টেস্ট অভিষেকে ব্যাট করতে নেমেছেন অথচ স্নায়ুচাপে ভোগেন নি, এমন ক্রিকেটারের দেখা পাওয়াই ভার। তবে এর ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে। এই যেমন সাবেক ইংরেজ ব্যাটসম্যান টিপ ফস্টারের কথাই ধরুন। টেস্টে নিজের অভিষেক ইনিংস খেলতে নেমে ওসব চাপ-টাপের ধার তো ধারেনই নি, বরং এমন এক রেকর্ডের জন্ম দিয়েছেন যা আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারে নি!
১৮৭৮ সালের ১৬ এপ্রিল, উস্টারশায়ারের মালভার্নে জন্মগ্রহণ করেন রেজিনাল্ড এরস্কিন ফস্টার ওরফে ‘টিপ’ ফস্টার। একটা সময় পর্যন্ত তাঁকে বিবেচনা করা হত ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাটিং প্রতিভা হিসেবে। অবশ্য তিনি অনন্য ছিলেন আরেকটা জায়গায়। ফুটবল আর ক্রিকেট দুই খেলাতেই ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি! এমনকি আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর তিনটি গোলও আছে!
এবারে একটু পেছনের গল্প বলি। টিপ ফস্টাররা ছিলেন সাত ভাই। তাঁরা প্রত্যেকেই পড়াশুনা করেছেন উস্টারশায়ারের মালভার্ন কলেজে। সাত ভাই ক্রিকেটও খেলেছেন উস্টারশায়ার ও মাইনর কাউন্টির দল মালভার্নের হয়ে। একটা সময় তো উস্টারশায়ারকে লোকে মজা করে বলত ‘ফস্টারশায়ার’। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ম্যাচে চার ফস্টার ভাইয়ের খেলার নজিরও আছে, তাও দুবার!
মালভার্ন কলেজে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে টিপ ফস্টার ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। ১৮৯৭ সালে প্রথমবারের মতো সুযোগ পান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট ক্লাবে। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন এবং গলফেও অক্সফোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
১৮৯৯ সালে উস্টারশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন টিপ ফস্টার ও তাঁর ভাই উইল ফস্টার। হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে কাউন্টি অভিষেকে দুই ভাই-ই হাঁকান সেঞ্চুরি!
১৯০০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধিনায়ক মনোনীত হন টিপ ফস্টার। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির বিপক্ষে ১৭১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েন। ১৯০০-০১ মৌসুমে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ৭৭.৫ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৯৩০ রান; যা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
সে যুগে শৌখিন ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া ‘জেন্টলম্যান’ একাদশের সাথে পেশাদারদের দল ‘প্লেয়ার্স’ একাদশের নিয়মিত সিরিজ আয়োজন করা হত। খেলা হত লর্ডসে, বছরে একবার কি দুবার। তো জেন্টলম্যানদের হয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচেই টিপ ফস্টার উপহার দেন জোড়া সেঞ্চুরি (১০২* ও ১৩৬)।
উস্টারশায়ারের হয়ে সে বছর ফার্স্ট ক্লাস সিজনটাও কেটেছিল দুর্দান্ত। ৭ সেঞ্চুরিসহ ৫৪.৩৬ গড়ে করেছিলেন ১৯৫৭ রান। টিপ ফস্টারের ব্যাটিং নৈপুণ্যে প্রথমবারের মত কাউন্টি শিরোপা জিতেছিল উস্টারশায়ার। যার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বর্ষসেরা ক্রিকেটার মনোনীত করে উইজডেন কর্তৃপক্ষ।
উস্টারশায়ারের হয়ে পরের মৌসুমেও ফস্টার বইয়ে দেন রানের বন্যা। ৬ সেঞ্চুরি ও ১৩ ফিফটিসহ ৫০.৬৬ গড়ে তুলে নেন ২১২৮ রান! অস্ট্রেলিয়া সফরের অ্যাশেজ স্কোয়াডে টিপ ফস্টারের ডাক পাওয়াটা তাই অনিবার্য ছিল। কিন্তু পারিবারিক ব্যবসার কাজে বাইরে থাকায় অস্ট্রেলিয়া সফরটা মিস করে ফেলেন তিনি।
অবশেষে ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বারের মত ডাক পান অস্ট্রেলিয়াগামী অ্যাশেজের দলে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে খেলেন অভিষেক টেস্ট। ইংলিশ সিমারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকরা অল আউট হয় ২৮৫ রানে। জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ডের স্কোর যখন ৭৩/৩, ব্যাটিংয়ে নামেন টিপ ফস্টার।
সেদিন শুরু থেকেই ফস্টার ছিলেন দারুণ আত্মবিশ্বাসী ও স্বচ্ছন্দ। ব্যাটে-বলে টাইমিং হচ্ছিল চমৎকার; খেলা দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে এটা তার প্রথম টেস্ট।
লেন ব্রাউন্ডের সাথে পঞ্চম উইকেট জুটিতে যোগ করেন ১৯২ রান। তারপর ছোটখাটো একটা কলাপ্স! ৩৩২ রান তুলতেই নেই ৮ উইকেট। তারপর শেষ দুই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ফস্টার শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ। ৯ম উইকেট জুটিতে অ্যালবার্ট রেল্ফকে (৩১) নিয়ে ১১৫; এবং উইলফ্রেড রোডসকে (৪০) নিয়ে শেষ উইকেট জুটিতে যোগ করেন ১৩০ রান। অলআউট হবার আগে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫৭৭ রান।
ফস্টার নেমেছিলেন ৫ নম্বরে; শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হলেন তখন স্কোরকার্ডে নামের পাশে লেখা ২৮৭ রান! বিশ্বরেকর্ড! কেননা ইতিমধ্যেই তিনি পেরিয়ে গেছেন টেস্ট অভিষেকে সর্বোচ্চ চার্লস ব্যানারম্যানের ১৬৫ ও টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ বিলি মারডকের ২১১ রানের মাইলফলক দুটি।
মাত্র ১৩ রানের জন্য ট্রিপল সেঞ্চুরি মিস করলেও এ যাবৎ কাল পর্যন্ত এটাই টেস্ট অভিষেকে খেলা ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোন ইংরেজ ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসও এটাই। এবং দুটি রেকর্ডই অক্ষত রয়েছে ১১৭ বছর ধরে।
টিপ ফস্টারের পর অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন আরও চারজন, কিন্তু ফস্টারের ইনিংসটার ধারেকাছেও যেতে পারেনি কেউ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশের বিপক্ষে জ্যাক রুডলফের ২২২।
টিপ ফস্টারের ৪১৯ মিনিট স্থায়ী ইনিংসটিতে ছিল ৩৭টি চারের মার। স্ট্রোক ঝলমলে এই ইনিংসের সৌজন্যেই ৫ উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইংল্যান্ড। ফস্টারের কীর্তির পাশে সেদিন ভিক্টর ট্রাম্পারের অনবদ্য ১৮৫ রানের ইনিংসটাকেও মলিন দেখাচ্ছিল।
ক্যারিয়ারের ডেব্যু অ্যাশেজে টিপ ফস্টারের ব্যাট থেকে এসেছিল ৬০.৭৫ গড়ে ৪৮৬ রান। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা-পূর্ণ সিরিজে শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হেসেছিল সফরকারী ইংল্যান্ড (৩-২)।
ব্যবসার কাজ নিয়ে ব্যস্ততার কারণে পরবর্তী তিন মৌসুম ক্রিকেটে একদমই সময় দিতে পারেননি ফস্টার। লম্বা একটা বিরতির পর কাউন্টি ক্রিকেটে কামব্যাক করেন ১৯০৬ সালে। কেন্টের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই করেন ২৪৬ রান। এত চমৎকার শুরুর পরেও সে বছর ৬টার বেশি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলতে পারেন নি তিনি। পরের মৌসুমে খেলেন মাত্র ২টা ম্যাচ। এর মধ্যেই সমারসেটের বিপক্ষে উপহার দেন ১৯৮ রানের ম্যাচ উইনিং নক।
নিয়মিত ম্যাচ না খেললেও ধারাবাহিক পারফরমেন্সের সুবাদে ১৯০৭ সালে আবারও দলে ফেরানো হয় তাঁকে। সাথে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয় অধিনায়কত্বের বোঝা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন টেস্টের হোম সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দেন টিপ ফস্টার। প্রথম দুই ম্যাচে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও ওভালে সিরিজের শেষ ম্যাচে খেলেন ৫১ ও ৩৫ রানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। ইংল্যান্ড সিরিজ জিতলেও দুর্ভাগ্যবশত ওটাই হয়ে রইল ফস্টারের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট।
১৯০৭-০৮ মৌসুমে আসন্ন অ্যাশেজ সফরের দলেও অধিনায়ক মনোনীত করা হয় টিপ ফস্টারকে। কিন্তু ব্যবসায়িক ঝামেলা ও শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে দল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি।
১৯০৭-১৯১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মাত্র ২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে অংশ নিয়েছেন টিপ ফস্টার। ১৯১০ সালে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ১৩৩ এবং ১৯১২ সালে সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে করেন ২৬ রান।
দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন টিপ ফস্টার। সে যুগে ডায়াবেটিসের ভালো চিকিৎসাও ছিল না। মূলত অসুস্থতার কারণেই আস্তে আস্তে ক্রিকেট, ফুটবলসহ সব ধরনের খেলাধুলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৯১৪ সালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন তিনি।
ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ৮ টেস্টে টিপ ফস্টারের সংগ্রহ ৪৬.৩০ গড়ে ৬০২ রান। এছাড়া ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ২২টি সেঞ্চুরিসহ ৪১.৮২ গড়ে তিনি করেছেন ৯০৭৬ রান। আনকভার্ড ও স্টিকি উইকেটের যুগে তাঁর এই পরিসংখ্যানকে বলতে হবে যথেষ্টই সমৃদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে টিপ ফস্টারের (৪৬.৩০) চেয়ে ভাল ব্যাটিং গড় ছিল কেবল স্যার জ্যাক হবস (৫৭.৩৩) ও স্ট্যানলি জ্যাকসনের (৪৮.৭৯)।
এবারে টিপ ফস্টারের খেলার স্টাইল ও টেকনিক নিয়েও কিছু বলা যাক। সমসাময়িক ক্রীড়ালেখকদের মতে, ফস্টার ছিলেন সহজাত স্ট্রোকপ্লেয়ার। ট্রেডমার্ক শট ছিল লেট কাট। রিস্টি প্লেয়ার হওয়ায় লেগ গ্লান্স ও ফ্লিক শটেও ছিলেন দারুণ পারদর্শী। এছাড়া তাঁর ডিফেন্স ছিল সাউন্ড, কম্প্যাক্ট। একবার সেট হয়ে গেলে তাঁকে আউট করা খুব কঠিন ছিল। ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য বা এলিগেন্সের দিক থেকেও কম যেতেন না তিনি।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ও রাজনীতিবিদ সিবি ফ্রাইয়ের মতে, ‘Blessed with amazing hand-eye coordination and astonishingly supple wrists, Foster was next only to KS Ranjitsinhji in terms of elegance.’
টিপ ফস্টারের টেকনিক সম্পর্কে উইজডেন বলছে, ‘Foster had an impeccable technique, and when he felt like defending there was no contemporary bowler who could get him out easily.’
লেখার শুরুতেই বলছিলাম ফস্টার ক্রিকেটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবলও খেলেছেন। তো তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
ইংল্যান্ডের করিন্থিয়ান্স ক্লাবের হয়ে ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন টিপ ফস্টার। একজন দক্ষ সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার হিসেবে তাঁর বেশ নামডাক ছিল। ভাল ড্রিবলিং করতেন। ক্লাব ফুটবলে ২৬ ম্যাচে করেছেন ২২ গোল।
১৯০০-১৯০২ সালের মধ্যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে পাঁচটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নেন তিনি। ১৯০০ সালের ২৬ মার্চ, ওয়েলসের বিপক্ষে খেলেন অভিষেক ম্যাচ।
ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটি করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে, সাউদাম্পটনে। ম্যাচের ৮১ ও ৮৩ মিনিটে দুটি গোল করেন ফস্টার। একই ম্যাচে ফুলব্যাকের ভূমিকায় খেলেছিলেন সিবি ফ্রাই। ইংল্যান্ড জিতেছিল ৩-০ গোলে। ফস্টার গোল পেয়েছিলেন তার পরের ম্যাচেও, ওয়েলসের বিপক্ষে।
১৯০২ সালের ৩ মার্চ, ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে ফস্টার মাঠে নেমেছিলেন অধিনায়কের বাহুবন্ধনী পরে। ওয়েলসের বিপক্ষে ম্যাচটির ফলাফল ছিল গোলশূন্য ড্র।