ডার্ক ন্যানেস, ভবঘুরে তারার আক্ষেপ গাঁথা

বরফের দেশে ছুটে চলা কেউ একজন ক্রিকেট মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেনো লাগছে! হিমেল হাওয়ায় বরফে ঢাকা পাহাড়ে স্কি ডাইভ করা মানুষটা গরমেও ২২ গজে বল হাতে ছুটছেন। ঠাণ্ডা-গরম কিছুতেই তিনি দমে যান না!

দুই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছেন এমন বেশ কয়েকজনের একজন হলেন ডার্ক ন্যানেস। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যে নয়জন ক্রিকেটার দুই দেশের হয়ে খেলেছেন এর মধ্যে একজন হলেন তিনি। ওয়ানডেতেও দুই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ১৫ জনের একজন তিনি। পরপর দুই বার দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভিন্ন ভিন্ন দেশের হয়ে খেলা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি।

যে ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ভবঘুরে, ক্লাব ক্রিকেটে তিনি তো তাই যে হবেন – তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জমানার শুরুতে তিনি খেলেছেন দাপটের সাথে। দলগুলোর জন্য রীতিমত হটকেক ছিলেন।

জন্ম অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে হলেও বাবা-মা ডাচ নাগরিক হওয়ায় সেই সুবাধে সহজেই তিনিও নাগরিকত্ব পেয়ে যান নেদারল্যান্ডসের। আর সেই সুযোগে নিজের প্রতিভা দেখিয়ে খেললেন দুইটি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। তার জীবনে একটু ঝুঁকলে জানতে পারবেন তিনি কত প্রতিভা আর গুণের অধিকারী।

তিনি যে শুধু ক্রিকেটার ছিলেন তাই নয়! এছাড়া তিনি কমেন্ট্রি করেছেন, তিনি পেশাদার স্কিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি অধিক দেশের ভাষা রপ্ত করেছেন সেই সাথে তিনি বাদ্যযন্ত্র স্যাক্সোফোনের উপরও শিক্ষা নিয়েছেন।

স্কিয়ার হিসেবে তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। স্কিয়ার হলো যারা বরফের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ জিনিসের উপর ভর করে সহজেই বরফের রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তিনি ‘গ্লোবাল স্নো ট্যুরস’-এর পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতাও হন পরবর্তীতে। সেখানে তিনি স্কিয়ার শিক্ষা দেন। স্কিয়ার বিশ্বকাপেও তিনি অংশ নেন!

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যাক্সোফোনের উপর তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বেশ ভালো স্যাক্সোফোন বাজাতে পারেন! শুধু তাই নয় তিনি সাবলীল ভাবেই জাপানিজ ভাষায় কথাও বলতে পারেন।

স্কিয়ার হিসেবেই মূলত ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ভাগ্য অবশ্য তাকে ক্রিকেটে টেনে আনে। ২০০৫-০৬ সালে ২৯ বছর বয়সে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট দল ভিক্টোরিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন! যে বয়সে ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠ মাতান সে বয়সে সবে মাত্র প্রোফেশনাল ক্রিকেটে পা রাখেন ন্যানিস। এরপর তার পারফরম্যান্স তাঁকে ইংল্যান্ডের কাউন্টিতেও টেনে নেয়। সেখানে মিডলসেক্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।

এরপর চার বছর পর ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে যান এই বাঁ-হাতি পেসার। সেই বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের হয়ে তিনি দুইটি ম্যাচ খেলেন। ভাগ্য যেন খুলে যায় তার! মাত্র দুই মাস না যেতেই একই বছর ডাক পেয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি দলে! একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন তিনি। পরবর্তী বছর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেন তিনি! ১৪ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও ছিলেন তিনি।

সে বছর টি-টোয়েন্টিতে ২৭ উইকেট শিকার করেন ন্যানেস। এবং তখনকার সময়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টিতে এক বছরে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি এই তালিকায় আছেন দুই নাম্বারে৷ এছাড়া পর পর দুই বছর দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার এক অনন্য কীর্তি অর্জন করেন তিনি।

তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার এই উড়ন্ত সূচনা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। টি-টোয়েন্টি তে ২০১০ সালে উড়ন্ত ফর্মে থাকার পরেও একই বছর অক্টোবরে শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে খেলার পর আর জাতীয় দলে সুযোগ মেলেনি এই পেসারের। যেভাবে ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন, উজ্জ্বল আলোয় তার ক্যারিয়ারে যখন আলোকিত হচ্ছিল তখনি এক অদৃশ্য ঝড়ে নিভে যায় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।

নেদারল্যান্ডসের হয়ে দুটি-টোয়েন্টি ম্যাচে এক উইকেট নেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি ২৭ উইকেট শিকার করেন ন্যানেস এবং এক ওয়ানডেতে শিকার করেন এক উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কোনো এক অজানা কারণে লম্বা না হলেও ঘরোয়া এবং ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। খেলেছেন দুইশোর বেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ২১৫ ম্যাচে মাত্র ৭.১৫ ইকোনমিতে নিয়েছেন ২৫৭ উইকেট!

মোট নয়টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন লিগে ভিন্ন ভিন্ন ১৫ টি দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন ডার্ক ন্যানেস। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই সুপার কিংস ও দিল্লী ডেয়ার ডেভিলসের (এখনকার দিল্লী ক্যাপিটালস হয়ে খেলেছেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সিলেট রয়্যালস, বিগ ব্যাশে মেলবোর্ন রেনেগাডস, সিডনি থান্ডার্সের মতো দলের হয়ে তিনি খেলেছেন।

অনেকটা ধমকা হাওয়ার মতোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন তিনি ভালো পারফরম্যান্স করেও ভাগ্য সহায় না হওয়ায় কোনো এক অজানা কালো ছায়ায় ঢেকে যায় তার ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে হয়তো পায়ের ছাপটা স্পষ্ট করতে পারেননি কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন লিগে দাপিয়ে বেড়িয়ে নিজের প্রতিভার আলো দেখিয়েছেন।

বরফের কোনো পাহাড়ে ছুটে বেড়িয়ে হয়তো নিজের ভাগ্য নিয়ে কখনো আফসোসও করতে পারেন। তবে সর্বক্ষেত্রে প্রতিভাবান এই মানুষটির জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অর্জন হয়তো সেই আফসোসকে দূরে ঠেলে দিবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link