১.
এক বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিকের কলমে পড়েছিলাম গল্পটা। ২০০০ সাল। মুম্বাইয়ের বান্দ্রার থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক পরিচিতের বাড়িতে ডিনারে গেছেন সুনীল গাওস্কর৷ বাড়ির প্রত্যেকে উচ্ছ্বসিত।
সুনীল গাভাস্কার পা রাখার পর থেকেই পাড়া-পড়শির ভিড় গেটের বাইরে। ডিনার সেরে সানি উঠে দাঁড়াতেই তার নজরে এল বাড়ির ছোটো ছেলেটিকে। বেচারা কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ভারতের প্রথম ব্যাটিং সুপারস্টারের দিকে। হাতে একটা ব্যাট!
সুনীল গাভাস্কার বুঝলেন বিষয়টা। ছেলেটির কাছে গিয়ে আলতো করে হাঁটু মুড়ে বসে বললেন, ‘আমার নাম শচীন টেন্ডুলকার।’
কড়া জবাব এলো, ‘না! তুমি তো শচীন না…’
নব্বইয়ে জন্মানো এক ক্রিকেট শিক্ষার্থীর চেনা আদলের তালিকায় নেই সুনীল গাভাস্কার, না! সুনীল সেদিন মুচকি হেসেছিলেন শুধু।
২.
এই গল্পটাও সেই লেখকের কলম থেকেই জানা। তাঁর বিখ্যাত একটি ক্রিকেট ইতিহাস বই-এর উদ্বোধনে বক্তৃতা রাখলেন ভারতীয় ক্রিকেটের চলমান ইতিহাসে রা। শচীন-সৌরভ ও ধোনি। অনুষ্ঠান শেষে সেই লেখক বাড়ি ফিরতেই তাঁর ছোট্ট সবে ক্রিকেটের প্রেমে পড়া মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা তুমি তো আসল লোককেই স্পিচ দিতে ডাকলে না! বিরাট ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবলে কীভাবে তুমি?’
এখানেই ক্রিকেট প্রতিদিন বাইশগজের চক্রব্যুহ থেকে হয়ে ওঠে এক চিরবহমান নদী।ষাটের দশকের শেষভাগের মনসুর আলি খান পতৌদিকে যদি আপাতত বাইরে রাখি তাহলে প্রশ্নাতীতভাবে ভারতের ব্যাটিং সুপারস্টার তিনজন। সুনীল গাভাস্কার-শচীন টেন্ডুলকার এবং বিরাট কোহলি।
নব্বইয়ের ছেলেমেয়ের বুকে খোদাই করে দেওয়া ক্রিকেটপ্রেমের নিখুঁত ভাস্কর যদি সচিন হন তাহলে নিশ্চিত তারাও আমার মতোই তাদের বাবার মুখে শুনে থাকবেন, ‘গার্নার-লিলি-হোল্ডিং-কে লোকটা খালি মাথায় খেলে দিল, অ্যান্টিগা বডিলাইন খেলল হেলমেট ছাড়া- এরপরে আর কেউ আসতে পারে? নেভার!’
আমার বাবাকে বলতে শুনেছি গাভাস্কারের কভার ড্রাইভকে নাকি একবার অমৃতবাজার লিখেছিল – ‘যেন আমজাদ আলি খান সরোদে মগ্ন হয়ে তান দিচ্ছেন!’ ভেবে দেখুন এই ড্রাইভটা উনি করছেন আজকের চেয়ে অনেক কঠিন পিচে, অনেক সবুজ টপে, আজকের মতো তিরিশ গজের নিয়ম নেই, হিংস্র টেস্ট ক্রিকেটের আগ্রাসী ফিল্ডের সামনে।
কিন্তু, বাবার শত প্রলোভনও যে আমাকে ক্রিকেট প্রাণমন্ত্রের লেখকরূপে শচীন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে শেখালো না। আমরা তো জানি শিয়ালকোটে ওয়াসিমের সামনে দাঁড়ানো ষোলো বছরের ছেলেটাকে। হয়তো গাভাস্কারের মতো বিনা হেলমেটে খেলেননি কিন্তু তাঁকেও তো ঐ বয়সে খেলতে হল রিভার্স সুইং, চতুর্মুখী পেস আক্রমণের বদলে এলো তিন পেসার-এক স্পিনের গতির সাঁড়াশি। খেলতে হল ওয়ার্ন থেকে মুরালি, ইমরান-আকরাম থেকে ব্রেটলি-ম্যাকগ্রাকে। কী করে ভুলি একটা শারজার মরুঝড়?
যেখানে টনি গ্রেগ প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন কমেন্ট্রি বক্সে? কীভাবে অন্য কিছু ভাবতে পারি যেখানে সেঞ্চুরিয়নের পিচে পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির একজন ব্যাটসম্যান নিজের স্টান্স আর ক্রিজ ব্যবহারের ওপর অদ্ভুত নিয়ন্ত্রণ রেখে অবলীলায় খেলে যাচ্ছিলেন সীমিত ওভার ক্রিকেটে বিশ্বের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ বোলিং আক্রমণকে?
শচীন তো একদিনে শচীন হন নি ,টেথিসের পলি স্ত্বরে স্ত্বরে ভাঁজ পড়ে যেমন হিমালয় দাঁড়িয়েছিল সেভাবেই ক্রিকেটের অতন্দ্র সাধনার ম্যাপ বই বুকে নিয়ে শচীনের বিশ্বদর্শন হয়েছিল, আধুনিক ভারত ও ভারতীয় ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার মধ্যেই কোথাও সচিন সচিন চিৎকার হয়ে উঠেছিল গোটা ভারতের অঘোষিত জাতীয় সংগীত।
অথচ, বিরাট কোহলিকে এই আসন দিতে পারব না আমরা কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম? তারাও তো দেখেছে একটা ছেলে বাবার মৃত্যু শোক বুকে নিয়ে কীভাবে ৯০ রানের ইনিংস খেলতে পারে! কীভাবে বাবার শেষকৃত্য সেরে পরের দিনই রঞ্জির জন্য রওনা দিতে পারেন! সচিন তার পিতৃশোকের পর সাতদিন সময় পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিমান ধরার কিন্তু এই ছেলে যে মানসিকতায় আরও দৃঢ়!
অনেকেই বলেন আজকের ক্রিকেটে বোলিং এর ঝাঁঝ নেই, পিচের হিংস্রতা নেই কিন্তু একজন বিরাট কোহলি হতে গেলে এই প্যারামিটারের বাইরেও আপনাকে একটা পারদস্তম্ভ রাখতে হবে যা বলে দেবে টানা ১০ বছর নিজেকে নিয়মের কঠিন সুতোয় বেঁধে রেখে এই বয়সে সত্তরটা সেঞ্চুরির গল্প।
এখানে কোনো খাদ নেই, কোনো ফাঁকি নেই। প্রত্যেকটা দিন নিজের প্রিয় সামোসা-পাওভাজির লোভ স্যাক্রিফাইস করে তিল তিল করে নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবার ইতিহাস লেখা রয়েছে, লম্বা ইনিংস খেলার জন্য রানিং বিটুইন দ্যা উইকেটসকে ব্যবহার করতে প্রতিদিন কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়া জিমের হিসেব রয়েছে।
সানি বা শচীনের পর ‘বিরাট বিরাট’ চিৎকারকে জাতীয় মন্ত্র করে তুলতে নিজেকে ইশতেহার করে ক্রিকেটের বাউশগজে বিলিয়ে দেবার রূপকথা রয়েছে।
এখানেই হয়ত তাঁরা প্রাসঙ্গিক!
রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন আর শাহরুখ খানের অলিখিত ত্রিভূজের তিনবিন্দুতে থাকা তিন জাদুকর যেমন তাঁদের প্রজন্মকে নিজেদের আঙুলের ঈশারায় সম্মোহিত করেছেন, সানি-শচীন-বিরাটের ব্যাট সেভাবেই প্রজন্মের কাছে হয়েছে জিয়নকাঠি।
এখানে কোনো তুলনা নেই, কোনো পরিসংখ্যানের খচখচানি নেই, কোনো বিতর্কের কফি কাপ নেই রয়েছে এক জীবনে তিন প্রজন্মের বাইবেলকে আত্মস্থ করার আনন্দ। প্রত্যেক প্রজন্মের লুকোনো ঝিনুকের ভেতর ভরা থাকে তাদের রঙিন সুপারস্টারের পোস্টার, সেখানে খুব দৃঢ়ভাবেই অস্তিত্ব নেই তার পূর্ব বা উত্তরসূরীর, সে তাঁর গোপনপ্রেমের আস্তানা, তার আগলে রাখা যকের ধন।