রিও ডি জেনিরো – ব্রাজিলের প্রাণ। সেই প্রাণের হৃদস্পন্দন কোপাকাবানা ও ইপানেমা সমুদ্র সৈকত। তাঁর উত্তরে ছোট্ট এক শহরতলী – পেদ্রো দো সাল। দাসপ্রথার যুগে অসংখ্য আফ্রিকান এখানে এসে জীবন গড়ে।
প্রতি সোমবার রাতে তাঁরা সৈকতে আসতো, গান গাইতো। গানের তালে দুলতো কোমর, নাচতো পা। সেই শরীর দোলানোর নাম সাম্বা। ব্রাজিলের সংস্কৃতিতে এই সাম্বা মিলেমিশে একাকার হয়েছে।
এই জীবনধারাই ব্রাজিলের ফুটবল ঐতিহ্য ও ঘরানা তৈরি করে দিয়েছে। সেই ঘরানার নাম জিঙ্গা। এটা ফুটবলের সেই শিল্প যার মধ্যে মিশে আছে আনন্দ ও ছলনা। এই শিল্পই পেলেকে পেলে বানিয়েছে, গারিঞ্চাকে বানিয়েছে গারিঞ্চা।
১৯ শতকের গোড়ায় ব্রাজিলে যখন ফুটবলের চল হয়, তখন থেকেই এই জিঙ্গা ব্রাজিলের সঙ্গী। শুধু ফুটবল মাঠেই নয়, সংস্কৃতিতেও।
জিঙ্গা মূলত আদি মার্শাল আর্ট ফর্বম ‘ক্যাপোইরা’র পরিবর্তিত রূপ। এর আদিবাড়ি অ্যাঙ্গোলা। এটাকে তাঁরা অনেকটা ধর্মীয় আচারের মত নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছিল। সেখান থেকে পর্তুগিজদের হাত ধরে অনেক কৃতদাস এসেছে ব্রাজিলে। তাঁদের সাথে এসেছে জিঙ্গা।
জিঙ্গার প্রথম স্তর হল হল এই মার্শাল আর্ট। আর দ্বিতীয় স্তর হল সাম্বা। সাম্বা এমন একটা নাচ, যেখানে শরীর সোজা রেখে পায়ের প্রায় প্রতিটা অংশ দিয়ে নানারকম কারুকাজ করা হয়। ফুটবলের ড্রিবলিংও তো তাইই!
এই স্টাইলে ব্রাজিল ১৯৫০ সালে ফাইনালে গিয়েও ব্যর্থ হয়। আলেসান্দ্রো ঘিঘিয়ার গোল জন্ম দেয় ‘মারাকানার কান্না’র। তখন থেকেই ‘এই স্টাইল আর চলে না’ – এমন একটা কানাঘুষা চলছিল। ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে এই স্টাইলে কাউকে খেলতে দেখলেই কোচরা বাঁশি বাজিয়ে থামিয়ে দিতেন – এমনও বলতে শোনা যায়।
তবে, এটা ঠিক যে আলোচিত-সমালোচিত এই ঘরানাতেই ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের ক্ষরা কাটায় ব্রাজিল। বিশ্বের বুকে তখনই প্রথম ‘জিঙ্গা’ কিংবা ‘জোগো বনিতো’ টার্মগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে। সুন্দর ফুটবলের ধারক হয়ে ব্রাজিল এরপর ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপও জিতে।
তখনও ফুটবল ও ফিফা ছিল মূলত ইউরোপিয়ানদের হাতে। ইউরোপিয়ানরা এই ঘরানাকে সমীহ করলেও কখনো গ্রহণ করেনি। ফলে, এর বিশ্বায়ন কখনোই হয়নি।
বলা হয়, এই ‘জিঙ্গা’টা সবচেয়ে ভাল ধারণ করতে পেরেছিলেন জিকো, ফ্যালকাও, সক্রেটিসরা। সত্তুরের শেষ ও আশির গোড়ার এই প্রজন্মটাকে ব্রাজিলের ফুটবলের অন্যতম সেরাও বলা হয়। কিন্তু, তাঁরা পরিকল্পনাহীনতায় বিশ্বকাপ থেকে ফেরে শূণ্য হাতে।
জিঙ্গার কপালে দু:খ শুরু হয় তখন থেকেই। ১৯৭০-এর পর থেকে টানা ২৪ বছর ব্রাজিল কোনো বিশ্বকাপ জিতেনি। আর বিশ্বকাপ জয়টা হল ব্রাজিলের অর্থনীতির মৌলিক চাহিদা। পরে, নব্বই দশকে এসে জিঙ্গার আধুনিকায়ন হয়। তাতে ইউরোপিয়ান রং যোগ হয়।
যার ফলে, ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২ – টানা তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে ব্রাজিল, জিতে দু’টিতে। রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, রোনালদিনহো, কাফু, কাকা – নতুন এক উত্থান দেখে ব্রাজিল।
আর একালের কথা যদি বলা যায়, তাহলে নির্মম সত্যি হচ্ছে – জিঙ্গা এখন আর ব্রাজিলিয়ান ফুচবলের পরিচয় বহন করে না।
২০১৪ বিশ্বকাপে, নিজেদের মাটিমে ব্রাজিল প্রতি ম্যাচে গড়ে ১৪.১ টি ড্রিবল করে। এমনকি এখানে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাও তাঁদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। সবচেয়ে বেশি ড্রিবল করা ফুটবলারদের মধ্যে দশ নম্বরে ছিলেন ব্রাজিলে প্রাণভোমরা নেইমার।
সেবার সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ ব্যবধানে পরাজয় ব্রাজিলকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। অনেকটা ১৯৫০ সালের সেই ফাইনালের পরবর্তী অবস্থার সৃষ্টি করে। সেই শোক কাটিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল প্রতি ম্যাচে গড়ে ১৪.৮ টি ড্রিবল করে। এখানে ব্রাজিল দ্বিতীয়। শীর্ষে থাকা নাইজেরিয়ার প্রতি ম্যাচে গড়ে ড্রিবল সংখ্যা ১৬। এবার ব্রাজিলের যাত্রা শেষ হওয়া কোয়ার্টার ফাইনালে।
সমস্যাটা ড্রিবল করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে নয়, সমস্যাটা হল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ম্যাজিকটা কোচরা ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। ২০১৯ সালের কোপায় ড্রিবলের গড় বেড়ে ১৭.৮-এ পৌঁছায়, ব্রাজিল নেইমারকে ছাড়াই সফলভাবে কোপা আমেরিকা জিতে যায়। বোঝাই যাচ্ছে, সাফল্যের জন্য ব্রাজিলের তারকার চেয়েও বেশি দরকার হারানো সেই ছন্দ!
ব্রাজিলে জিঙ্গা মরে যায়নি পুরোপুরি। তবে, এটা তাঁর আবেদন হারিয়েছে। পুরনো কৌশলে দরকার এবার আরেকটু নতুনত্বের ছোঁয়া। পুরনো তরকারিতেও নতুন করে মসলা দিলে স্বাদ আসে, আর এ তো ফুটবল!