জিদান না সিমিওনে – শেষ হাসি কার!

এ বছরের লা লিগাকে ডেভিড ফিঞ্চারের তৈরি করা কোনো ১০ পর্বের থ্রিলার সিরিজ বলে বিক্রি করা হয়, দেদারসে বিক্রি হবে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহও করবে না।

২০২০-২১ মৌসুমের লা লিগাটা তার তৈরি করা কোনো থ্রিলার সিরিজের থেকে কম কিছু ছিল না। মৌসুমের শেষ দিনে এসেও তাই সকলের চোখ টিভি পর্দায় বন্দী। দুই মাদ্রিদের সমর্থকেরা একসাথে নজর রাখবে দুই খেলাতেই। একজনের উপর নির্ভর করছে আরেকজনের ফলাফল। রিয়াল মাদ্রিদ আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ জন্ম দিয়েছে লা লিগার শেষ দিনের থ্রিলারের।

শুরুতে কেউ ঘুণাঘরেও ভাবেনি এমনটা হতে পারে। লা লিগা জুড়ে ছড়ি ঘুরিয়ে চলে বার্সা-রিয়াল। সিমিওনের অধীনে টেক্কা দেওয়ার জায়গাতে এসে পৌঁছেছে অ্যাটলেটিকো। কিন্তু এই মৌসুমটা ছিল তাদেরই। বার্সা-রিয়াল দুই দলই যাচ্ছিল নিজেদের ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে।

একসময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল লা লিগার চ্যাম্পিয়ন হতে চলেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। মৌসুমের মাঝামাঝিতে দ্বিতীয় অবস্থানের থেকে ১২ পয়েন্টের ব্যবধানে সিমিওনের দল। কিন্তু সেখান থেকেই হোঁচট খায় অ্যাটলেটিকো। একের পর এক ম্যাচে পয়েন্ট হারিয়ে সুযোগ করে দেয় লিগের অপর দলগুলোকে।

আর সুযোগের সৎব্যবহার জিনেদিন জিদানের মতন কেই-বা করতে পারেন? তার কোচিং ক্যারিয়ারের ট্যাক্টিসই ছিল অন্যের সুযোগের সদব্যবহার করা। তা দিয়েই সাফল্যের চুড়োয় উঠেছেন রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে। কিন্তু এই মৌসুমটা ঠিক মনমতো হয়নি তার।

শুরু থেকেই একের পর এক ইনজুরি, অফ ফর্মের পাল্লায় পরতে হয়েছে তাকে। প্রথম হাফেই হেরেছেন কার্দিজ, হুয়েস্কার মতন দলের কাছে। কিন্তু এরপরেই ঘুরে দাড়িয়েছে তারা। গত ১৭ ম্যাচে রিয়ালের নেই কোনো হার। ড্র মাত্র ৫ ম্যাচে। মৌসুমের এই জায়গাতেই নিজেদের সেরা খেলাটা দেখিয়েছে তারা, তাও নিজেদের দুই অধিনায়ককে বেশিরভাগ সময় মাঠের বাইরে রেখে।

মাঝে সেভিয়া-বার্সা লা লিগা শিরোপার দাবি নিয়ে আসলেও ধোপে টিকতে পারেনি। শেষমেশ খেলা এসে থেমেছে দুই মাদ্রিদের মাঝেই। যদিও এই ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল ২৩ মে, কিন্তু ভিয়ারিয়াল এই মৌসুমের ইউরোপা ফাইনাল খেলায় তাদের আবেদনে একদিন এগিয়ে আজ রাত ১০টায় মুখোমুখি হবে লা লিগার ২০ দল।

  • শেষদিনের সমীকরণ

প্রতিটি লিগেই শেষদিনের সকল ম্যাচ একত্রে রাখা হয়। যাতে করে অন্য ম্যাচের ফলাফল দেখে আরেকদল সুবিধা নিতে না পারে। ১৯৮২ বিশ্বকাপে জার্মানি-অস্ট্রিয়া কেলেঙ্কারির পর থেকে সবক্ষেত্রেই সকল ম্যাচ একত্রে রাখা হয়। সে অনুযায়ী আজ রাত ১০টায় মাঠে নামবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদ। অ্যাটলেটিকো খেলবে প্রতিপক্ষ রিয়াল ভায়াদোলিদের মাঠে আর রিয়াল খেলবে নিজেদের মাটিয়ে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে।   

অ্যাটলেটিকোর জন্য সমীকরণটা খুবই সহজ। নিজেদের ম্যাচে ফোকাস রাখলেই চলছে তাদের। ম্যাচ জিতলেই শিরোপা। কিন্তু যদি ড্র বা হেরে বসে? তবেও সুওগ থাকছে। তবে সেক্ষেত্রে তাকিয়ে থাকতে হবে রিয়ালের ম্যাচের দিকে। যদি রিয়াল মাদ্রিদ হারে, তবেই শিরোপা নিশ্চিত হবে তাদের।

অন্যদিকে রিয়ালের জন্য সমীকরণ? তাদেরকে নিজেদের ম্যাচ জিততে তো হবেই, সেই সাথে নজর রাখতে হবে অ্যাটলেটিকোর ম্যাচের দিকে। একটা ড্র কিংবা হার তাঁদের হাতে তুলে দিবে লা লিগা শিরোপা।

লা লিগার বর্তমান টেবিলে শীর্ষে আছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। তাদের পয়েন্ট ৮৩। অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ আছে ৮১ পয়েন্ট নিয়ে তাদের নিচে। গোল ব্যবধানে এগিয়ে আছে অ্যাটলেটিকো। কিন্তু লা লিগায় গোল ব্যবধানের থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় হেড-টু-হেড। অর্থাৎ মুখোমুখি হয়ে জয় কাদের বেশি। সেখানেই এগিয়ে রিয়াল। লিগে অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে দুই ম্যাচের একটিতে ২-০ জিতেছে রিয়াল, অন্যটি হয়েছে গোলশূন্য ড্র।

  • প্রতিপক্ষ বিশ্লেষণ

কাগজে-কলমে রিয়ালেরই প্রতিপক্ষই বেশি কঠিন। রিয়াল আজকে মাঠে নামবে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে। দুই দলের আগের দেখায় ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল রিয়াল। মৌসুমের শেষপ্রান্তে এসে ভিয়ারিয়াল টেবিলের ৭ নম্বরে। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে উনাই এমেরির শিষ্যরা। এই মৌসুমের ইউরোপা লিগ ফাইনাল খেলছে তারা। আগামী বুধবার তাঁরা লড়বে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে।

সে ম্যাচ জিতলে আগামী মৌসুমে সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ পাবে তারা। কিন্তু এই ম্যাচ জিতলে সর্বোচ্চ ইউরোপা লিগ খেলার সুযোগ হবে তাদের। তাও যদি চার ও পাঁচ নম্বরে থাকা রিয়াল সোসিয়েদাদ ও রিয়াল বেতিসের কেউ পা হড়কায়। উনাই এমেরির সামনে এখন উভয় শঙ্কট। আজকের ম্যাচ হারলে যদি ইউরোপা লিগ ম্যাচেও পা হড়কায় তবে পরের মৌসুম ইউরোপছাড়া থাকতে হবে তাদের। ফলে উনাই এমেরি তার শক্তিশালী দল নিয়েই নামবেন আজকে।

অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের শেষ ম্যাচের আগে মুখোমুখি হয়েছে এই মৌসুমের ৬৮ নম্বর ইঞ্জুরির। ট্রেনিংয়ে মাসল ওভারলোড হয়ে আজকের ম্যাচে থাকছেন না ইডেন হ্যাজার্ড। তবে থাকা না থাকার বড় প্রশ্ন রিয়াল শিবিরে। আজকের ম্যাচ দিয়েই রিয়ালের হয়ে ইতি টানতে পারেন ৫ জন খেলোয়াড়। অধিনায়ক রামোস, মার্সেলো থেকে শুরু করে ভারানে, ইসকো, ভাজকেজের রিয়াল ছাড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। তাদের কেউ সত্যিই দল ছাড়লে তাদেরকে একটা লিগ শিরোপা দিয়েই বিদায় দিতে চাইবে সতীর্থরা। 

অন্যদিকে অ্যাটলেটিকোর প্রতিপক্ষ কঠিন না হলেও তাদের লড়াইটা সোজা হচ্ছে না। অ্যাটলেটিকো আছে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে, আর ভায়াদোলিদ সবার নিচে। এই মুহূর্তে লিগে ১৯তম অবস্থানে ভায়াদোলিদ। তাদের সাথে আগের দেখায় ১-০ গোলে জিতেছিল অ্যাটলেটিকো।

এই ম্যাচে জিতলে আর ১৭ ও ১৮ নম্বরে অবস্থানে থাকা হুয়েস্কা-এলচে ম্যাচের ফল ভাইয়োদোলিদের পক্ষে এলে আরেক মৌসুমের জন্য লা লিগায় থাকতে পারবে তারা। আর এই সুযোগটা কেই বা মিস করতে চাইবে? তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মালিক রোনালদো লিমার অফার। শেষ ম্যাচ জিততে পারলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্য বিশেষ পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদ লিজেন্ড রোনালদো সে ঘোষণা কেন দিয়েছেন তা নিশ্চয় নতুন করে বুঝিয়ে বলতে হবে না?

ফলে প্রতিপক্ষ কঠিন না হলেও পচা শামুকে পা কাটার সম্ভাবনা আছে অ্যাটলেটিকোর। সে কাঁটা গত ম্যাচেই কাটতে পারতো। ৮০ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে থাকা অ্যাটলেটিকো ম্যাচ জিতেছে শেষ মিনিটের উইনারে। এই ম্যাচে তেমনটা নিশ্চয় চাইবেন না সিমিওনে। সর্বশক্তির দল নিয়েই মাঠে নামবেন সিমিওনে।

শেষ দিনে নাটকীয়টার চুড়ান্তরূপ দেখেছিল বিশ্ব ২০১২ সালে। প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাব দুই প্রান্তে মুখোমুখি হয়েছিল এক শিরোপার জন্য। সেই ম্যানচেস্টার যেন আবার ফিরে এসেছে মাদ্রিদে। রিয়াল-অ্যাটলেটিকো কী পারবে শেষ দিনে নতুন এক নাটকীয়টার জন্ম দিতে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link