ম্যাকগ্রার ছোবল – নীলকণ্ঠ শচীন

দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস আছে। তাঁদের প্রথম সমর্থন যদি নিজের দেশের প্রতি থাকে তবে দ্বিতীয় সমর্থন পায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে দল মাঠে নামে তারাই। জোহানেসবার্গের পিচে পরপর তিনটে বল আউট সুইং-এ কেটে যাবার পর চতুর্থ বলটা ইচ্ছে করেই হালকা খাটো লেংথে দিলেন ‘পিজিয়ন’ খ্যাত গ্লেন ম্যাকগ্রা।

শচীন টেন্ডুলকার এটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। পিছন পায়ে পেণ্ডুলামের মতো ঘুরে অফ থেকে টেনে মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে সপাটে পুল। ভারতের প্রথম রান। বাউন্ডারি। উত্তাল জোহানেসবার্গ। উত্তাল একশো কোটির উপমহাদেশ। আসলে ৩৬০ তাড়া করার অসম্ভব প্রত্যাশা আর অস্ট্রেলিয়ার হাতে বিশ্বকাপের মাঝখানে যে একমাত্র অক্ষয় গাণ্ডীবের মতো ঢাল হয়েছিল একটা অবিনশ্বর এম আর এফ ব্যাট তা হয়ত বিধিলিপির মতো স্পষ্ট ছিল কোটি কোটি দর্শকের কাছে। এই একটা কাঁটা উপড়ে ফেলতে পারলেই তৃতীয় বিশ্বকাপ চলে যাবে ডনের দেশে। আর সেই কাঁটাই যদি হন ডন ব্র‍্যাডম্যানের মানসপুত্র?

পিজিয়ন জানতেন শচীন পুলের স্বাদ পেলে তাঁর প্রিয় শটের নেশায় পরের বলে এক বোকামি করবেন না। কিন্তু যদি সেই বল হয় আরেকটু খাটো লেংথে সাজানো শিকারের মতো তুলে দেওয়া হয়?

সেটাই করলেন পিজিয়ন কিন্তু সে খাবারে মিশিয়ে দিলেন মারণ বিষ। হালকা গতির হেরফের। শচীন ভুল শট খেলেননি। কিন্তু মিস হয়ে গেল টাইমিং। শেষ!

বাইশ গজে পিজিয়ন প্রথম ক্রিকেট ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে শারজায়। ম্যাকগ্রা তখন ক্যারিয়ারের চড়াই বেয়ে উঠছেন। দুটো বাউন্সার। একটা ডিপ স্কোয়ার লেগের পাশ দিয়ে পুল করলেন। একটা মিস টাইম হয়ে গ্লাভসে লেগে পিছন দিয়ে চার। তৃতীয় বলটাই প্রমাণ করে দিল ম্যাকগ্রা-শচীন দ্বৈরথই হতে চলেছে আগামী দশবছরের ক্রিকেট অধ্যায়ের সবচেয়ে বর্ণময় অধ্যায়। আবার বাউন্সার। আবার পুল কিন্তু সেই গতির হেরফেরে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ। লড়াইটা পিজিয়ন জিতলেন বটে কিন্তু সচিন মস্তিষ্কে রেকর্ড করে নিলেন সবটা। ঐ কুড়ি বছর বয়সেই।

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ম্যাকগ্রাকে সামনে পেলেন শচীন। সাদাবলে নিজের স্ট্র‍্যাটেজি দ্রুত পালটে নিতেন পিজিয়ন। সচিনের উচ্চতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে বাউন্সারের স্ট্র‍্যাটেজি ওয়ানডেতে পাল্টে তিনি বল ফেলতেন সামনে। কয়েকটা বলের পরই সচিন বুঝে যান স্টান্সে ম্যাকগ্রা ক্রমেই জমিয়ে দিচ্ছেন তাঁকে। ব্যাক অফ দ্যা লেংথ আর গুড লেংথের দোলাচলটা দিয়েই ম্যাকগ্রা নাগপাশের মতো এদিক ওদিক দিয়ে দিয়ে বাঁধতে চাইলেন শচীনকে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট মস্তিষ্কের চালটা বুঝতে দেরী হল না। ম্যাকগ্রার লম্বা লেংথকে সহজ করে নিতে ক্রিজে পজিশন পাল্টে সামনে এগোলেন শচীন। শুরু হল সংহার। কথায় বলে পেস বোলারকে মিডউইকেট দেখানো মানে তাঁর আত্মবিশ্বাস গুঁড়ো করে দেওয়া। সচিন সেই মিডউইকেটের ওপর দিয়ে পেল্লায় ছক্কা হাঁকালেন পিজিয়নের মুখের ওপর। ৯০ রানের ঝকঝকে ইনিংসে ম্যাকগার নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এলেন শচীন। দু’বছর আগের বদলা?

এ লড়াই যে তখন সবে শুরু।

১৯৯৯ সালে বদলাটা সুদে আসলে তুললেন ম্যাকগ্রা। ১৯৯৭-২০০৩ সময়টাকে বলা হয় ম্যাকগ্রার কেরিয়ারের প্রাইম। এ সময়ে বোলিং গড় প্রায় ১৯-এ নামিয়ে আনেন পিজিয়ন। ঘরের মাঠে শচীনকে শূন্যহাতে কট বিহাইন্ড করলেন ম্যাকগ্রা। এবার কিন্তু আর বাউন্সার দিলেন না তিনি। একেবারে শচীনের প্রিয় আউট সাইড অফ স্টাম্প থেকে ছিলাকাটা ধনুকের মতো আউটসুইং করিয়ে তুলে নিলেন উইকেট!

তবে ম্যাকগ্রা-শচীন লড়াইয়ের সবচেয়ে জমাটি পর্ব ছিল ১৯৯৯-২০০০-এর ভারতের অজিসফর আর ২০০১ এর অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফর। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ম্যাকগ্রার ডেরায় শচীন প্রথম অ্যাডিলেড টেস্টে বুঝতে পারেন ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের একমাত্র টার্গেট তিনিই। ম্যাকগ্রা পুরোপুরিভাবেই শচীনের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।

শচীন বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম ম্যাকগ্রা আমাকে দুভাবে টোপ দিচ্ছে ক্রমাগত, এক অফস্টাম্পের বাইরে হাওয়ায় বল আউটসুইং করিয়ে, আর নইলে খাটো লেংথে পুল করার প্রলোভন দিয়ে কিন্তু আমি যদি ধৈর্যের পরীক্ষায় জিতে যাই তাহলে ওদের হাতে আমাকে বধ করার আর কোনো অস্ত্র নেই।’

অ্যাডিলেডে শচীন জিততে পারলেন না। ড্যারেল হারপারের একটা ভুল সিদ্ধান্ত। কিন্তু মেলবোর্নে পরপর চার ওভার সচিন অপেক্ষা করছিলেন। ধৈর্যের পরীক্ষায় তিনি পাল্টা চাপ দিলেন ম্যাকগ্রাকে। বাধ্য করলেন তাঁর পরিচিত মিডস্টাম্প টু স্টাম্প বল ফেলতে এবং দু ইনিংসে তুললেন ১১৬ আর ৫২ রান!

ম্যাকগ্রাকে সপাটে তিনটে চার,আবার সেই ম্যাকগ্রার বলেই লেগগ্লান্স করতে গিয়ে ঈশ্বর বসে পড়লেন ক্রিজে।

২০০১ ভারত সফরের প্রথম টেস্টে মুম্বইতে শচীন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটালেন। ম্যাকগ্রাকে খেলার সময় মিডলস্টাম্প কভার করলেন। সচিন নিজের কেরিয়ারে মিডল স্টাম্প কভারে স্টান্স নিয়েছিলেন ঐ একটিবার। মিডলস্টাম্প কভারের ফলে ম্যাকগ্রাকে লেগস্টাম্পে খেলা অনেক সহজ হয়ে যাবে টেন্ডুলকারের।

কিন্তু কয়েকটা বলের পরেই সচিনের ব্লুপ্রিন্ট পড়ে ফেললেন ম্যাকগ্রা। নিজের চেনা স্টাম্প টু স্টাম্পে তো তিনি ফিরলেনই এবং শুকনো পিচের সুইংকে কাজে লাগিয়ে মিডস্টাম্প কভার করে রাখা পায়ে আছড়ে ফেললেন বিষাক্ত ইনসুইং!

শচীন মুম্বাই আর কলকাতা টেস্টের প্রথম ইনিংসের পর বুঝে গেলেন ম্যাকগ্রা তাঁর মিডল স্টাম্পের স্ট্র‍্যাটেজি ধরে ফেলেছেন তাই আর ফিরলেন না ঐ ভুল পথে। চেন্নাই টেস্টে আবার পুরোনো স্টান্সে ফেরা এবং ফের একবার ম্যাকগ্রাকে চূর্ণ করে ১২৬ রানের ইনিংস!

এই লড়াইয়ের যে কোনো বিজয়ী নেই, কিন্তু শচীনের সুবিশাল ঐশ্বরিক ক্যারিয়ারে ম্যাকগ্রা যে কতখানি কাঁটা ছিলেন তা বোঝা যায় নাইরোবিতে বিখ্যাত ভারত-অস্ট্রেলিয়া আইসিসি নকআউটের ম্যাচ থেকে, ম্যাকগ্রাকে ধ্বংসাত্মক ভঙ্গিতে একের পর এক বাউন্ডারি পার করার পর ৯ বছর আগে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বল – ‘কাম অন!’ চিৎকারটা সুদে আসলে ফিরিয়ে দেন তিনি, শচীনোচিত? একেই বোধ হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা হয়!

টেস্টে ৭ বার, ওয়ানডেতে ৬ বার ঈশ্বরকে ক্রিজে পরাস্ত করেছেন পিজিয়ন। আবার ম্যাকগ্রার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের ব্যাটিং গড় ৪৮+ ধরে রেখেছেন শচীন। ম্যাকগ্রার কোকাবুরা আর শচীনের এমএরএফ-যেন একবিংশ শতাব্দীর দুই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র, যার সংঘর্ষে কেঁপে উঠত বাইশ গজের যাবতীয় কিসসা, মুম্বাই থেকে অ্যাডিলেড, জোহানেসবার্গ থেকে নাইরোবি সচিন-ম্যাকগ্রার মাঝখানের বাইশগজ হয়েছে এক উত্তপ্ত রণাঙ্গন যেখানে কেউ বিজয়ী নয়, জিতে গেছে ক্রিকেট!

ব্রহ্মাস্ত্র আর পাশুপাতের এমন শ্রেষ্ঠ সমাপতন নব্বই-এর দশক দেখেছে, এক প্রজন্ম জুড়ে সচিন-ম্যাকগ্রার লড়াই যেন অর্জুন-কর্ণের মুখোমুখি হওয়া যেখানে আইসিসি নকআউটে শচীনের সামনে মাটিতে বসে গেছে ম্যাকগ্রার আভিজাত্য, আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে একশো কোটির স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে হলুদ বিপ্লবের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে সূতপুত্রের মতো হেঁটে চলে আসছেন ক্রিকেটের রাজকুমার, চেনা গাণ্ডীব হাতে হাসছেন ম্যাকগ্রা!

ম্যাকগ্রার বিষাক্ত ছোবলে কখনো ঘায়েল হচ্ছেন আবার কখনো নীলকণ্ঠ হয়ে উঠছেন ক্রিকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ মহারথী – বাইশগজের ইতিহাসে এই রাজকীয় লড়াই অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে উত্তরপ্রজন্মের জন্য কত গল্প রেখে গেল।

প্রথম প্রকাশ: ময়দান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link