এক চিরশ্রেষ্ঠ ইনিংস

ক্রিকেট বলকে এমন তীব্র গতিতে কেউ মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে দেখেন নি। ফিল্ডিং রত অস্ট্রেলিয়ার দ্বাদশ ব্যক্তি তো জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে সামান্য মনোসংযোগ হারিয়েছিলেন । হঠাৎ দেখলেন বল ছুটে আসছে তাঁর দিকে অতি তীব্র গতিতে। কোনো রকমে মাথা সরিয়ে প্রাণ বাঁচান তিনি। তাই তো এমন ইনিংসের দেখার পরে সারা মাঠের দর্শকদের সাথে সকল অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরাও দাঁড়িয়ে উঠে করতালিতে অভিনন্দিত করেছিলেন ওই পকেট ডিনামাইটকে। ক্যালিপসো দামামার সুরমূর্ছনায় সেদিন মাতাল হয়েছিলো সারা মাঠ।

টেস্ট ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কত অসামান্য ব্যাটিং প্রদর্শনী ঘটেছে তার লেখাজোখা নেই। অসামান্য আর মহান খেলোয়াড়ারা দুর্দান্ত সব ইনিংস উপহার দিয়েছেন। কিন্তু এমন কিছু ইনিংস আছে যা অচিন্ত্যনীয়। ক্রিকেটের ভক্তরা যেগুলি কোনোদিনও ভুলতে পারবেন না। আজ তেমনই এক ইনিংসের গল্প।

১৯৭৫ -৭৬ সালে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিলো অস্ট্রেলিয়া সফরে। সে দলে ছিলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস, লরেন্স রো, গর্ডন গ্রিনিজ, রয় ফ্রেডারিক্স, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং , কিথ বয়েস, বার্নাড জুলিয়েন, ল্যান্স গিবস।

কিন্তু গ্রেগ চ্যাপেলের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া সে সময় অকল্পনীয় ক্রিকেট খেলছে। দুই গ্রেট ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি আর জেফ টমসন তখন তীব্র গতি, স্যুইং আর বৈচিত্র্যে দুনিয়ায় আতঙ্ক তৈরী করেছেন। গ্রেগ ও ইয়ান চ্যাপেল সহ দুর্দান্ত তাদের ব্যাটিং লাইন আপ।

প্রথম টেস্ট ছিলো ব্রিসব্রেনে। লিলি আর টমসনের ভয়ানক গতি আর স্যুইং এর মোকাবিলা করতে না পেরে ম্যাচ হারলো ওয়েস্ট ইণ্ডিজ। ওপেনার গ্রিনিজ দু ইনিংসেই শূন্য করলেন। সে টেস্টে লিলি টমো আর গিলমোরের মিশাইল হানার কোনো জবাব ছিলো না ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের কাছে।

পরের টেস্ট পার্থে। তখন ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে বাউন্সি এবং ফাস্ট পিচ এখানে। অস্ট্রেলিয়া প্রথমদিন প্রথমে ব্যাট করে তুললো ৩১৭-৮। অপরাজিত সেঞ্চুরি করলেন কিংবদন্তি ইয়ান চ্যাপেল। পরের দিন সকালে ইনিংসের পরিসমাপ্তি ঘটলো তাদের। এবার ব্যাট করতে নামবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আগের টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় ওপেনার গ্রিনিজকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়মিত ওপেনার ফ্রেডরিক্সের সাথে কেউ ওপেন করতে যেতে চাইছেন না। কারণ ভয়ঙ্কর লিলি টমসনের নতুন বলের সামনে ওই ফাস্টেস্ট পিচে খোলা মাথায় প্রাণের ঝু্ঁকি নিয়ে কে দাঁড়াবে। শেষ পর্যন্ত পাঠানো হলো অলরাউন্ডার বার্নার্ড জুলিয়েনকে।

ফ্রেডারিক্স অবশ্য নির্বিকার। কারণ ফাস্ট বল তার অতি পছন্দের। ক্রিজে নেমে তিনি ডেনিস লিলির মুখোমুখি। প্রথম বল বাউন্সার। সাপের ছোবলের মতো তীব্র গতিতে ধেয়ে এলো। রক্ষণাত্মক খেললেন ফ্রেডারিক্স। পরের বল আরও তীব্র গতির বাউন্সার। সপাটে হুক করলেন ফ্রেডরিকস। ঠিকমতো ব্যাটেবলে না হলেও বল গেলো গ্যালারিতে। ছক্কা। কী করবেন সেটা লিলিকে জানান দিলেন তিনি। এরপর যা ঘটলো তা কল্পনার বাইরে। কাট, পুল, হুক, ড্রাইভ – ক্রিকেটের যাবতীয় শটের প্রদর্শনী শুরু করলেন ফ্রেডরিকস।

তাঁর ব্যাটের নির্দয় আক্রমণে সবুজ গালিচায় যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। সবুজ মাঠের বুক চিরে তীব্র গতিতে বল ছুটতে লাগলো বাউন্ডারির দিকে। প্রচণ্ড গতিতে (১৫০ কিমি / ঘণ্টার বেশী গতিতে) বল শুরু করলেন টমসন- লিলি । যেন টর্পেডো ছুঁড়ে মারছিলেন তারা। কিন্তু যতো জোরে তারা বল করছিলেন ততো বেশী প্রহার করছিলেন ফ্রেডারিক্স। ৫’৬” উচ্চতার পকেট ডিনামাইট সেদিন তার সর্বোত্তম ছন্দে। বাউন্সার দিতে কার্পণ্য করেন নি অপর দুই ফাস্ট বোলার গেরি গিলমোর ও ম্যাক্স ওয়াকারও।

তাঁদেরও একই পরিণাম ঘটলো। যেন সেদিন ক্রিজে ফ্রেডরিকস শুরু করেছিলেন মহাদেবের প্রলয় নৃত্য। মাত্র ৩৩ বলে অর্ধশতরান করলেন ফ্রেডরিকস । গালিতে ফিল্ডিং করছিলেন অফ স্পিনার অ্যাশলে ম্যালেট। তিনি ভাবছিলেন হয়তো কাট শট তার হাতে আসবে। কিন্তু সে আর হলো কোথায় ! শূন্যে লাফিয়ে উঠে ওই খর্বাকৃতি দানব কাট করছিলেন লিলি টমসনের ভয়ানক গতির শর্ট বলে আর বল তাঁর মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো পয়েণ্ট / থার্ডম্যান বাউণ্ডারীতে। লাঞ্চের আগে ১৪ ওভারে ওয়েস্ট ইণ্ডিজ ১ উইকেটে ১৩০। ফেডরিকস ৮৮ অপরাজিত।

লাঞ্চের পরেও সেই ব্যাটিং সুনামি অব্যাহত রাখলেন ফ্রেডরিকস । এবার তাঁর প্রলয় নাচন থেকে অব্যহতি পেলেন না স্পিনার ম্যালেটও। মাত্র ৭১ বলে সেঞ্চুরি করলেন। বাউন্ডারি দেখে হাততালি দিতে দিতে হাতে ব্যাথা হয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দেরও। সেঞ্চুরির পরেও পকেট ডিনামাইটের ব্যাটের সেই গদ্যময় আক্রমণ অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকলো।

ইয়ান চ্যাপেল তাঁর ভাই গ্রেগকে বলেলেন, ‘রান কতো হলো ?’ তাঁরা স্কোরবোর্ডে তাকিয়ে দেখলেন রান ২০০ পেরিয়েছে। কখন হলো ? চমকে গিয়ে ইয়ান তাকালেন ওভারের দিকে। চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। ওভার মাত্র ২০। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ইয়ান।

ব্যাকফুটের প্রচণ্ডতম খেলোয়াড় ফ্রেডারিক্স শেষ পর্যন্ত থামলেন ১৬৯ রানে। ১৪৫ বলে খেলে। আর আশ্চর্য হবার বিষয় যে ২৭ টি বাউন্ডারি ১ টি ওভার বাউন্ডারিতে সাজানো সে ইনিংসের ১১৪ রান এসেছে চার বা ছয় থেকে।

ক্রিকেট ইতিহাসে ফাস্ট পিচেও অনেক অসামান্য ইনিংস খেলা হয়েছে। কিন্তু এমন প্রভুত্ব ফাস্টেস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে ফাস্টেস্ট পিচে কেউ করেন নি। কেমন দাঁড়িয়েছিলো এই কিংবদন্তি বোলারদের বোলিং গড়। সকলেই ওভারে গড়ে ছয় / সাত রান করে দিয়েছিলেন।

কিংবদন্ডি ব্যাটসম্যান লিন্ডসে হ্যাসেট ( ব্র্যাডম্যানের ১৯৪৬-৪৮ সালের অপরাজেয় টিমের সদস্য) বলেছিলেন ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও এমন দাপুটে ইনিংস অস্ট্রেলিয়ার মাঠে তিনি কখনো দেখেন নি। অন্যতম সেরা ইনিংস।
মনে রাখবেন টমসন ১৬০ কিমি / ঘণ্টা গতিতে যে বল করেছিলেন তা এই ম্যাচে ফ্রেডারিক্সের বিরুদ্ধেই। কিন্তু ফাস্ট বলের বিরুদ্ধে এক শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড় রয় ফ্রেডারিক্স সেদিন যেন তাঁর ব্যাটিং ক্ষমতার শীর্ষে বিচরণ করেছিলেন। শুধু দর্শকরা নয় সেদিন তিনি অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দেরও মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।

ক্রিকেট বলকে এমন তীব্র গতিতে কেউ মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে দেখেন নি। ফিল্ডিং রত অস্ট্রেলিয়ার দ্বাদশ ব্যক্তি তো জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে সামান্য মনোসংযোগ হারিয়েছিলেন । হঠাৎ দেখলেন বল ছুটে আসছে তাঁর দিকে অতি তীব্র গতিতে। কোনো রকমে মাথা সরিয়ে প্রাণ বাঁচান তিনি। তাই তো এমন ইনিংসের দেখার পরে সারা মাঠের দর্শকদের সাথে সকল অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরাও দাঁড়িয়ে উঠে করতালিতে অভিনন্দিত করেছিলেন ওই পকেট ডিনামাইটকে। ক্যালিপসো দামামার সুরমূর্ছনায় সেদিন মাতাল হয়েছিলো সারা মাঠ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...