আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় একটা সময় দাপট দেখিয়েছে শুটিং। কমনওয়েলথ গেমস, সাফ গেমসে নিয়মিতই স্বর্নের দেখা মিলত। কিন্তু শুটিংয়ের সেই দিন এখন আর নেই। সেখানে জায়গাটা নিয়েছে আর্চারি। বাংলাদেশের পরিবেশে খুব একটা পরিচিত না হলেও আন্তর্জাতিক আসরগুলোতে বাংলাদেশের সবেধন নীলমনির নাম এই খেলাটি।
দুই দশকও হয়নি বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে তীর ধনুকের খেলাটি। এরই মধ্যে প্রায় ৪০টি আন্তর্জাতিক স্বর্নপদক জয়ের রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। অন্য খেলাগুলো যেখানে নিজেদের হারিয়ে খুজছে সেখানে আর্চারি ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগাচ্ছে। সেই আশাটা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। অনেকটা ‘বড়’ স্বপ্ন নিয়ে ১৬ মে বিশ্বকাপ আর্চারিতে খেলতে সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে বাংলাদেশ দল।
দীর্ঘ দেড় বছর পর আর্ন্তজাতিক আসরে খেলার সুযোগ পাচ্ছে লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। তবে প্রত্যাশাটা কোনভাবেই কম নয়। সামনে আরও দুটি বড় প্রতিযোগিতায় নামতে হবে বাংলাদেশকে। আগামী মাসেই ফ্রান্সে বসছে আরেকটি বিশ্বকাপের আসর। এরপর সব ঠিক থাকলে জুলাইয়ে অলিম্পিক গেমস। অনেকটা সময় পর আবারো নিজেদের ব্যস্ত রাখার সুযোগ চলে এসেছে সামনে। সুইজারল্যান্ডের লুজানে অনুষ্ঠিত এবারের আসরটিকে তাই বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের প্রস্তুতির মঞ্চ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাথে ওয়াইল্ড কার্ডের বড় একটা লক্ষ্য তো রয়েছেই।
দেশের প্রথম ও একমাত্র আর্চার হিসেবে বিশ্বকাপে ব্রোঞ্চ পদক জিতে অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা রোমান সানাকে ঘিরে এবারো প্রত্যাশাটা সবচেয়ে বেশি। যদিও দেশে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কয়েকটি আসর থেকে স্বর্ন জিততে পারেননি। বিশেষ করে নবম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস থেকে তো কোন পদকই জিততে পারেননি রোমান! এর আগে দুটি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছে খুলনার ছেলেকে। তবুও তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে সকল প্রত্যাশা।
অনুশীলনে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করার কারণেই বিশ্বকাপে ভাল করতে পারেন বলে আশা ছাড়ছেন না জাতীয় দলের জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ, ‘নিঃসন্দেহে রোমান সানা বাংলাদেশের এক নাম্বার খেলোয়াড়। আমরা তাকে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছি। অনুশীলনে সে আগের ভাল স্কোর করছেন। বিশ্বকাপে এই স্কোর ধরে রাখতে পারলে অলিম্পিক ও আরেকটি বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে পারবে বলেই বিশ্বাস আমার। রোমান তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারবে বলে আমার মনে হয়।’
রোমান নিজেও দমবন্ধ অবস্থা থেকে বের হতে চান। বাংলাদেশ যেমন করে দেড় বছর পর আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিতে যাচ্ছে ঠিক তেমনি রোমানেরও সর্বশেষ ওই আন্তর্জাতিক আসরে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নেপালের পোখরায় আর্চারীর ১০টি ডিসিপ্লিনে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো সবকটি ইভেন্টে স্বর্ন জিতেছিল রোমান সানারা। কমপক্ষে তিনটি স্বর্নে এই আর্চারের সরাসরি ভুমিকা ছিল।
এরপর থেকেই যেন কি হলো তার, নেপাল থেকে দেশে ফিরে খেলছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু ব্যর্থতা তার সাথে আষ্ট্রেপৃষ্টে লেপ্টে আছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একটা বড় সাফল্য পাল্টে দিতে পারে রোমানের ক্যারিয়ার। হয়তো লুজানে হতে পারে সেই সময়। অনুশীলনে বড় স্কোর এখনো স্বপ্ন দেখাচ্ছে রোমানকে নিয়ে। তবে বাংলাদেশ দল শুধু রোমানে পড়ে নেই। দলে চমক হিসেবে রয়েছেন অসীম কুমার দাস।
কম্পাউন্ড ইভেন্টের এই আর্চার অবিশ্বাস্য স্কোর করে জায়গা পেয়েছেন দলে। একক এই ইভেন্টে যেখানে বিশ্বরেকর্ড ৭১৪ সেখানে অসীমের স্কোর ৭০৪! তাহলে বলা যায় রেকর্ডেল খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে রয়েছেন তিনি। ১১ জনের দলে ৮ জন আর্চার রয়েছেন। রিকার্ভ পুরুষে রোমান সানার পাশাপাশি রয়েছেন রাম কৃষ্ণ সাহা, মোহাম্মদ হাকিম আহমেদ রুবেল ও তামিমুল ইসলাম। মেয়েদের রিকার্ভে দলে রয়েছেন বিউটি রায়, দিয়া সিদ্দিকী ও মেহেনাজ আক্তার মনিরা।
এদিকে কম্পাউন্ডে একমাত্র আর্চার হিসেবে দলে সুযোগ পেয়েছেন অসীম।
সাফল্যের চেয়ে স্কোর বাড়াতে বেশি মনযোগ তার। এবারের বিশ্বকাপ আসর ১৭ মে শুরু হয়ে শেষ হবে ২৩ মে। ৩৫ দেশের প্রতিযোগীরা এবারের আসরে অংশ নেবে। লুজানের এই আসরটি ষ্টেজ-২ আর প্যারিসের আর্চারী ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেজ-৩ অনুষ্ঠিত হবে। টোকিও অলিম্পিকের কোটা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই দুটি আসরে খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার আগে তিন দিনের দল নির্বাচনের ট্রায়ালে রোমান সানা ৩৩৩০ স্কোর করে প্রথম স্থান লাভ করেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা হাকিম আহমেদ রবেলের স্কোর ৩২৮৮।
রোমান আবার একদিনে করেছিলেন ৬৭৯ স্কোর, যেখানে জাতীয় রেকর্ড ৬৮৬। রুবেল ৬৮০ স্কোরও করেছিল! এই স্কোর করার পরও লুজানে কোয়াটার ফাইনালে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। তবে পারফরম্যান্স যাই হোক না কেন একটা বিষয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই নির্ভার রয়েছে। কোন প্রকার কোয়ারেন্টিন এ থাকতে হবেনা বাংলাদেশ দলকে।
এ বিষয়ে ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপল বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড আর্চারি আগে থেকেই সিদ্বান্ত নিয়েছে কোন কোয়ারেন্টিন হবেনা। আমাদের খেলোয়াড় বাংলাদেশেই কোয়ারেন্টাইন পালন করছে। সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার পর বিমান বন্দরেই করোনা টেষ্ট করা হবে। টুর্নামেন্ট চলাকালীন হোটেল থেকে ভেন্যুর বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না খেলোয়াড়রা। কারণ কোয়োরেন্টাইনে থাকলে আর্চাররা খেলতে পারবেনা।’
এবারের আসরে রিকার্ভের পুরুষ ও মহিলা একক, দলীয় ও মিক্সড ইভেন্টের পাশাপাশি কম্পাউন্ড এককে অংশ নেবে বাংলাদেশ। আর্চারি দুটি বিশ্বকাপ থেকে টোকিও অলিম্পিকের জন্য রিকার্ভ দলগত পুরুষ ও নারী বিভাগের ২/১টি ওয়াইল্ড কার্ডের প্রত্যাশায় রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও করোনাকালীন সময়ে ভিসা আর বিমান টিকিটের সমস্যার কথা ধারনা করা হলেও শেষে এসে নির্বিঘ্নেই হয়েছে সব। খেলাধুলার অনেক আসরই করোনা ভাইরাসের কারণে বাতিল করা হয়েছে। সেখানে আর্চারী একেবারেই আলাদা। অন্তত:পক্ষে বিমান চলাচল চালু থাকলে কোন আসরই স্থগিত কিংবা বাতিল হবেনা বলে জানা গেছে।
- সুইজারল্যান্ডগামী বাংলাদেশ আর্চারি দল
ডেলিগেশন অফিসিয়াল: কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপল
প্রধান কোচ: মার্টিন ফ্রেডরিক (জার্মানি)
কোচ: জিয়াউল হক
পুরুষ আর্চাের: রোমান সানা, রাম কৃষ্ণ সাহা, হাকিম আহমেদ রুবেল, তামিমুল ইসলাম ও অসীম কুমার দাস (কম্পাউন্ড ইভেন্ট)
মহিলা আর্চার: বিউটি রায়, দিয়া সিদ্দিকী ও মেহনাজ আক্তার মনিরা।