জারেড কিম্বারের একটা পডকাস্ট শুনছিলাম। ভারত চ্যাম্পিয়ন হবার পরে। বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর হচ্ছিল। উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ একটা প্রশ্নে দেখলাম খেপে গেছেন। কিম্বারকে যথেষ্ট মাথা ঠাণ্ডা লোক বলে জানি। খেপলেন কিসে? কোনও এক ভারতীয় মন্তব্য করেছেন, ‘হেনরিক ক্লাসেনের ব্রেনফেড।’
কিম্বার সোজা সুজি খিস্তি করলেন। কোনোদিন শুনিনি। জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ, একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল, স্লো শর্ট, সিক্সথ স্টাম্পে। আপনি কী করতেন? প্রতিটি বল আপনি বাইরে ফেলছেন, বলকে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ দেখছেন, (এটা অবশ্য কিম্বার বলেননি!) এই সময় ওই আপাত ললিপপটাকে কী করতেন? ৩০ বলে ৩০? আপনি যদি ছেড়ে দিতেন তা হলে আপনি মহান, না হলে বাদ দিন!
চোক করা বলাটা আজকাল একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। ২০১৬ সেমি ফাইনালে স্টেইন চোক করেননি। গ্র্যান্ট এলিয়ট ম্যাচ নিয়ে চলে গেছিলেন। ঠিক যেভাবে ১৯৯৬এর কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারা। ঠিক যে ভাবে ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে গেছিল ১৯৯৯এ। অ্যালান ডোনাল্ড ব্যাটার নন, সিদ্ধান্ত নিতে এদিক ওদিক হয়ে গেছিল। ৯৩-এর হিরো কাপেও শচীনকে সামলাতে পারেননি!
ক্লাসেন আজ যা ব্যাট করছিলেন সেটা ভগবানতুল্য! কিন্তু ওই ভুলটা করলেন, বা করতে বাধ্য হলেন। তাতে তাঁর ঐ ইনিংটার গুরুত্ব কমে যায় না।
আজ ১৪ ওভারের পর বিরাট কোহলি মারতে পারেননি। হ্যাঁ পারেননি, বল পুরনো হবার পরে মারা সমস্যা হয়েছে। একমাত্র শিবম দুবে জোনে বল পেলে সেটা বাইরে পাঠিয়েছেন। বাকিদের ১৫ ওভারের পরে সত্যিই সমস্যা হয়েছে। ক্লাসেনেরও। কেন? পুরোটা বলতে পারব না! পিচ সামনে থেকে দেখিনি, হাত ডোবাইনি! তবে মনে হয়েছিল, একটা শুকনো সারফেসকে রোল করে উপরটা শক্ত করে চেপে দেওয়া হয়েছে। নতুন বল বাউন্স পাচ্ছে, কিন্তু পুরনো বল থমকাচ্ছে। জোরে বোলারদের খেলতে অসুবিধা হয়েছে। স্পিন সহজ হয়েছে মারা!
প্রতিটি দলের একটা টুর্নামেন্টের একটা প্ল্যানিং থাকে। ভারতেরও ছিল। ভারতের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল টপ অর্ডারে রোহিত কোহলি! উভয়েই আর আধুনিক টি-টোয়েন্টি খেলার টেম্পলেটে ফিট করেন না। কিন্তু নিজগুণে লেজেন্ড। বিসিসিআই বলে দিয়েছে দলে নিতে হবে, তাই তাঁদেরকে ধরে, তাঁদের বাদ দিয়ে দল তৈরি করেছেন দ্রাবিড়। পান্তকে ৩ নম্বরে আনার সঙ্গে সঙ্গে যশস্বীর ম্যাচ খেলার সম্ভাবনা শূন্য হয়েছে।
৭-১৪’র টেম্পলেটে শিভাম দুবের স্পিন ঠ্যাঙাবার জন্য প্রবেশ। ৪ নম্বরে সূর্য। ফিনিশার হিসাবে হার্দিক, জাদেজা আর পটেল সাব! এর মধ্যে পটেল সাব আশাতীত ব্যাটিং করেছেন। হার্দিক তাঁর ফুল পটেনশিয়ালে ফিরে গেছেন, জাদেজার পারফরম্যান্স একটু হালকা লেগেছে। সিরাজের জায়গায় অর্শদীপ উইকেট টেকার। আর কুলদীপ ও জাসপ্রিত বুমরাহ!
এর পরে রোহিত আর বিরাট যাই করবেন সেটাই ফাউ! আর যেদিন ওঁদের দিন হবে সেদিন বাকিরা তাসাপার্টি বাজাবে! ও সব ছাড়ুন, একটা কথা বলে দিচ্ছি, শেষ পর্যন্ত যে কটাই টেস্ট বা ওয়ানডে বা টি২০ খেলুন না কেন! যশপ্রীত বুমরাহ ভারতের পুরুষদের সর্বকালের সেরা আন্তর্জাতিক বোলার! চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন, কুম্বলে, কপিল ভুলে যান! প্রতিটি ব্যাটারের দুর্বলতা বুঝে, পিচ বুঝে, ম্যাচ সিচুয়েশন বুঝে বল করা এবং প্রতিটি জিনিস সফল করা উপরের যাঁদের নাম করলাম, দীর্ঘসময় ধরে কেউ করেননি! কেউ না!
সেনা দেশগুলি ছেড়ে দিলাম। ভারতের মাটিতে বুমরাহর গড় এবং স্ট্রাইক রেট তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে দেয়! আর গত ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সঙ্গে এই বিশ্বকাপের বুমরাহর পার্থক্য, বুমরাহ যখনই বল করতে এসেছেন, তখনই উইকেট তোলার কথা ভেবেছেন। গত বিশ্বকাপের মতো ডিফেন্সিভ বোলিং করেননি।
আর কুলদীপ। আজ অবশ্য ক্লাসেন ধুনে দিয়েছেন সব স্পিনারদেরই। গড লাইক শটমেকিং। ব্যাক ফুটে এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে ছয়, ব্যাক ফুটে স্ট্রেট ছয়। ফ্রন্ট ফুটের কথা তো বললামই না! হয় তো একটু অ্যাওয়ে ইয়র্কার করতে পারতেন, কিন্তু পিচ যেভাবে প্লে করেছে, তাতে যাই বল হত ক্লাসেন বাইরে টাঙাতেন। এমতবস্থায় হাল না ছাড়া এবং ১৫ ওভারের পর, মিডিয়াম পেস বা এক্সপ্রেস পেসে স্লোয়ার ব্যবহার করলে মারা সহজ হবে না, এইখানেই ভারতীয় দলের কৃতিত্ব!
যদিও ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে বুমরাহকে এক ওভার আগে আনলে হয়তো সহজ হত। হত, অক্সরের ২২ রানের ওভারটা হওয়া সম্ভব হত না। ব্যাটিং-র সময় অক্সরের কথাই চিন্তা করুন। যেভাবে শিবম দুবের রোলটা প্লে করে দিল তা এক কথায় লাজওয়াব! আর কোহলি? গাণ্ডীবে চড়া পড়েছে, ব্রহ্মাস্ত্রগুলিতে মরচে ধরেছে, কাঁধের জোর কমেছে, কব্জির জোর কমেছে। তবুও যে সময় দরকার ছিল ধীরে ধীরে ইনিংস বিল্ডআপ করেছেন।
একটাই অভিযোগ হতে পারে, যে ১০ ওভারের পর থেকে অ্যাক্সিলারেটরে পা দেওয়া হয়তো উচিত ছিল। কিন্তু আপনি আমি মাঠে নেই, তাই বলতে পারব না, কতটা কমপ্লিকেটেড ছিল ব্যাপারটা। তবুও জীবনের শেষ টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকটি খেলে ফেললেন এবং প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হলেন!
রোহিত। এই দলের রোহিত আর দ্রাবিড় হলেন জগাই আর মাধাই! হরিহর আত্মা! কাকে কোন ভূমিকাটা দেওয়া হবে, বিশেষ ট্যালেন্টকে সঠিক জায়গায় মাঠে প্রবেশ করাতে হবে, ম্যাচ আপগুলো ঠিকঠাক করতে হবে আর ফিল্ড প্লেসিং, সেই মতো! রোহিত একটা রিল্যাক্সড পরিবেশ রাখেন যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে!
আর শেষ মেশ ওই স্কাইয়ের ক্যাচটা। নিজে রান পাননি, গত ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা রয়েছে। তার পরেও শেষ ওভারে বলটা লাফ দিয়ে ধরে, তিনটে মেপে মেপে পা ফেলে বলটা আকাশে তুলে দিয়ে ফিরে লাফ দিয়ে ধরলেন। যাঁরা ক্রিকেট দেখতে বসেন শুধু ব্যর্থতার হিসাবে নিতে তাঁরা ওই ক্যাচটার পর প্লিজ খেলা দেখা ছেড়ে দিন! বিশ্বাস করুন, আপনি খেলা না দেখলে জগৎ চরাচরের কিচ্ছুটি মাত্র ক্ষতি হবে না! খালি ফ্রি ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধ করুন!
শেষ বললাম বটে, কিন্তু হার্দিকের কথাটা না বললে অন্যায় হবে! আইপিএলের ব্যর্থতা, ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিয়ে আসা মেঘ, (যেটা নিয়ে উভয়পক্ষেই খাপ বসানো হয়েছে! প্লিজ যাঁরা বসিয়েছেন, প্রত্যেকেই -গেট আ লাইফ! সব কিছু পেরিয়ে যেভাবে ব্যাট ও সীমিত ক্ষমতা নিয়ে বল করে গেছেন, খেলা ছাড়লে সব খিল্লি ভুলে কপিলের পরে ইরফান ছাড়া আমাদের একমাত্র মিডিয়াম পেস বোলিং পুরুষ অলরাউন্ডারের সম্মানে টুপি খোলা তো বনেগা হি!
টুপি আরও একবার খুলুন সাপোর্ট স্টাফদের জন্য প্ল্যানিং তো করবে অধিনায়ক ও কোচরা। কিন্তু সেই প্ল্যানিং এক্সিকিউট করতে যে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার প্রয়োজন হয় সেটা কেন আনাবে! ফিজিও নীতিন প্যাটেল, স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ সোহম দেশাই, বিক্রম রাঠোর, পরশ মামব্রে, দিলীপ, থ্রোডাউন স্পেশালিষ্ট এস রঘু আর সর্বোপরি মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচ প্যাডি আপটন।
১৩ বছর পরে ওয়ার্ল্ড কাপ, ১১ বছর পরে আইসিসি ট্রফি আর পাক্কা সতেরো বছর পরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। রোহিত কোহলিরা জেনারেশনাল ট্যালেন্ট, তাঁদের সমালোচনা পরে করবেন। আগে তাঁদের সাফল্যে খুশি হন, ব্যর্থতায় কাঁধ এগিয়ে দিন সঙ্গে আছেন জানান! মাঠে নেমে যাঁরা রক্ত ঘাম ত্যাগ করেন, তাঁদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা অর্জন করতে একটু সময়ই লাগে। লেগে থাকুন, কিন্তু আজ টিম ইন্ডিয়াকে অভিনন্দন জানান! অনেকগুলো তিরে এসে তরী ডুবেছে। এবারে চাকা ঘোরা শুরু হবে হয়তো!