এক অভিষিক্ত ডাবল ও বাংলাদেশের দু:স্বপ্ন

২০০৩ সাল, চট্রগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিজে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন দুই প্রোটিয়া ব্যাটার জ্যাক রুডলফ ও বোটা ডিপেনার। মাশরাফি বিন মুর্তজা, এনামুল হক জুনিয়র, তাপস বৈশ্যরা ওভারের পর ওভার করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উইকেটের নাম-নিশানও নাই। আর টিভির পর্দায় চাতক পাখির মত বিরক্তির চোখে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশী সমর্থকরা। অপেক্ষা শুধু একটি উইকেটের। প্রতি মূহুর্তেই অপেক্ষা একটি উইকেটের।

কিন্তু না, উইকেটের দেখা মেলেনি। না সমর্থকদের, না বাংলাদেশের বোলারদের। প্রায় দুইদিন বাংলাদেশের বোলারদের ঘাম ছুটিয়ে ব্যাটিং করে গেছেন রুডলফ, ডিপেনাররা। আদর্শ টেস্ট ব্যাটিং যাকে বলে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলছিলেন রুডলফ। আর অভিষেক ম্যাচেই এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে গড়লেন রেকর্ড। অভিষেকেই দুর্দান্ত এক রেকর্ডের পথে ডিপেনারের সাথে গড়েন মহাকাবিক এক জুটি। যে জুটির কাছে অসহায় ছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা।

২৪ এপ্রিল, ২০০৩। চট্রগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকা। চট্রগ্রামের কাঠফাটা রোদে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।

কিন্তু ব্যাট করতে নেমে পল অ্যাডামসের বিধ্বংসী স্পেলে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির। হাবিবুল বাশার ছাড়া কেউই দাঁড়াতে পারেনি প্রোটিয়াদের বোলিংয়ের সামনে। একপ্রান্তে বাশার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেললেও আরেকপ্রান্তে বাকিরা ছিলেন আসা যাওয়ার মিছিলে। ফলাফল প্রথম দিনেই অলআউট বাংলাদেশ। আশরাফুল-আকরামদের নখদন্তহীন ব্যাটিংয়ে সেদিন মাত্র ১৭৩ রানেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস। অ্যাডামস একাই নেন ৫ উইকেট।

হতশ্রী ব্যাটিং পারফরম্যান্সের পর বিষন্ন মনে থাকা বাংলাদেশের ফিল্ডাররা শেষ বিকেলে দ্রুত দুই উইকেট তুলে নিয়ে খানিকটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিল। তাপস বৈশ্য, মাশরাফি মুর্তজার দুই দুর্দান্ত ডেলিভারিতে ৪১ রানেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিজে তখন অভিষেক হওয়া জ্যাক রুডলফ আর সাথে বোটা ডিপেনার।

বাংলাদেশের জন্য বাকিটা সময় শুধুই বিষাদময়। কাঠফাটা রোদে ইনিংসের বাকি সময়টা শুধুই খাটুনি গেছে বাংলাদেশের বোলারদের। তৃতীয় উইকেট জুটিতে দু’জনে মিলে গড়েন এক মহাকাব্যিক জুটি। এই জুটির সামনে অসহায়ত্ব ছাড়া কিছুই দেখাতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা।

২ উইকেটে ৮৪ রান নিয়ে প্রথম দিনশেষ করে প্রোটিয়ারা। দ্বিতীয় দিনে প্রোটিয়াদের দ্রুত আটকে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই নেমেছিল বাশার-মাশরাফিরা। কিন্তু ভাগ্যটা আর সাথে পায়নি বাংলাদেশ। দ্বিতীয় দিনের পুরোটাই ঘন্টার পর ঘন্টা বল ছুঁড়ে গেছেন বৈশ্য-এনামরা। কিন্তু উইকেটের দেখা আর মেলেনি। বৈশাখের তপ্ত গরমে রুডলফ-ডিপেনাররা একবারের জন্য পা হড়কায়নি। পঞ্চাশের পর ধীরে ধীরে দু’জনেই দেখা পান সেঞ্চুরির। ডিপেনার যখন সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করলেন রুডলফ ততক্ষণে দেড়শোর দ্বারপ্রান্তে।

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে অভিষেকে সর্বোচ্চ রান করা অ্যান্ড্রু হাডসনের ১৬৩ টপকে সেই রেকর্ডে নিজের নাম লিখে ফেললেন রুডলফ। দু’জনের তিনশো রানের জুটির পথে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ডটাও গড়ে ফেলেন দু’জনে। দ্বিতীয় দিনশেষে রুডলফ ১৭০ আর ডিপেনারের সংগ্রহ ১৩১ রান। প্রোটিয়ার ২ উইকেটে ৩৬৪ রানের পথে পাহাড়সম সংগ্রহের ইঙ্গিতটাও দিয়ে ফেলেছেন। সেই সাথে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান জুটি হিসেবে পুরো দিন খেলার কীর্তি গড়েন রুডলফ-ডিপেনার।

দ্বিতীয় দিনের সূর্য তখন অস্তাচলে। বাংলাদেশের বোলারদের চেহারায় হতাশা স্পষ্ট। বিষন্ন মনেই ফিরছিলেন ড্রেসিং রুমে। মাশরাফি, তাপস, এনামদের চেহারাই স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল বাংলাদেশকে কতটা ভুগিয়েছে রুডলফ-ডিপেনার জুটি।

তৃতীয় দিনেও যেন আশাহীন এক বাংলাদেশ। দিনের প্রথম সেশনেই ডাবল সেঞ্চুরির অনন্য মাইলফলকে রুডলফ। ইতিহাসে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে দেখা পেলেন ডাবল সেঞ্চুরির। ডিপেনারও অল্প সময়ের ব্যবধানে দেড়শো পার। বাংলাদেশের বোলারা তখন চাতক পাখির মতই প্রোটিয়াদের ইনিংস ঘোষণার অপেক্ষায়।

তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনেই অবশ্য ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। রুডলফের অপরাজিত ২২২ ও ডিপেনারের ১৭৭ রানের হার না মানা ইনিংসে ২ উইকেটে ৪৭০ রানের পাহাড়সম সংগ্রহে ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। তৃতীয় উইকেটে দু’জনে মিলে গড়েন ৪২৯ রানের রেকর্ডগড়া এক মহাকাব্যিক জুটি। রুডলফ-ডিপেনাররা খেলে গিয়েছিল অবিশ্রান্ত ভাবে। আর গ্যালারি থেকে দর্শকরা হতাশ চোখে অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের আরেক ইনিংস পরাজয়ের।

২৯৭ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট কর‍তে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসেও বাংলাদেশের পথের কাটা পল অ্যাডামস। এই স্পিনারের বিষাক্ত স্পিন বিষে দ্বিতীয় ইনিংসেও নিল বাংলাদেশের ব্যাটাররা। এই ইনিংসেও ধ্বংসস্তূপের মাঝে বাংলাদেশের জন্য পদ্মফুল হাবিবুল বাশার। বাশারে ৭৫ ও জাভেদ ওমরের ৭১ রানের ইনিংসের পরেও অ্যাডামসের ঘূর্ণি জৌলুশে ২৩৭ রানে থামে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস।

দুই দিন বাকি থাকতেই চট্রগ্রাম টেস্টে ইনিংস ও ৬০ রানের দুর্দান্ত এক জয় তুলে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। অধিনায়ক হিসেবে সাদা পোশাকে নিজের প্রথম জয় তুলে নেন গ্রায়েম স্মিথ। দুই ইনিংস মিলিয়ে অ্যাডামস শিকার করেন দশ উইকেট।

এর পাঁচ বছর বাদে ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এমনই এক দু:স্বপ্নময় ম্যাচের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে ৫ উইকেটে জয়ের পর দ্বিতীয় টেস্টে চট্রগ্রামে বাংলাদেশের সামনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ওপেনার স্মিথ ও নিল ম্যাকেঞ্জি। পুরো দিন বাংলাদেশের বোলারদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে বিনা উইকেটে করেন ৪০৫ রান!

যন্ত্রণা, আক্ষেপ আর হতাশা – বাংলাদেশের এই দুই টেস্টের কথা ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আসলেই এই শব্দগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের বেদনাদায়ক কিছু স্মৃতি এখনও ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য দু:স্বপ্নময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link