২০০৭, ‘অন্ধকার’ সেই বিশ্বকাপ ফাইনাল

চড়ামূল্যের টিকেট আর দর্শকদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০০৭ বিশ্বকাপের শুরুর আনন্দটাই যেন মাটি হয়ে গিয়েছিল। খোদ ক্যারিবিয়ানরাই এই নিয়ম মেনে নিতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বকাপ থেকে। রঙচটা শুরুর পর শেষটাও ছিল ক্রিকেটের জন্য অপমানজনক এক কান্ডে। বিব্রতকর এক অবস্থায় সেবার ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বার শিরোপা জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু সেই ফাইনাল জয়টা অস্ট্রেলিয়ার জন্য সহজ ছিল না। শ্রীলঙ্কাকে তারা সহজে হারিয়েছিল। কিন্তু তাদের লড়তে হয়েছিল অন্ধকার আর আম্পায়ারদের খামখেয়ালী ভুলের বিপক্ষে!

৩৩ ওভার শেষে লঙ্কানদের রান তখন ৭ উইকেটে ২০৭। শেষ ৩ ওভারে দরকার ৬৭ রানের। ঠিক সে সময় আকাশ ছেঁয়ে যায় কালো মেঘে। পুরো স্টেডিয়ামে নেমে আসে অন্ধকার। ম্যাচ হবার আর অবস্থা নেই। ডার্কওয়ার্থ লুইস মেথডে অজিরা তখন ৩৭ রানে এগিয়ে।

নিয়ম অনুযায়ী শ্রীলঙ্কা ইনিংসের প্রয়োজনীয়  ২০ ওভার খেলে ফেলেছে। অর্থাৎ ফলাফল নির্ধারণে আর সমস্যা নেই। স্কোরবোর্ডেও অস্ট্রেলিয়াকে অভিনন্দন জানানো হলো। গ্লেন মাকগ্রা, গিলিরা উৎসবে মেতে উঠেছেন। তখনি বাঁধে বিপত্তি। দুই অনফিল্ড আম্পায়ার আলিম দার ও স্টিভ বাকনর জানালেন এখনই উল্লাস নয়! খেলতে হবে বাকি তিন ওভারও।

জানানো হলো তখন না খেলা হলে রিজার্ভ ডেতে এই তিন ওভার খেলা হবে। দুই অধিনায়ক রিকি পন্টিং ও মাহেলা জয়াবর্ধনে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল স্পিনার দিয়ে বল করানো হবে। এরপর অনেকটা অন্ধকারেই খেলা হল ম্যাচের বাকি তিন ওভার। লঙ্কানরা তুলতে পেরেছিল মোটে আট রান। ৫৩ রানের জয়ে টানা তৃতীয়বার শিরোপা জেতে অজিরা।

তবে ম্যাচের পর দর্শকদের সমালোচনার তোপের মুখে পড়েন ম্যাচ অফিসিয়ালসরা। এমন একটা অবস্থায় কেন খেলা চালিয়ে যাওয়া হল সে নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে আইসিসিও। ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আইসিসির ইতিহাসেরই সেরা কিছু মানুষ। আলিম দার, বাকনর ছাড়াও টিভি আম্পায়ার রুডি কোয়ের্জেন, রিজার্ভ আম্পায়ার বিলি বাউডেন ও ম্যাচ রেফারি অভিজ্ঞ জেফ ক্রো থাকা সত্ত্বেও এমন বিব্রতকর অবস্থার সাক্ষী হয় ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল।

কিন্তু আসল ঘটনা কী ছিল? কেনো এই ৩ ওভার খেলানো হলো?

সেদিন কেনিংটন ওভালে ম্যাচের আগ থেকেই বৃষ্টি। যদিও ম্যাচের জন্য রিজার্ভ ডে রাখা ছিল। মুষলধারে বৃষ্টির পর খেলা নেমে আসে ৩৮ ওভারে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের তাণ্ডবময় ১০৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসে নির্ধারিত ৩৮ ওভারে ৪ উইকেটে ২৮১ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। মাঝে বৃষ্টি বাঁধায় আরেক দফা ওভার কমে। ৩৬ ওভারে লঙ্কানদের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ২৬৯। কিন্তু বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে রান রেটের চাপায় আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি শ্রীলঙ্কা।

আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম আম্পায়াররা আমাদের উদযাপন থামানোর জন্য মজা করছে। আমি দারকে বললাম দেখেন আমরা ২০ ওভার খেলে ফেলেছি। আর পর্যাপ্ত আলো নেই। ম্যাচটা শেষ হয়ে গেছে।’

লঙ্কান অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেন, ‘আমরা পুনরায় মাঠে যাওয়ার আগে তৃতীয় আম্পায়ারকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।’

ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো জানান, ‘মূলত ভুলটা ছিল রুডি কোয়ের্জেনের। ডার্কওয়ার্থ লুইস মেথড নিয়মে আসতে হলে কমপক্ষে ২০ ওভার খেলতে হবে উভয় দলকেই। সেই নিয়ম অনুযায়ী দুই দলেরই ২০ ওভার খেলা শেষ। কিন্তু থার্ড আম্পায়ার রুডি কোয়ের্জেন নিয়ম না মেনেই ম্যাচ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কোয়ের্জেনের কাছে নিয়ম সম্বলিত বই থাকার পরেও তিনি এমন ভুল সিদ্ধান্ত নেন।’

এই ঘটনার রেশ এখানে শেষ হয়নি। আম্পায়ার ও অফিশিয়ালদের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনার তোপে সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আইসিসির কাছ থেকে ম্যাচ অফিসিয়ালসদের পাঁচ জনই নিষেধাজ্ঞা পান।

এক বছর আগেই ২০০৬ সালে ওভালে চতুর্থ দিনে চা বিরতির আগে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ আনেন ফিল্ড আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার। পাকিস্তানের শাস্তিস্বরূপ ইংল্যান্ডকে পাঁচ রান প্রদান করা হয় এবং বল পরিবর্তন করা হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম উল হক চা বিরতির পর মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানান। ২৫ মিনিট পর মাঠে নামলেও আম্পায়ারদ্বয় বেল ফেলে দিয়ে বলেন ম্যাচ শেষ!

সেদিনের ঘটনায় ক্রো আরও জানান, ‘মাঝেমধ্যে এমন ভয়েস দরকার যে বলবে হ্যাঁ আমি নিয়ম জানি। হ্যাঁ ম্যাচ রেফারির নিয়ম জানা উচিত। এমন মুহূর্তে বলা উচিত যে না ঠিক না।’

সেবার ২০০৭ বিশ্বকাপে ক্রিকেটবিশ্ব সাক্ষী হয়েছিল এক চরম বিব্রতকর অবস্থার। ক্রিকেটের নিয়ম না মেনে অন্ধকার খেলানো নিয়ে আইসিসি পড়েছিল সমর্থকদের তীব্র সমালোচনার মুখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link