যুদ্ধের সংহারক শচীন

১৯৯২ এর বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার তখন সদ্য টিন এজ পেরিয়েছেন। বিল ওরিলি তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওহে ছোকরা। এই পাজামা ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করো না। টেস্টে মন দাও। তোমার জন্য অপার ক্রিকেটীয় ঐশ্বর্য্য অপেক্ষা করে আছে।’

এক দিনের ক্রিকেটের বর্তমান উন্মাদনা বা বিশ্বকাপের কৌলিন্য, কোনোটাই দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি ব্র্যাডম্যানের মত সর্বশ্রেষ্ঠ বোলার এর। সেই বছরই তিনি মারা যান। আন্দাজ করার চেষ্টা করছি আজকের ইনিংসটা দেখলে তিনি কি বলতেন। হয়তো আশ্চর্য্য হয়ে যেতেন তথাকথিত পাজামা ক্রিকেটকেও কিভাবে আধিদৈবিক স্তরে উন্নীত করেছেন শচীন তা দেখে।

ব্র্যাডম্যানও এই রকম ইনিংস খেললে গর্বিত হতেন’ জাতীয় বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া কথাগুলোকে আজ কেমন যেন অসাড় লাগছিল। সত্যিই তো, বারবার কেন ব্র্যাডম্যান নামক অতিমানবিক দাড়িপাল্লায় মাপা হবে টেন্ডুলকারকে? তিনি নিজেই তো তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, মাপকাঠি এবং নিজ গুনে অতিমানবিক। আজ যে সব স্ট্রোক তিনি খেলেছেন তা একমাত্র তিনিই খেলতে পারেন।

এতদিন অনেক নিন্দুক শচীনের বড় ম্যাচে খেলতে না পারার পরিসংখ্যান নিয়ে চর্বিত-চর্বন করতেন। আজ মনে হয় তাঁদের ঘরের কোণে আত্মগোপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শোয়েব কে মারা অন ড্রাইভ যদি মাইকেল মধুসূদনের ক্লাসিকাল কাব্য হয়, তবে থার্ডম্যানের ওপর দিয়ে মারা ছক্কাটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শানিত মডার্ন এজ কবিতা।

এই স্ট্রোক দুটি যদি পরবর্তীকালে বিশ্বকাপ আর্কাইভে স্থান না পায় তবে আশ্চর্য্য হব। আজ এক ইংরেজ সাংবাদিক বলছিলেন কাউন্টি ক্রিকেটে মাঠে লোক ফেরানোর জন্য নাকি এই মৌসুম থেকে ২০ ওভারের ক্রিকেট শুরু হবে। এর নেপথ্যে স্টুয়ার্ট রোবার্টসন নামক ইসিবির মার্কেটিং ম্যানেজার। তা স্টুয়ার্ট রোবার্টসনের জন্য আজকের শচীন সংহারমূর্তির চেয়ে বড় প্রমোশন ২০ ওভারের ক্রিকেটের জন্য আর কি হতে পারে সেটা জানা নেই।

ক্রিকেট টাইমলেস টেস্ট থেকে কমতে কমতে ৫ দিনের টেস্ট ও ৫০ ওভারের ওয়ান ডে তে এসে দাঁড়িয়েছে। এরপর ঘরোয়া স্তরে ২০ ওভারের খেলাও শুরু হলে কদিনের মধ্যেই তা আন্তর্জাতিক স্তরেও আসতে বাধ্য। বাণিজ্যিক কারণে ক্রিকেট কমতে কমতে দশ ওভারের খেলা হয়ে গেলেও, যতদিন জগত সংসারে ক্রিকেট নামক খেলা থাকবে ততদিন শচীনের এই ইনিংস সকলের ‘মনে’ থেকে যাবে।

অবশ্য ঘণ্টাচারেক আগেও ভাবা যায়নি ম্যাচের এরকম একটা চিত্র্যনাট্য হবে। বরং পাকিস্তান ইনিংস শেষে সাধারণ দর্শক থেকে ক্রিকেট পণ্ডিত সবারই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা খুব চেনা আতঙ্কের স্রোত বইছিল। এর আগে ভারত-পাক বিশ্বকাপ লড়াইতে পরে ব্যাট করে কেউ জেতেনি। শোয়েব, ওয়াসিম, ওয়াকার তো আছেনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পূর্ববর্তী দু:স্বপ্ন গুলোকে মনে করানোর জন্য। যতই পাল্টা  উইকেট হোক, যতই ভারত সুপারসিক্সে চলে গিয়ে থাক ২৭৩ কম রান নয়।

আর আজ যদি পাকিস্তান জিতে যায়, তবে পাকিস্তানের সুপার সিক্সের দরজা অনেকটা খুলে যাবে। এই অস্ট্রেলিয়া কে কাল ইংল্যান্ড হারাবে সেটা নিতান্তই ভারত সমর্থকদের দুরাশা। তাহলে সুপারসিক্সে উঠেও আবার সেই একই গল্প। সঙ্গী দুই টিমের কাছে হেরে বাকি সব কটা ম্যাচ জিততেই হবে চাপ। আকরাম শুরুও করলেন ভালো।

প্রথম ওভারে শচীন একটা মনোমুগ্ধকর ব্যাকফুট পাঞ্চ মারলেও আকরাম-শচীন দ্বৈরথ প্রথম ওভারের শেষে দাবার ভাষায় স্টেলমেট। দ্বিতীয় ওভারে আখতার আসতেই যেন বাঁধ ভেঙে গেল। যে লড়াই দেখার জন্য দু দেশের জনতা উদগ্রীব হয়ে ছিলেন, শচীন শুরুতেই সেই লড়াইয়ের টুঁটি চেপে ধরলেন। ফলে শোয়েব এরপর সারাদিন কেমন গুঁটিয়ে রইলেন। যদিও শচীনকে সেঞ্চুরির মুখে তিনি আউট করলেন, কিন্তু তখন পাকিস্তানের শিরদাঁড়া মোটামুটি ভেঙে গেছে।

এরপরেও বছর চারেক আগের ভারত হলে কি হত বলা যায় না। কিন্তু বেহালার বাঁ-হাতির ভারত স্কিলে তাদের সমান-সমান বা সামান্য পিছিয়ে থাকলেও বিরাট বড় বুকের খাঁচার অধিকারী। অধিনায়ক নিজে প্রথম বলেই আউট সম্ভবত ভুল সিদ্ধান্তে, শেবাগ কিছু সুন্দর স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে আবার পা না নাড়ানোর ক্রনিক ব্যাধিতে প্যাভিলিয়নে। এই সময় শচীন ছাড়া আর কে জেতাবে? কাইফ এই সময় খেলাটা চমৎকার ধরলেন।

শচীনকে মারতে দিয়ে নিজে স্ট্রাইক রোটেট করায় মন দিলেন। বাকি কাজটা করেন দ্রাবিড় এবং যুবরাজ। তাই দিনের শেষে এই জয় হতে হতেও শচীন এর একার হল না, হলো গোটা ভারতীয় দলের। ঢাকায় এই দুই দলের মধ্যে শেষ ওয়ানডে ম্যাচের পর পাকিস্তান একাদশ খুব একটা বদলায়নি। তাই তারা হয়তো আশা করেনি এতটা বদলে যাওয়া ভারতকে তারা দেখবে।

এবার দক্ষিণ আফ্রিকার পিচ এত চমকে দিচ্ছে যে সস্তার বলিউড থ্রিলার ও তা পারে না। ভারত অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান উইকেট দেখে আজ পাকিস্তান স্পিনার ছাড়া নেমেছিল। সেদিন গিলেস্পি-ম্যাক্গ্রাদের যে লেংথে বল করে ভারতের বিরুদ্ধে মুড়ি-মুড়কির মতো উইকেট তুলতে দেখা গিয়েছিল, এইদিন জহির-নেহরাদের সেই একই বল গুলো তুলে তুলে মেরেছেন আনোয়ার, ইউনুসরা।

আনোয়ার ২০ তম সেঞ্চুরি করলেন, সৌরভ আর তিনি এখন একই সাথে, সামনে শুধু শচীন। আনোয়ার তো বরাবর ভারতের বিরুদ্ধে ভালো খেলেন, কিন্তু আজ যাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল একাই খেলার গতি বদলে দিতে পারেন সেই ইনজামামের রান আউটে দোষী কিন্তু আনোয়ারই। ভুলভাল কলিংয়ে এরকম রান আউট তালতলা মাঠে কোনো অনূর্ধ্ব ষোলো ম্যাচে হলে দুই শিক্ষার্থীকেই হয়তো শাস্তিস্বরূপ গোটা মাঠ চারবার পাক খেতে হত।

এই বিশ্বকাপে ইনজি এর আগে মাত্র দশ রান করেছিলেন চার ম্যাচ মিলিয়ে। কিন্তু সত্যি তার মধ্যে এক অদম্য ইচ্ছা ও সাহস দেখা যাচ্ছিল যখন কুম্বলেকে প্রথম বলেই স্টেপ আউট করলেন। ওই রান আউটটা বোধহয় সৌরভের ভালো ভাগ্যের ফলাফল। ভালো ভাগ্য সেদিন শচীনেরও সঙ্গী ছিল। না হলে ৩২ রানে রাজ্জাক ওরকম লোপ্পা ক্যাচ ছাড়েন না। কিন্তু এটা তো হওয়ারই ছিল। আজ যে ক্রিকেট বরপুত্রেরই দিন। শেষমেশ সেঞ্চুরি টা হল না একদিকে ভালোই। সে যে শুষ্ক পরিসংখ্যানের দিন না, সে ক্রিকেট রোমান্টিকতারও দিন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link