ব্যর্থ, তবে মহাকাব্যিক

ক্রিকেট মানেই রেকর্ডের ছড়াছড়ি। সবাই চায় ব্যক্তিগত রেকর্ড গড়ে দলের জয়ে অবদান রাখতে। তারা ভাগ্যবান যারা বড় ইনিংস খেলে দলকে জোতাতে পারেন। কিন্তু, সবার ভাগ্য এমন হয় না।

অনেক ব্যাটসম্যানকেই দেখা যায়, ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলেও দলকে কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ সে সব মহাকাব্যিক ইনিংস নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।

  • চার্লস কভেন্ট্রি (জিম্বাবুয়ে) – ১৯৪*

২০০৯ সালে বুলাওয়েতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৯৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যান চার্লস কভেন্ট্রি। প্রথমে ব্যাটিং করে তার করা হার না মানা ১৫৬ বলে ১৯৪ রানের ইনিংসে জিম্বাবুয়ে সংগ্রহ করে ৮ উইকেটে ৩১২ রান। কভেন্ট্রি ছাড়া সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়ের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেন স্টুয়ার্ট মাৎসিকেনেরি!

জবাবে তামিম ইকবালের ১৩৮ বলে ১৫৪ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের দিনে ৪ উইকেট ও ১৩ বল হাতে রেখে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ! সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়ের পক্ষে একপ্রান্তে একা হাতে লড়াই করেন কভেন্ট্রি, কিন্তু তার রেকর্ড গড়া তখনকার সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের দিনে জয় পায়নি জিম্বাবুয়ে। এখন পর্যন্ত হেরে যাওয়া ম্যাচে এটি সর্বোচ্চ রানের ইনিংস!

  • শচীন টেন্ডুলকার (ভারত): ১৭৫

২০০৯ সালে হায়দ্রাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রান তাড়া করতে নেমে ১৭৫ রানের ইনিংস খেলেন শচীন টেন্ডুলকার! কিন্তু সে ম্যাচে তার দুর্দান্ত ইনিংসের পরও তার দল হেরে যায় মাত্র তিন রানে! প্রথমে ব্যাট করে শন মার্শের সেঞ্চুরি ও ওয়াটসন-হোয়াইটের ফিফটিতে ৪ উইকেটে ৩৫০ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে শচীন একপ্রান্ত আগলে রাখলেও আরেক প্রান্তে সুরেশ রায়না ছাড়া কেউই বড় স্কোর করতে পারেনি। শচীনের ১৭৫ রানের ইনিংস ছাড়া রায়না করেন ৫৯ রান!

শচীন যখন ব্যক্তিগত ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে আউট হন তখনও দলীয় রান ৭ উইকেটে ৩৩২! ১৭ বলে প্রয়োজন ছিল ১৯ রানের, হাতে তিন উইকেট। তখনো ১৭ বলে ২৩ রানে অপরাজিত ছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা, কিন্তু ৩ বল পরেই তিনিও আউট হলে জয়ের আশা শেষ হয়ে যায় ভারতের! শেষ দিকে প্রাভিন কুমার ৯ রান করলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩ রান পরাজিত হয় ভারত।

শচীনের তখনকার সেরা ইনিংসের দিনে মাত্র তিন রানের শোচনীয় হার টা বেশ কষ্টেরই বটে! পরিস্থিতির বিচারে শচীনের সেই ইনিংসটিকে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসও ধরা হয়!

  • ম্যাথু হেইডেন (অস্ট্রেলিয়া) – ১৮১

২০০৭ সালে হামিলটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ১৮১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন ম্যাথু হেউডেন। তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের দিনে শ্বাসরুদ্ধকর শেষ মূহুর্তে এক উইকেটের জয় পায় কিউইরা। প্রথমে ব্যাট করে হেইডেনের ১৬৬ বলে ১৮১ আর শেন ওয়াটসনের ফিফটিতে ৫ উইকেটে ৩৪৬ রান সংগ্রহ করে অজিরা!

জবাবে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৪১ রানে ৪ উইকেট হারায় কিউইরা! এরপর ১১৬ রানের মধ্যেই নেই ৫ উইকেট। বিশাল লক্ষ্যমাত্রা, তার উপর ব্যাটিং বিপর্যয়! শন টেইট-জনসনদের সামনে কত সময় টিকবে বাকিরা সেটাই ছিল লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এরপরই ৬ষ্ঠ উইকেটে ম্যাকমিলান আর ম্যাককালামের ১৬৫ রানের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় কিউইরা! ম্যাকমিলান ১১৭ রানে ফিরলেও শেষ পর্যন্ত ৮৬ রানে অপরাজিত থাকেন ম্যাককালাম।

দলীয় ৩০৩ রানে ৮ উইকেট হারানোর পর আবারো ম্যাচে কামব্যাক করে অজিরা। কিন্তু মার্ক গিলেস্পির ১৫ বলে ২৮ রানে শেষদিকে জমে ওঠে ম্যাচ! দলীয় ৩৩৯ রানে গিলেস্পি যখন আউট হন কিউইদের প্রয়োজন ছিল ৭ বলে ৮ রান, হাতে এক উইকেট! ৩ বল বাকি থাকতেই ম্যাককালামের ব্যাটে শ্বাসরুদ্ধকর এক উইকেটের জয় তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড।

কিউইরা জিতলেও সে ম্যাচে ম্যাকমিলান কিংবা ম্যাককাকাম কেউই ম্যাচ সেরা পুরষ্কার পাননি। ম্যাচ হারলেও ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৮১ রানের ইনিংস খেলা ম্যাথু হেইডেন হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা!

  • এভিন লুইস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) – ১৭৬

২০১৭ সালে লন্ডনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৭৬ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন ক্যারিবিয়ান ওপেনার এভিন লিউইস। প্রথমে ব্যাট করে লিউইসের ১৩০ বলে ১৭৬ আর জেসন হোল্ডারের ফিফটিতে ৫ উইকেটে ৩৫৬ রানের বড় স্কোর দাঁড় করায় ক্যারিবিয়ানরা। ৭ ছক্কা ও ১৭ চারে সেই ম্যাচে ১৭৬ রান করেন লিউইস! অবশ্য ইনজুরিতে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিংও করতে পারেননি তিনি, না হলে হয়তো তার ইনিংসটি আরো বড় করতে পারতেন। তিনি যখন রিটায়ার্ড হার্ট হন তখনো ইনিংসের ২০ বল বাকি! তিনি থাকলে হয়তো নিজের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাও করে ফেলতেন।

জবাবে ৩৫৭ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ওপেনিংয়ে ঝড় তুলেন জেসন রয়! ৬৬ বলে ৮৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংসে দ্রুত স্কোরবোর্ডে রান তোলেন রয়। তারপরেও দলীয় ১৮১ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ইংলিশরা। তবে ৬ষ্ঠ উইকেটে জস বাটলার ও মঈন আলীর ৭৭ রানের জুটির পর বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে যায়।

ডার্ক ওয়ার্থ লুইস (ডিএলএস) পদ্ধতিতে ইংলিশরা এগিয়ে ছিল ৬ রানে! শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিতে আর খেলা না হলে ইংলিশরা জয় পায় ৬ রানের। ১৭৬ রানের দুর্দান্ত সেই ইনিংসটি ভেস্তে যায় লিউইসের। এটি এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস।

  • ফখর জামান (পাকিস্তান) – ১৯৩

চার এপ্রিল, ২০২১। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯৩ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেলেন ফখর জামান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রেকর্ড গড়ার ম্যাচে বা পেলেন ডাবল সেঞ্চুরি না পেলেন ম্যাচে জয়।

প্রথমে ব্যাট করে টেম্বা বাভুমা-কুইন্টন ডি কক সহ চার ফিফটিতে ৬ উইকেটে ৩৪১ রান সংগ্রহ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। জবাবে ব্যাট করতে নেমে একপ্রান্তে ফখর জামানকে রেখে বাকিরা প্রায় আসা-যাওয়ার মিছিলে ছিলেন। একপ্রান্ত আগলে রেখে ম্যাচে বুক চিতিয়ে একাই লড়াই করেন ফখর! ১৫৫ বলে ১৯৩ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেললেও শেষ পর্যন্ত বাকিদের যোগ্য সমর্থন না পাওয়ায় ১৭ রানে হারে পাকিস্তান।

ফখরের খেলা ১৫৫ বল ছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাবর আজম খেলেন মাত্র ৩৩ বল! অর্থাৎ, পুরো ইনিংসে একাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে লড়াই করেন। শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াই করেন ফখর, কিন্তু ডি ককের চতুরতায় ব্যক্তিগত ১৯৩ রানেই কাটা পড়েন তিনি। রান তাড়ায় এটি সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড! সেই সাথে হেরে যাওয়া দলের পক্ষে এখন সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের স্কোরটিও ফখরের।

ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে দল হেরে গেলেও হেরে যাননি ফখর জামান-ম্যাথু হেইডেনরা। একা হাতে লড়ে যাওয়া একনিষ্ঠ সৈনিক তারা। হয়তো দলের জয়ে অবদান রাখতে পারেননি, কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়াই করে প্রতিপক্ষকে চোখ রাঙাতে পেরেছেন ঠিকই। এই ইনিংসগুলো জেনেও হেরেও হারেনি! ইতিহাসের পাতায় ওয়ানডেতে আক্ষেপের সেরা ইনিংসগুলো থাকলে সেখানে এই ইনিংসগুলো উপরের কাতারেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link