গ্রুপ পর্বের ম্যাচে নিউজিল্যান্ড হারিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে, তাই ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালের রোমাঞ্চ বেড়ে গিয়েছিল প্রতিশোধের আহ্বানে। তবে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার দ্বৈরথের ভাগ্য গড়ে দিয়েছেন একজনই – তিনি জেমস ফকনার। ৩৬ রানে তিন উইকেট তুলে নিয়ে কিউই ব্যাটিং লাইনআপকে ধ্বংসস্তুপে রূপ দিয়েছিলেন, সেই সাথে নিশ্চিত করেছিলেন আরো একটা বৈশ্বিক শিরোপা।
ছোটবেলা থেকেই অবশ্য ফকনার এমন ছিলেন; সমবয়সীদের তুলনায় একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী, একটু বেশি অহমিকায় পূর্ণ। নিজেকে ওয়াসিম আকরাম ভাবতেন তিনি, বন্ধুদের বাধ্য করতেন একই রকম ভাবতে। আর এই প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস তাঁকে সাহায্য করতো বড় ম্যাচে, চাপের মুখে পারফরম করার গুণ আয়ত্তে চলে আসে তাঁর।
এই অলরাউন্ডার কখনোই মাথা নত করতে রাজি ছিলেন না, উদযাপনে তাই তিনিই থাকতেন সবার আগে। তাঁর পারফরম্যান্সও ছিল সেরকম, ২০০৯/১০ মৌসুম থেকে শুরু করে টানা তিনবার রাজ্যের সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি স্বরূপ পন্টিং মেডেল নিজের করে নিয়েছিলেন।
না, এই তারকা কখনোই সেই অর্থে ধারাবাহিক ছিলেন না। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে তাঁর ওপর আলাদা করে চোখ পড়তো, তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতে বাধ্য হতেন সবাই। যেসময় দলের প্রত্যেকে কোনরকম গা বাঁচিয়ে খেলতে চাইতো সেসময় তিনি এগিয়ে গিয়ে ছিড়েখুঁড়ে দিতে চাইতেন প্রতিপক্ষকে – এই উগ্রতাই আসলে তাঁকে সাফল্যের পথে নিয়ে গিয়েছে।
ফাইনাল, কিংবা ফাইনালের ওঠার সমীকরণ যখনই সামনে আসলেই এই অজি নিজের সেরা রূপে আবির্ভূত হতেন। তিনি আসলে সবসময় জিততে চাইতেন। তাই তো প্রতিবার শিরোপার লড়াইয়ে কখনো অতিমানবীয় ইনিংস, কখনো বিধ্বংসী স্পেল নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি।
জাতীয় দলে আসার পরও ফকনার নিজের স্টাইল বদলাননি, তবে তিনি পুরো ক্রিকেটবিশ্বের নজর কেড়েছেন ভারত সিরিজে। তৃতীয় ওয়ানডেতে ৪২তম ওভারে উইকেটে এসে ২৯ বলে ৬৪ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলেন তিনি, তাতেই অসম্ভব এক সমীকরণ টপকে জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। পঞ্চম ম্যাচে স্রেফ ৫৭ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করে বনে গিয়েছিলেন অজিদের মাঝে তৎকালীন দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান।
এরপর গাব্বা মহাকাব্য এই বাঁ-হাতিকে বানিয়ে দিয়েছিল মাইকেল বেভানের আদর্শ উত্তরসূরী। মাঝে ২০১৪ সালে চোটের কারণে বড় একটা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েছিলেন তিনি। তবে ফেরাটা ছিল রাজকীয়, বিশ্বকাপের গল্প নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন তিনি।
কখনো হাঁটুর ইনজুরি, কখনো ফর্মের ছন্দপতন – এই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারে বাঁধা এসেছে অনেকবার। যদিও থেমে থাকেননি, নিজের প্রতি তীব্র আত্মবিশ্বাস তাঁকে প্রতিবারই এগিয়ে দিয়েছে বাকিদের চেয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সেই একই আধিপত্য দেখিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু এরপরই পতন ঘটে ফকনারের, তাসমানিয়ার সঙ্গে চুক্তি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। টিম ম্যানেজম্যান্টের সঙ্গে সেই কাঁদা ছোড়াছুড়ি তাঁর জীবনের অন্যতম বাজে অধ্যায় হয়ে আছে। সেটার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার পিএসএলে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি, টুর্নামেন্টের মাঝ পথে ফিরে যান দেশে। পিসিবি সেজন্য নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল তাঁকে। একটা সময়ের পর ধীরে ধীরে নিভে যায় তাঁর উজ্জ্বলতা।
এই কিংবদন্তির বয়স এখন ৩৪ বছর; এর চেয়ে বেশি বয়সী স্টিভ স্মিথ, মিচেল স্টার্ক এখনো সগৌরবে পারফরম করে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি ক্রিকেট দুনিয়া থেকে বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন। যে অহমিকা তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল, সেটাই শেষবেলা তাঁর পতন ডেকে এনেছে।
যদিও তা নিয়ে আক্ষেপ নেই এই অলরাউন্ডারের মনে, ব্যক্তিজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন তিনি, পরিবার নিয়ে সুখেই কাটাচ্ছেন অবসর সময়। স্বল্প সময়ে যে ইম্প্যাক্ট তিনি রেখেছেন সেজন্য চাইলেই তাঁকে মুছে ফেলা যাবে না। শুধু মাঠের পারফরম্যান্স নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বে বিনয় আর উগ্রতার যে অপূর্ব মিশেল রয়েছে সেটা কাছের মানুষদের কাছে অতুলনীয় করে তুলেছে তাঁকে।