এমন দৃশ্যের দেখা মিলেনি আগে!

এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি, অন্তত ফুটবল মাঠে নয়। মাঠে দর্শক ঢুকে পরা নতুন কিছু নয়, নব্বইয়ের দশকে হরহামেশাই দর্শকদের মাঠে ঢুকে পরার ঘটনা আছে, ক্রিকেটে তো মাঠে ঢুকে গলা মিলিয়ে মাঠে পরিষ্কার করার ঘটনাও আছে, সেটাও খোদ আমাদেরই করা।

কিন্তু মাঠে নেমে মাঠের মালিকদের বিপক্ষে গলা ফাটানোর ঘটনা আগে কখনও দেখেনি পৃথিবী। সেড়িই দেখিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকেরা।

কোভিড পরবর্তী সময়ে মাঠে দর্শক নিষিদ্ধ। প্রতিটি দলই মাঠে নামছে দর্শোক ছাড়া, খেলছে খালি মাঠে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শুরু করতে চেয়েছিল। সেকারণেই লিগ কাপের ফাইনাল থেকে কিছু সংখ্যক দর্শককে মাঠের ছোয়া পাওয়ার সৌভাগ্য করে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু একদিনের মাথাতেই হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো রেড ডেভিল সমর্থকেরা। ম্যানচেস্টার সময়ে বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হওয়ার কথা ছিল মার্সিসাইড ডার্বির। লিভারপুল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড রাইভালরি এবার দেখা যেত দর্শকদের সামনে। লিভারপুল জিতলে শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যেত ম্যানচেস্টার সিটির। কিন্তু এই দিনকেই বেছে নিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকেরা প্রতিবাদের দিন হিসেবে।

ম্যাচ শুরুর প্রায় ৩ ঘন্টা আগে থেকেই মাঠে আসতে থাকে দর্শকেরা। এরপর ওল্ড ট্রেফোর্ডের প্রতিরক্ষা বেষ্টনী পার করে মাঠে ঢুকে পরে দেড়-দুইশ সমর্থক। হাতে ব্যানার, আতসবাজি, সোনালি-সবুজ ফ্লেয়ার। সকলের দাবি একটাই, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মালিকপক্ষ গ্লেজার্স ফ্যামিলির অপসারণ।

শুধু মাঠে ঢুকেই ক্ষান্ত থাকেননি, মাঠে প্রবেশ করে ফুটবল খেলতে শুরু করে দেন অনেকে, কেউ কেউ ছবি তুলে ছড়িয়ে দেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। মাঠের স্টুয়ার্ডরা দেখেছেন সেই দৃশ্য।

বিদ্রোহী লিগখ্যাত ইউরোপিয়ান সুপার লিগে যোগ দেওয়া নিয়ে গ্লেজ়ার পরিবারের বিরুদ্ধে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের ক্ষোভ নতুন নয়। তাঁদের প্রবল চাপেই বিদ্রোহী লিগ থেকে নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ইউনাইটেড। শুধু তাই নয় সপ্তাহখানেক আগে দলের অনুশীলন চলাকালীন ক্যারিংটন গ্রাউন্ডে ঢুকে গ্লেজ়ার পরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন জনা কুড়ি সমর্থক।

তবে এবার ছাড়িয়ে গিয়েছে সকল বাঁধা, এ বার মাঠে ঢুকার সুযোগ পেয়ে পুরো ম্যাচই ভেস্তে দিলেন তাঁরা। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শেষে মাঠ থেকে অপসারণ করা হয় সকল সমর্তজকদের। শুধু তাই নয়, মাঠের আশেপাশের  সকলকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কী বসে থাকবে ইউনাইটেড সমর্থকেরা? বরং আরো এগিয়ে গিয়ে হানা দিয়েছেন তাদের হোটেলে। হোটেলের বিক্ষোভে টনক নড়েছে সকলের। তখনও ম্যাচ শুরু করার পরিকল্পনা ছিল সকলের মাথাতে। কিন্তু এরপরে পুরো ম্যাচই বাতিল করে দেয় ম্যাচ কর্তৃপক্ষ।

ইউনাইটেডের বর্তমান মালিক গ্লেজার্স ফ্যামিলি, আমেরিকার অন্যতম বিত্তশালী পরিবারের একটি। প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক তারা। ২০০৩ সাল থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে যুখ তারা। রখন তারা মালিক ছিল মাত্র ৩.৭%। কিন্তু আস্তে আস্তে সকল শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে একটু একটু করে কিনতে কিনতে ২০০৮ সালে এসে ৯৮% মালিকানা চলে আসে তাদের কাছে।

ফলে ইউনাইটেডের সর্বেসর্বা হয়ে যায় তারাই। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা ঠিক তাদের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে উঠতে থাকে রব, ২০১০ সাল থেকেই। তার নাম দেয় সমর্থকেরা ‘Love United Hate Glazer’। আর তার রং হয় সবুজ সোনালি।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আগের নাম ‘নিউটন হিথ’ ক্লাবের রং ছিল সবুজ-সোনালি। সেখান থেকেই অণুপ্রাণিত হয়ে শুরু হয় এই মুভমেন্ট। ফলে গ্লেজার্সদের সাথে ইউনাইটেড সমর্থকদের দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই। এমনকি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও নাকি দেখতে পারতেন না এই মালিককে।

বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে কেনার চেষ্টা করেছে সমর্থকেরা, কিন্তু কোনোভাবেই এত বড় ক্লাবের বিশাল অংকের টাকা জড়ো করতে পারেনি তারা। কিন্তু তাদের উদ্দীপনা থামেনি, তাদের প্রতিবাদও থামেনি। এর পেছনে কারণও আছে বোইকি।

প্রতিটি দলের মালিক ক্লাবকে সাহায্য করে নিজেদের পকেটের অর্থ দিয়ে, কিন্তু গ্লেজার্স ফ্যামিলি গত ১০ বছরে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে গিয়েছে নিজেদের পকেটে। যা ছিল ক্লাবের নিজেদের আয় করা অর্থ। অর্থাৎ ক্লাবকে নিজেদের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতই ভাবে তারা, এমনকি ক্লাবের টাকা ক্লাবে রাখার ইচ্ছেটুকুই নেই তাদের।

আর সেই কফিনের শেষ পেরেক ছিল ইউরোপিয়ান সুপার লিগ। আর সেটি ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে সমর্থকদের কারণেই। সেই সাথে পদত্যাগ করেছেন এডওয়ার্ড উডওয়ার্ড। সবমিলিয়ে ব্যাকফুটেই আছে বৈকি গ্লেজার্সরা। আর্সেন ওয়েঙ্গার অবশ্য বলেছেন, ‘এই ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়া সমর্থকদেরই আরেকটি বিজয়।’ অর্থাৎ ইউনাইটেডের সমর্থকদের সমর্থন আছে প্রচুর।

এত দিনের প্রতীক্ষা শেষে গ্লেজার্সরা বিদায় বলে কী না তাও একটা প্রশ্ন বটে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link