জুভেন্টাস সমর্থকদের গর্বের জায়গা হলো অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়াম।
২০১১ সালে যখন অ্যাগনেল্লি পরিবার প্রথমবারের মতন জুভেন্টাস সমর্থকদের সামনে নতুন করে তৈরি করা স্টেডিয়াম প্রেজেন্ট করলেন, তখন থেকেই যেন জুভেন্টাসের ভাগ্যের শিকে ছিড়ল। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায় নিয়ে দ্বিতীয় ডিভিশনে অবনমিত হয়ে যাওয়ার কথা ভুলেনি কেউই।
প্রথম ডিভিশনে এসেও নিজেদের হারিয়ে খুঁজছিল জুভেন্টাস। সাত বছর সিরি ‘এ’ শিরোপা ছাড়া থাকার পর শেষমেশ নতুন স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতন শিরোপা উঁচিয়ে ধরার সৌভাগ্য হয় তাদের। আর সেখান থেকেই শুরু হয় স্বপ্নযাত্রা।
ওল্ড লেডিদের গর্বের অন্যতম বড় জায়গা ছিল রাইভাল এসি মিলানকে নিয়ে। নতুন স্টেডিয়ামের বয়স পা দিয়েছে দশে। এতদিনেও এই মাঠ থেকে জয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি মিলান। সেই গর্ব কাটা পড়েছে। এক হারেই অনিশ্চিত হয়ে পরেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবল।
এসি মিলান শুধু জেতেইনি, লজ্জায় ফেলে দিয়েছে পুরো জুভেন্টাসকে। ৩-০ গোলের জয় শুধু জয় ছিল না, ছিল জুভেন্টাস দলের গত দশকের লজ্জাজনক পারফরম্যান্সের একটি। পুরো ম্যাচে মাত্র ১টি শট নিতে পেরেছে জুভেন্টাস; এই মাঠে ১০ বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়নি কখনও। এমন ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে যখন তাদের দলের মূল স্ট্রাইকারের নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো!
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়েছিলেন নতুন চ্যালেঞ্জের নাম নিয়ে। রোনালদোর ইচ্ছে ছিল জুভেন্টাসকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার। চ্যাম্পিয়নস লিগে এক বাইসাইকেল গোল করে জুভেন্টাস সমর্থকদের মন কেড়ে নিয়েছিলেন রোনালদো। আর সেই সমর্থন দেখেই জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
২২ বছর হয়ে গিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা নেই তাঁদের। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে সবচেয়ে বেশিবার হারার রেকর্ডও তাঁদের। ফলে রোনালদো ছিল জুভেন্টাসের সমাধান। চ্যাম্পিয়নস লিগের বরপুত্র এসে জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাবেন, এর থেকে বড় কী-ই বা হতে পারে?
কিন্তু এই মৌসুমে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটেছে। জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবেন কী, জুভেন্টাসকে যে চ্যাম্পিয়নস লিগেই নিতে পারছেন না তিনি। শেষ কয়েক ম্যাচে রোনালদোময় কিছু না করতে পারলে জুভেন্টাসের চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলাটা অসম্ভবই মনে হচ্ছে।
শুধু কী তাই? ৯ মৌসুম ধরে সিরি ‘এ’র শিরোপা নিজেদের করে রেখেছিল জুভেন্টাস, অথচ রোনালদো আসতে না আসতেই হারাতে হয়েছে তা। এমনকি ইতালিয়ান কাপের শিরোপাও পাঁচ মৌসুম ধরে ছিল রোনালদো আসার আগে। রোনালদো আসার পর সেটাও অমাবস্যার চাঁদ।
রোনালদো আসার আগের মৌসুমে জুভেন্টাসের গোলসংখ্যা ছিল ৮২। রোনালদোর কাছে বাদ হওয়ার আগে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছিল তারা। আর এই ৮২ গোলের মধ্যে ৩৫ গোল এসেছিল মিডফিল্ডার আর উইঙ্গারদের কাছ থেকে।
আর পরের মৌসুম থেকে রোনালদোর সতীর্থদের অবস্থা চোখে পরার মতন। রোনালদো যোগ দেওয়ার পরের মৌসুমে জুভেন্টাসের গোলসংখ্যা নেমে আসে ৬৬-তে। আর এই মিডফিল্ডার-উইঙ্গারদের গোলসংখ্যাও নেমে আসে ১৬ তে। এই ৫০ গোলের মধ্যে রোনালদোর ছিল ২৮ গোল।
পরের মৌসুমে তা নেমে ৮ গোলে। যদিও রোনালদোর গোলসংখ্যা ঠিকই বেড়েছে, মোট ৩৫ গোল। কিন্তু পাল্লা দিয়ে কমেছে জুভেন্টাস আর মিডফিল্ডার উইঙ্গারদের গোল। এই মৌসুমে তা কিছুটা বেড়েছে, সবমিলিয়ে ১১ গোল। রোনালদোর গোলসংখ্যাও বেড়েছে।
রোনালদো আসার আগে জুভেন্টাস দল বেশ ডায়নামিক ছিল, ফ্রন্ট থেকে গোল না আসলেও ঠিকই মিডফিল্ড, ডিফেন্স থেকে গোল চলে আসতো। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, রোনালদো নির্ভরতা বেড়েছে। আগের দলে স্ট্রাইকার থাকতো দলের একটা সদস্য হিসেবে, দলের অংশ হিসেবে।
কিন্তু, রোনালদো আসতে না আসতেই ঘুরে গিয়েছে দলের অবস্থা। দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের ভরসার পাত্র হয়ে গিয়েছেন রোনালদো। সেটা অবশ্য ভুল কিছু নয়, কিন্তু তার ভরসায় থাকলে গিয়ে পুরো দলের সকলে হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না।
এমনটা নয় যে জুভেন্টাসের বাকি খেলোয়াড়েরা খুব একটা খারাপ। চিয়েসা, রাবিওত, আর্থুর, রামসে; প্রত্যেকেই নিজেদের প্রামণ করেই জুভেন্টাসের হয়ে নাম লিখিয়েছেন। নিজেদের জায়গা থেকে তাদের ট্যালেন্ট নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন নেই, কিন্তু যখনই সম্মিলিত হয়ে একটা দল হয়ে খেলার কথা আসছে, প্রত্যেকেই যেন মুখ লুকাচ্ছেন রোনালদোর পেছনে।
রিয়ালে থাকাকালীন সময়ে অন্তত ডিফেন্স-মিডের ভরসায় অনেক ম্যাচেই পার পেয়ে যেত তারা। এমনও ম্যাচ গিয়েছে জিনেদিন জিদান তার দলের ভরসায় রোনালদোকে বেঞ্চেও রাখেননি, ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। অথচ জুভেন্টাসেতার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাকে ছাড়া দলের খেলোয়াড়রা যেন গোল করতেই ভুলে যান। তাকে ছাড়া মাঠে নামলে গোল হয়ে যায় অমাবস্যার চাঁদ।
ফলাফল হিসেবে রোনালদো মাইডাস টাচের বদলে হয়ে গিয়েছেন শাখের করাত। অপেক্ষা এখন পরবর্তী মৌসুমের, জুভেন্টাসের শাখের করাত থাকেন না অন্য ক্লাবে ভেড়েন?