লিভারপুল লিজেন্ড জেমি ক্যারেঘার খুব সুন্দরভাবে অবস্থাটাকে ব্যাখা করেছেন, “গত মৌসুমে ক্লপ যাদের জায়ান্ট বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তারাই আজ মিগেট হয়ে গিয়েছে।”
কথাটা যেভাবেই নিন না কেন, ভেটেরান ক্যারেঘারের কথা ফেলে দেওয়ার মতন না। গত মৌসুমে যে লিভারপুলকে দেখা গিয়েছিল মাঠে, ঠিক তার উল্টোটা দেখা যাচ্ছে এই মৌসুমে।
এই মৌসুমেও তো, ক্রিসমাসের আগে আগে পর্যন্ত অ্যানফিল্ড ছিল চক্রব্যূহ। এখানে প্রবেশের পথ জানা আছে, কিন্তু জিতে ফেরার উপায় নেই। লিভারপুলের মাঠে এসে ১ পয়েন্ট নিয়ে ফিরতে পারলেই যথেষ্ট ছিল প্রতিপক্ষের জন্য। ৬৮ ম্যাচ ধরে অপরাজিত ছিল অ্যানফিল্ডে। কিন্তু সে যেন বহুদূরের স্মৃতি।
আগের লিভারপুল আর এই লিভারপুল যেন মুদ্রার দুই পিঠ; কোনোভাবেই মিল পাওয়া সম্ভব নয়। ৬৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকা লিভারপুল এখন টানা ৬ ম্যাচ ধরে ছোটাচ্ছে নিজেদের পরাজয়রথ। শুনে অদ্ভুত লাগছে?
ক্লাবের ইতিহাসে ঘরের মাঠে এর আগে কখনো টানা পাঁচ ম্যাচ হারেনি তারা। অথচ ক্রিসমাসের পর থেকে টানা ৬ ম্যাচে হেরে বসে আছে তারা। পেনাল্টি ছাড়া ওপেন প্লে থেকে গোলের হিসাব করলে প্রায় ১০ ঘণ্টা গোল করতে ব্যর্থ অল রেডরা।
অথচ এই দলটাই গত মৌসুমে তাণ্ডব চালাচ্ছিল প্রিমিয়ার লিগে। গত ৩০ বছর ধরে যে কাজ করতে পারেনি কেউ, সেটাই করে দেখিয়েছিল ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। কিন্তু কী এমন হলো যে লিগ জেতার ৮ মাসের মধ্যেই সবকিছু উল্টে গেলো রাতারাতি? কী এমন হলো যে সর্বজয়ী লিভারপুল নিজেদের হারিয়ে ফেলল অতল গহীনে?
গ্রেগেনপ্রেসিং এর ক্লান্তি
২০১২ সালে যখন বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড যখন বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল, তখন ফুটবল বিশ্বের নতুন আবিষ্কার ছিল গ্রেগেনপ্রেসিং। বায়ার্নকে প্রায় থামিয়েই দিয়েছিলেন নিজের অসাধারণ ফুটবল দিয়ে। সবসময় প্রেসিং, খেলোয়াড়দের একতা; সব মিলিয়ে গ্রেগেনপ্রেসিং ছিল ক্লপের অন্যতম বড় অস্ত্র। লিভারপুলে এসেও ঠিক একই সূত্র খাটাতে শুরু করেছিলেন ক্লপ। এই ট্যাক্টিসে সাফল্য পাওয়া সম্ভব, কিন্তু প্রয়োজন সময়ের।
সময় দিয়েছিল লিভারপুল বোর্ড, ফলে শিরোপার জোগান দিতে পেরেছেন ঠিকমতো। কিন্তু গ্রেগেনপ্রেসিংয়ে শুধু সময়েই শেষ হয় না, বরং প্রয়োজন হয় অমানুষিক ফিটনেসের। বুরুশিয়ায় যেমন তিন মৌসুমের মাথায় ভেঙ্গে পরেছিল দল, রয়েসের মতন খেলোয়াড় এখনও স্ট্রাগল করেন চোটের সাথে। ক্লপ এবারও ব্যর্থ হয়েছেন এই জায়গা সামাল দিতে।
ক্লপের প্রস্তুতির কমতি ছিল না। স্কোয়াড ডেপথ বাড়িয়েছেন, ভালো ভালো খেলোয়াড় কিনেছেন প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের রেস্ট দিতে। কিন্তু তবুও শেষরক্ষা হয়নি। এক মৌসুমে ২২ চোটের সামনে পরে হচকিয়ে গিয়েছে তারা।
ভার্জিল ভ্যান ডাইক
ক্লপ যখন একজন খেলোয়াড়কে কিনতে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছিলেন শীতকালীন উইন্ডোতে, তখন অনেকেই নাক সিটকেছিলেন। কিন্তু ভ্যান ডাইক তার প্রতিদানে প্রতিটা পয়সা উসুল করে দিয়েছেন। করবেনই না কেন? লিভারপুলে প্রয়োজন ছিল একজন ডিফেন্সিভ লিডার। যে নিচ থেকে শুধু খেলা সামলানো নয় বরং দলকে লিড দিবে। সে জায়গাতে ১০-এ ১০ পেয়েছিলেন ভ্যান ডাইক। কিন্তু তার পুরো মৌশুমের জন্য ছিটকে যাওয়া পুরো দলের মধ্যে বিশাল কতগুলো শূন্যতা তৈরি করেছে, ঠিক যেমনটা ছিল ভ্যান ডাইক আসার আগে।
জমাটবাঁধা ডিফেন্সের কারিগর ছিলেন ভ্যান ডাইক। কিন্তু ভ্যান ডাইক চলে যাওয়ায় ব্যাক-আপ ডাকতে হয়েছে লিভারপুলকে। ফলে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরেছে রাইট ব্যাক ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড। অদ্ভুত শোনালেও সত্য। আগে ভ্যান ডাইক থাকাকালে ট্রেন্টের উপর ডিফেন্সিভ দায়িত্বের পরিমাণ ছিল একেবারেই শূণ্য। অ্যাটাকে সহায়তা করে যদি পারা যায় তবেই ডিফেন্সে এসে হাত লাগাতে হতো তাকে। কিন্তু ডিফেন্সে ভ্যান ডাইক না থাকায় তাকে খেলতে হচ্ছে নিচে নেমে, হাত লাগাতে হচ্ছে ডিফেন্সে। ফলে আশংকাজনকহারে কমেছে ক্রস, সাথে সাথে গোলের জোগানও।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে এরিয়াল উইকনেস। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির একজন দানব ডিফেন্স লাইনে থাকলে সেখানে গোলরক্ষপকের চিন্তা অর্ধেক কমে যায়। অ্যারিয়াল ক্লিয়ারে দল থাকে নিশ্চিন্ত। একই কথা অ্যাটাকের ক্ষেত্রেও, একজন ভালো হেডারই বদলে দিতে পারে ম্যাচের গতিপথ। রিয়ালের সার্জিও রামোসের কথা নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না? কিন্তু ভ্যান ডাইক না থাকাতে সেই জায়গায় খাবি খাচ্ছে লিভারপুল। হেডে বল ক্লিয়ার করা বা থ্রু পাস ইন্টারসেপ্ট করা দুই জায়গাতেই ব্যাপক আকারে ভুগতে হচ্ছে।
সত্যি বলতে ভ্যান ডাইকের ডিফেন্সিভ অ্যাবিলিটি নিয়ে শুধু নয়, বরং লিভারপুল তাদের সেরা খেলোয়াড়ের অ্যাটাকিংটাও মিস করছে বেশ ভালোমতন। পুরো দলের অ্যাটাক গড়ে তোলার কারিগর ছিলের ভ্যান ডাইক। ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে লং পাস কিংবা একটা হেড পুরো ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতো। সে জায়গায় বড্ড অসহায় লিভারপুল। মাঠে একজন লিডার হারানোর কথা নতুন করে নাই বলি।
স্ট্যাবিলিটি
একটি দলের ভালো করার জন্য স্ট্যাবিলিটি খুব বেশি প্রয়োজন। দল যখন জানেই না যে তার পাশে আগামীকাল কে খেলবে, কীভাবে খেলবে, তখন দল পরিচালনা এমনকি খেলোয়াড়েরা নিজেরাই কনফিউজড হয়ে যায়। প্রিমিয়ার লিগে ২৭ ম্যাচে মোট ২০ টি আলাদা সেন্টার-ব্যাক ডুয়ো তৈরি করেছে তারা। এরপর তাদের কাছ থেকে ভালোকিছু আশা করা সত্যিই বেশি কিছু।
ফ্যামিলি
সত্যি বলতে মন ভালো তো সব ভালো। কোনো খেলোয়াড়ের উপর পারিপার্শ্বিক চাপ থাকলে সেখান থেকে ভালো খেলায় মনোযোগ দেওয়া বেশ কষ্টকর। বিশেষ করে কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের জন্য। বেচারা নিজের মায়ের অসুস্থতার খবর চেপে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে কোচিং করিয়েছেন। কাউকে জানতেও দেননি। এমনকি মায়ের মৃত্যুর পর তাকে দেখতে জার্মানিও যেতে পারেননি, কোভিড-প্রটোকলের আওতায় থাকায়।
এমনকি দলের মূল গোলরক্ষক অ্যালিসনও তার বাবাকে হারিয়েছেন কাছাকাছি সময়ে। মোহাম্মদ সালাহর পরিবারের উপর নিয়মিতই ডেথ থ্রেট আসছে। সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও যে বড় প্রভাব পরছে, তা ভুলে যাচ্ছে অনেকেই।
লিভারপুলের জন্য লিগ টাইটেল চেজ করা সত্যিই দূরুহ একটা ব্যাপার। কিন্তু এখনও আশা বেঁচে আছে চ্যাম্পিয়নস লিগে। এখান থেকে উত্তরণের পথ নেই বললে ভুল হবে, কিন্তু এত সবকিছু সামলে যদি কেউ উঠতে পারেন, তবে সেটা ‘দ্যা নরমাল ওয়ান’ খ্যাত ক্লপ পারবেন।