দ্য ওয়াল, নট আউট ফর এভার!

১.

রিং-এর ভেতর বিশ্বের দুই তাবড় বক্সার। সারাবিশ্ব তাকিয়ে আছে লাল রঙের গ্লাভসগুলোর দিকে। চোয়াল বেয়ে চুইঁয়ে পড়ছে আত্মবিশ্বাস।

বৃদ্ধ বাবার কাছে ছেলে প্রশ্ন করল, ‘বাবা আজ কে জিতবে মনে হয় তোমার?’

‘তোর কী মনে হয়?’

‘জর্জ ফোরম্যানের আক্রমণের সামনে আজ কেউ দাঁড়াতে পারবে না…’ 

‘একটা বক্সিং ম্যাচ কে জেতে? জানিস?’ – বাবার প্রশ্নে ছেলে একটু হকচকিয়ে যায়।

‘যে বেশি আক্রমণ করে ঝাঁঝরা করবে প্রতিপক্ষকে, সে…’

‘ভুল!’

‘মানে?’

‘ম্যাচটা সে-ই জিতবে যে সেই ঝাঁঝরা করা আক্রমণটা সহ্য করে শেষ মিনিট অবধি রিঙ-এর ঠিক মাঝখানটায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।’

– ঐতিহাসিক ম্যাচে বিশ্বের এক নম্বর বক্সার জর্জ ফোরম্যান হেরে গিয়েছিলেন। বিজয়ীর নাম ছিল মোহাম্মদ আলী!

২.

মার্কিন মুল্লুকে ফোরম্যান-আলীর আঁতুরঘর থেকে বহুদূর৷ দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান। কানে বাজছে কথাটা-
‘ম্যাচ সে-ই জিতবে যে শেষ অবধি দাঁড়িয়ে থাকতে জানে…’, ভাবনার ভেতর থেকে ছুঁটে আসছেন অ্যালান ডোনাল্ড। আগুনে বাউন্সার ৷

ভারতের স্কোরকার্ড দেখে বিয়ারের বটল খুলে উদাম নৃত্যে মেতেছে দুই আফ্রিকান যুবক, ডারবানের থমথমে ভারতীয় ড্রেসিংরুম। স্কোরকার্ডে ১৫-৪! প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন শচীন-আজহার-সৌরভ!

হ্যান্সি ক্রনিয়ে হাত নাড়িয়ে লিখছেন, লিখছেন ক্রিকেটের সবচেয়ে লজ্জার ইতিহাসের খসরা। আর তার সেই নারকীয় লেখনীর পাতার ওপর নিজের ব্যাটখানা বারেবারে যেন মেলে দিচ্ছেন এক কন্নড় তরুণ। ডোনাল্ড-ক্লুজনার-পোলক-ডারবানের সবুজ পিচ।

ক্রিজ থেকে ভারতের পতাকাটা মুছে ফেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একেবারে রোগা চেহারার একটা জেদি ছেলে। ৭৩ টা বল পাংচার করার পর অবশেষে হার মানল ২৭ রানে। ভারত গুটিয়ে গেল ৬৬ রানে। ভারতীয় ক্রিকেট হেরেছিল ঠিক তবে স্কোরবোর্ডের তলায় চাপা ৭৩ টা ডেলিভারি ফিনিক্সের মত ফুটে উঠলো। পরবর্তী একদশকে ভারতের অজস্র অসাধারণের মাঝে অতিসাধারণ একটা অধ্যায়ের জন্ম হল যা নন্দিত স্বর্গের জৌলুসের ছিটে ফোটাও না মেখে একেবারে স্বতন্ত্র এক দেয়াল হয়ে রইল। যাতে খোদাই করা থাকল একটা সংখ্যা – ৩১২৫৮!

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ফ্যাকাশে দেয়ালের গায়ে গেঁথে থাকা ডোনাল্ড-ম্যাকগ্রা-লি-আকরাম-ওয়ার্ন-মুরালির ৩১২৫৮ টা ডেলিভারি। সাদাকালো থেকে রঙিন স্ক্রিনের পেছনে ভারী গলাটা ভেসে আসে – ‘ম্যাচটা সে-ই জিতবে যে সেই ঝাঁঝরা করা আক্রমণটা সহ্য করে শেষ মিনিট অবধি রিঙ-এর ঠিক মাঝখানটায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।’

৩.

অস্থির সময়ের ভেতর ক্রমশ নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজের স্ট্যাচু। এর ভেতর আমাদের ছোট্ট ক্রিকেট গ্রাউন্ড। সেখানে আমরা শচীন হতে চেয়েছি কারণ জীবনের প্রতিটা খারাপ সময়কে আমরা বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ভালবাসি।

আমরা সৌরভ হতে চেয়েছি কারণ চোখের বদলে চোখ- এই এক-এক করে দেওয়ার অনন্ত খেলাটায় জিততে চাই প্রতিদিন। আমরা শেবাগ হতে চেয়েছি কারণ ছিটকে ওঠা আতশবাজির আলো চোখে পড়ে চারপাশে সকলে এক মুহুর্তে যখন বলে ওঠে ‘সাবাশ!’,আমরা এই শব্দ-বন্ধটার কাছে নতজানু।

আমরা বিরাট হতে চাই কারণ এক নম্বর হওয়ার জন্য একটা জীবন যথেষ্ট নয় এ কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। আসলে আমাদের চাওয়া আর চাইতে চাইতে পাওয়ার হিসেব ভুলে গিয়ে প্রতিদিন হাততালি আর গ্যালারি জোড়া স্ট্যান্ডিং অভেশন-এর কাছে বারেবারে হেরে যাওয়া আমাদের ভেতরে আস্তে আস্তে মেরে ফেলেছে একটা ছোট্ট ধৈর্য নামক চারাগাছকে।

জীবনের বক্সিং ডে টেস্ট কিংবা মেলবোর্নের কঠিন পিচে এসে তাই আমরা হেরে গিয়েছি প্রতিবার কারণ আমরা কেউ দ্রাবিড় হতে চাইনি। দ্রাবিড় সেখানে কোথাও নেই। দ্রাবিড় সেখানে থাকার কথা বলেন না।

রাজপথে স্লোগানের ঔদ্ধত্যের পেছনে শান্তভাবে চেয়ে থাকা কাঠি আইসক্রিমওয়ালা হয়ে দ্রাবিড় যেন কাঁধে করে বয়ে চলেছেন সভ্যতার বহমানতাকে, সেখানে জৌলুস নেই রয়েছে স্থানু স্বরলিপির বিরুদ্ধে নিস্তব্ধ অথচ চলমান প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদের ভাষা উঠে আসে উইলো কাঠের জঙ্গল থেকে, উঠে আসে একটা পাতলা ব্লেডের ব্রিটানিয়া ব্যাট থেকে, উঠে আসে শুকনো মুখের কারুকাজের মধ্যে থাকা আত্মবিশ্বাস থেকে।

রেডিও থেকে টেলিভিশন হয়ে বুকের বাঁ-পাশ দিয়ে বয়ে যায় চেনা কমেন্ট্রির সুর- ‘সে-ই জিতবে যে শেষ অবধি মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারবে…’

যেভাবে ‘দ্য ওয়াল’ শুনলেই ২৩০০ বছরের চীনের প্রাচীরের আগে মনে আসে নব্বই দশকের একটা মানুষের নাম।

এখানেই তিনি ডোনাল্ড থেকে ওয়ার্ন হয়ে সামলে চলেছেন প্রজন্মের বুলেট, টিকে আছেন, নট আউট হয়ে ক্রিজের পাশে থিতু হয়ে দেখছেন, অন্ধকারের ভেতর স্পষ্ট হচ্ছে সমান্তরাল পৃথিবী যেখানে কোনো সুপারস্টারের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মহাকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link