কিছু থাকবে যেটা আপনার প্রতিপক্ষের কাছে থাকবে না, তাহলে তো তারা গোলও করতে পারবে না!’
তবে এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা ছিলো। ক্রুইফের দর্শনের সবচাইতে বড় ব্যাপারটা ছিলো খেলোয়াড়দের টেকনিক্যাল দক্ষতার, যেটা তৎকালীন ফুটবলে ছিলো খুবই বিরল। বলের দখলে ক্ষুধার্ত একটা উৎপাদন ক্ষেত্র তাই তখন সময়ের দাবীই হয়ে দাড়িয়েছিলো। তার ফলেই লা মাসিয়াকে আবারও ঢেলে সাজানো হয়, রচিত হয় আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি, লিওনেল মেসিদের মতো প্রতিভাদের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার সোপান।
অথচ এর আগে কাতালান দলটির ট্রায়ালে খেলোয়াড়দের টেকনিক্যাল দক্ষতার চেয়ে বড় করে দেখা হতো তাদের সম্ভাব্য শারীরিক দক্ষতাকেই। কেবল পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা খেলোয়াড়দেরই রাখা হতো ট্রায়াল থেকে।
ক্রুইফের বার্সায় আসাটা সে পরিবর্তনটাই নিয়ে এসেছিলো। ক্রুইফের ভাষায়, ‘আলবার্ট ফেরার, সার্জি কিংবা গিয়ের্মো আমরের মতো শারীরিক ব্যাপারটা নেই বটে, কিন্তু বলটাকে ইচ্ছেমত খেলাতে পারতো, প্রতিপক্ষকে ইঁদুরের মতো করে প্রেস করতে পারতো এমন কিছু খেলোয়াড় ছিলো। এমনকি পেপ (গার্দিওলা) এর ভেতরেও শারীরিক ব্যাপারটা ছিলো না। তবে বল পায়ে তার বুদ্ধিটা ছিলো, আর আমার সেটাই প্রয়োজন ছিলো।’
একদম বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে ক্লাবের সবকটা দল মূল দলের ৩-৪-৩ এ খেলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো, যেখানে বলের দখলই হচ্ছে সাফল্যের শেষকথা। লা মাসিয়া থেকে আসা ফেরার, আমর আর সার্জি মিলে ১০০০ ম্যাচ খেলেছিলেন ক্রুইফের অধীনে, যেখানে কেউই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতেন না। গার্দিওলা করতেন, তিনি খেলেছিলেন ৩৮৪ ম্যাচ।
ক্রুইফের বদলে যাওয়া বার্সেলোনার বর্ণনা দিয়ে সাবেক লা মাসিয়ার খেলোয়াড় ও মুন্দো দেপোর্তিভোর প্রতিবেদক ওরিয়ল ডমেনেখ বলেন, ‘বল পায়ে বার্সেলোনা কেবলই প্রোটাগনিজমের চর্চা করতো, এমনকি তাদের ফিটনেস অনুশীলনটাও হতো বল পায়ে নিয়েই! আমার মতো ছোটোখাটো গড়নের খেলোয়াড়দের সামনে দারুণ সুযোগ ছিলো তার অধীনে। ক্রুইফকে ছাড়া, তার দর্শন ছাড়া জাভি-ইনিয়েস্তাদের কথা চিন্তাও করা যেতো না।’
ক্রুইফের নকশার ভিত্তিটা রচিত হলো। প্রথম মৌসুমে দলটা জিতলো ১৯৮৮/৮৯ মৌসুমের ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ, পরের বার কোপা দেল রে। কিন্তু কিছু সমস্যা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ১৯৮৯ সালের দলবদলে ভেড়ানো বড় নাম, মাইকেল লাউড্রপ কিংবা রোনাল্ড কোয়েম্যানরা ঠিকঠাক আলো ছড়াতে পারেননি প্রথম মৌসুমে। ফলে সংবাদ মাধ্যমের সামনে দাঁড়ানোটা মুশকিলই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ক্রুইফের জন্যে।
‘আমার বিপক্ষে পুরো পৃথিবী’ এমন একটা দিক ছিলো ক্রুইফের চরিত্রের উল্লেখযোগ্য এক অংশ। এটা সে মৌসুমে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো। ফলে সংবাদ মাধ্যমে দৈনিক ব্রিফিং বন্ধ করে দেন তিনি। কিছু সাক্ষাতকার দিতেন, কিন্তু সেখানেও বেশ রহস্যময় আচরণ করতেন ক্রুইফ। একজন প্রতিবেদককে তো বলেই বসেছিলেন, ‘যদি তোমাকে বুঝানোই আমার লক্ষ্য হতো তবে আরও ভালোভাবেই বুঝাতাম আমি।’
পরের মৌসুমেও কোপা দেল রেই বাঁচালো ক্রুইফকে। লিগে রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে ১১ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে যে শেষ করেছিলেন ১৯৮৯-৯০ মৌসুমটা! আরেকজন ছিলেন ক্রুইফের পাশে, সভাপতি হোসে নুনিয়েজ। সে মৌসুমের শেষদিকে যদি বোর্ড সদস্যদের কথামতো যদি নুনিয়েজ ক্রুইফকে চাকরিচ্যুতই করতেন তবে যে বার্সা-ক্রুইফ রূপকথারও আর দেখা মিলতো না!
ভাগ্যিস করেননি! পরের মৌসুমই যে ছিলো রূপকথার শুরু। লা মাসিয়ার তরুণদের উপর যে বাজিটা খেলা হয়েছিলো সেটাই ফল দিতে শুরু করেছিলো সে মৌসুমে।
তবে এ ধারণাটাও এসেছিলো সমর্থকদের থেকে নিজের আত্মরক্ষার জন্যেই! ক্রুইফের স্বীকারোক্তি, ‘ক্যান্টেরা থেকে মূল দলে খেলোয়াড় আসাটাকে সমর্থকেরা পছন্দ করতেন। তাতে ‘কোচ বার্সেলোনারই একটা অংশ’-এমন একটা অনুভূতি তাদের মাঝে সৃষ্টি হতো। আমি একটা পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টায় ছিলাম যেটাকে ‘কাতালান’ বলে আখ্যা দেয়া যেতো। এতে ফলাফল নিজের পক্ষে না এলেও দুয়ো শোনার ভয়টা কম ছিলো।’
রিস্টো স্টইচকভ পরের মৌসুমে এলেন প্রতিপক্ষ গোলমুখে দলের জিগসও পাজেলের শেষ ভাগটা হয়ে। বাঁ প্রান্ত থেকে তার নির্ভুল ড্রিবল, পাস কিংবা শুটিংয়ের দারুণ দক্ষতা আর যে কোন মূল্যে জেতার মানসিকতা নিয়ে। তারই একটা স্বরূপ মেলে রেফারির সঙ্গে বাজে আচরণ করে ১৯৯০ সুপার কাপের ফাইনালে দুই মাস নিষিদ্ধ হওয়াটায়।
৯১ এর জানুয়ারিতে মাদ্রিদকে ২-১ গোলে যখন হারায় বার্সা, লিগ প্রায় নিশ্চিতই হয়ে যায় তখন। এক মৌসুম আগের ‘ফ্লপ’ কোয়েম্যান-লাউড্রপরা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রক্ষণ, মাঝমাঠ; প্রতিপক্ষ গোলমুখে ছিলো রিস্টোর ত্রাস। তখনই এলো বড় ধাক্কা।
ফুটবল বাদে সিগারেট ছিলো ক্রুইফের বড় এক নেশা। সেই কৈশোরে শুরু করা অভ্যাসটা তদ্দিনে ভয়াবহ রূপই ধারণ করেছিলো। দিনে বিশটারও বেশি সিগারেট বার্সা ডাগআউটে আসার আগেই খেতেন, কাতালুনিয়ায় আসার পরে পারিপার্শ্বিক চাপে যেটা কেবল বেড়েই চলেছিলো। যার খেসারতটাও দিতে হলো ভালোভাবেই।
চার ঘণ্টা দীর্ঘ এক অস্ত্রোপচারের পর বেঁচে ফিরতে নয়টা ম্যাচ ডাগআউটে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। তবে সহকারী কার্লোস রেশাখের কল্যাণে খুব একটা ভুগতে হয়নি দলকে। জিতেছিলো ছয় ম্যাচ, তাতেই নিশ্চিত হয় ছয় বছর পর আবারও লিগ জয়।
ইউসেবিওর মত, এটা ডাচ কিংবদন্তীর অনুশীলন পদ্ধতিরই ফসল ছিলো, ‘তিনি প্রতি সেশনেই চার পাঁচ বার পজিশনিং ঠিক করতে থামাতেন আমাদের। বলতেন, ‘না না এখানে নয়, আরেক মিটার ডানে। এখন দেখো এখন তোমার কাছে পাসের জন্যে আরও ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে এমনটা ছিলো না।’ আপনার মতে হতে পারে এটা খুবই ছোট একটা দিক কিন্তু এটাই দিনশেষে আপনার সঙ্গে থেকে যায় আর আপনি খেলার প্রত্যেকটা মূহুর্তে ঠিক যায়গায় থাকার স্বভাবটা আত্মস্থ করেন।’
ক্রুইফ যখন বেঞ্চে ফিরলেন, সিগারেটের জায়গায় ললিপপ হয়ে গিয়েছিলো তার নিত্যসঙ্গী। তার সিগারেট কমিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেনো বার্সাও কিছুটা ধার হারালো। আগের মৌসুমের লিগজয়ীরা ১৯৯১/৯২ মৌসুমের শুরুটা করলো প্রথম আট ম্যাচের তিনটায় হেরে। নভেম্বরে ইউরোপিয়ান কাপে কাইজার্সক্লটেনের কাছে বিপক্ষে প্রথম লেগে ৩-১ গোলে জিতে পরের লেগে প্রচণ্ড বাজে খেলে ১-০ গোলে পিছিয়ে বিরতিতে যায় দলটা। অনুপ্রেরণার অভাবটা তখন অনুভূত হয়।
কিন্তু সবকিছু যদি সহজভাবেই করতে হয় তবে আর তিনি ক্রুইফ কেনো! সেন্টারব্যাক মিগুয়েল নাদাল সে স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘তিনি ড্রেসিংরুমে এলেন, আমরা বিস্ফোরক কিছুর আশংকা করছিলাম। কিন্তু তিনি কেবল হাত ঘষলেন আর বললেন, ‘ব্লাডি হেল! বাইরে তো পুরো জমে যাচ্ছিলাম!’
কিছুটা অবাক হলেও দলের উপর সব চাপ সরে গিয়েছিলো তাতেই, জানান নাদাল। ‘আমাদের মৌসুমটাই যেখানে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো আর তিনি কিনা বলছিলেন ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছেন! সব চাপ উবে গিয়েছিলো। নিজের তৈরি করা দলে তার বিশ্বাসটা ছিলো কারণ তিনিই দলটাকে একাট্টা করেছিলেন। তিনি সবসময়ই ঠিক, এমন একটা বিশ্বাস ছিলো তার।’
ক্রুইফের দল দ্বিতীয়ার্ধে হজম করে আরেক গোল। কিন্তু হোসে মারি বেকারোর ৮৯ মিনিটে করা গোল রক্ষা করে বার্সাকে, ঠিক যেমনটা কোচ আশা করেছিলেন। মে’র শেষদিকে লিগের শেষ ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদ টেনেরিফের কাছে হারলে টানা দ্বিতীয় লিগ শিরোপাটা নিশ্চিত করে দলটা। তবে আরেকটা বড় পরীক্ষা বাকি ছিলো দলের। সাম্পদোরিয়ার বিপক্ষে ওয়েম্বলিতে ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল।
তবে বছর ছয়েক আগে সেভিলের ফাইনালটায় স্টয়া বুখারেস্টের বিপক্ষে পেনাল্টি শুটআউটে একটাও গোল করতে না পারার হতাশা তখনো তারা করে ফিরছে দলটাকে। ক্রুইফ সেটাই ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দলকে। ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘সালিদই দিসফ্রুতাদ’ বা ‘যাও, উপভোগ করো’। নাদাল জানান, এটাই দলকে চাপমুক্ত করে দিয়েছিলো পুরোপুরি! যারই ফল, অতিরিক্ত সময়ে কোয়েম্যানের ফ্রি কিকে শিরোপাজয়।
রচিত হয় ক্রুইফের ‘ড্রিম টিম’-এর কিংবদন্তী।
পরের তিন মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সাফল্য না এলেও লিগে ঠিকই আধিপত্য ধরে রাখলেন। ১৯৯৩-এ রোমারিও এলেন, সুযোগসন্ধানী এই ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকারের দারুণ দক্ষতা দলকে পাইয়ে দিলো অভূতপূর্ব টানা চতুর্থ লিগ শিরোপা। সঙ্গে এলো কাপ উইনার্স কাপও। মাঝে রিয়ালকে দলটা হারালো ৫-০ ব্যবধানে, হ্যাটট্রিক করেন রোমারিও।
পরের মৌসুমেও লিগ জিতলো বার্সা।
তবে বড় পরীক্ষাটা অপেক্ষা করছিলো ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে, মিলানের বিপক্ষে। ম্যাচের আগে ক্রুইফ বলেছিলেন, ‘মিলান মোটেও অতিমানবীয় কিছু নয়। আমরাই ফেভারিট।’ কিন্তু ফলাফল হলো পুরো উল্টো। রক্ষণনির্ভর মিলানই করলো চার গোল, আক্রমণনির্ভর বার্সা করতে পারলো না একটাও! অতি আত্মবিশ্বাসই যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না দলের কারোই।
শেষের শুরুও ছিলো সেখানেই। জুবিজারেতা, লাউড্রপ, গয়কচিয়া, সালিনাসরা আর কখনোই লাল-নীল জার্সিটা গায়ে চাপাননি, পরের শীতকালীন দলবদলে রোমারিও দল ছাড়েন। তার ব্যাপারে ক্রুইফের ভাষ্য ছিলো, ‘আমার মতো ভালো সে নয়। আমি অন্যদের ভালো খেলাতাম। আর সে শুধু গোলই করতে পারে!’ ইউসেবিও, স্টইচকভ, কোয়েম্যান আর বেগিরিস্টেইনদেরও একই নিয়তি বরণ করতে হলো। শুধু নাদাল, ফেরার, গার্দিওলারাই থেকে গেলেন।
চলে যাওয়াদের স্থান পূরণ হলো গিওর্গি হ্যাজি, রবার্ট প্রোসিনস্কিদের দিয়ে। কিন্তু স্বর্ণসময় আর ফিরলো না। ১৯৯৫/৯৬ মৌসুমের পর অনেকটা জোর করেই বিদায় করা হয় তাকে। টানা দুই শিরোপাহীন মৌসুমের পরও ন্যু ক্যাম্পের ভালোবাসা নিয়েই ডাগআউট ছাড়েন ক্রুইফ। শেষ ম্যাচে সেল্টাভিগোর বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও তার ছেলে জর্দির কল্যাণে ৩-২ ব্যবধানে জেতে বার্সা। মাঠ যখন ছাড়ছেন, ‘ক্রুইফ, সি! নুনিয়েজ, নো!’ বা ‘ক্রুইফকে হ্যাঁ, নুনিয়েজকে না’ রবে মুখর ছিলো ন্যু ক্যাম্প।
তবে ক্রুইফ যাওয়ার আগে যেসব পরিবর্তন এনে গেছেন তা আজও টিকে আছে বার্সার ফুটবলে। শেষ এক যুগে গার্দিওলার টিকিটাকা, এরপর দলটার বলের দখল নির্ভর ফুটবল যে তারই দর্শনেরই পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত রূপ!
এমনকি ক্রুইফের সবচেয়ে বাজে হারটাকেও একটা অনুপ্রেরণা বলে দেয়া চলে অনায়াসে। ইউসেবিওর ভাষ্য, ‘পেপ গার্দিওলা সবচেয়ে সফল একটা প্রজন্মের দায়িত্বে ছিলো। কারণ সে জানতো ১৯৯৪ ফাইনালে কিসের অভাব ছিলো। কঠোর পরিশ্রম আর প্রতিপক্ষকে সম্মান। সন্দেহ নেই বার্সার কোচ হয়ে আসার পরে যে কোন ম্যাচের আগেই গার্দিওলার মাথায় মিলান ম্যাচটার ভাবনা দোলা দিতো!’
ক্রুইফের দেখানো রেসিপি, বলের দখল আর লা মাসিয়া দিয়েই তো গার্দিওলা জিতেছিলেন চার মৌসুমে চৌদ্দটি শিরোপা। ছাপিয়ে গিয়েছিলেন গুরু ক্রুইফকে।
তবে এখানেই ক্রুইফের প্রভাবের শেষ নয়, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে স্পেনের ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরোর শিরোপাত্রয়ী জেতা আর বিশ্বজোড়া আধিপত্যও যে ডাচ কিংবদন্তীরই গড়া ছিলো, স্পেন কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক অকপটেই তো মেনে নিয়েছিলেন সেটা! দলটায় আধিপত্য ছিলো লা মাসিয়া খেলোয়াড়দের, খেলছিলোও ক্রুইফের দেখানো বলের দখল নির্ভর ফুটবল।
মিগুয়েল আনহেল নাদালের ভাষায়, ‘ক্রুইফ দেশটার ফুটবলের ধারণাটাকেই আবার আবিষ্কার করেছিলেন। আজ বার্সেলোনা আর স্পেন তারই সাক্ষ্য দেয়।’ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দুই ক্লাব আর জাতীয় দলের ভিত গড়ে দেয়া মানুষটা ছিলেন ক্রুইফ। অসামান্য এক অর্জনই বটে!