চলুক স্মিথের চাকা

স্টিভ স্মিথ লোকটা বড্ড অগোছালো। অজি সাজঘরের সম্ভবত সবচেয়ে অগোছালো ব্যক্তিটা তিনিই। খানিকটা অলসও বটে৷ যে কারণে একটা ব্যাট উপহার দেওয়ার বিনিময়ে সবশেষ অ্যাশেজে নিজের কিটব্যাগ গোছানোর ‘গুরুদায়িত্ব’টা তিনি তুলে দেন সতীর্থ মার্নাস লাবুশেনের কাঁধে। লাবুশেনও সাদরে দায়িত্বটা গ্রহণ করেন এই বলে যে, ‘এটা চলতি গ্রীষ্মের অন্যতম সেরা একটা ডিল’।

আসলে উপরের সবগুলো ছিল মাঠের বাইরের ঘটনা। মাঠের ভিতরে কিন্তু তিনি ১৮০ ডিগ্রি উলটো। কেননা মাঠের বাইরের এলোমেলো এই লোকটা মাঠে নামলেই গোছানো ও পরিপাটি ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী খুলে বসেন। সাজঘরের অলস এই ব্যক্তিটাই আবার নেটে বিরামহীনভাবে দলের বাদবাকিদের চেয়ে শয়ে শয়ে বল বেশি খেলেন। যে কারণে একদিন অস্ট্রেলিয়ার হেড কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার তো বলেই বসেন, ‘আপনি স্মিথের সাথে নেটে যাবেন এবং মিলিয়ন বল ছুড়ে সে যাত্রা শেষ করবেন।’

ছেলেবেলা থেকেই একটা কথা জেনে আসছিলাম। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের না কি কখনো আবেগ স্পর্শ করে না। সেটা যে পুরোপুরি ঠিকও না তা কয়েকবারই প্রমাণ পেয়েছি। সবশেষ প্রমাণ পেয়েছিলাম এই স্মিথের কল্যাণে। ২০১৮ সালে কেপটাউনে সিরিশ কাগজ কাণ্ডের পর সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় তাঁর ভেঙে পড়ার চিত্রটা যে এখনো ভুলিনি! তেমনি ভুলিনি এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটানোর পর ব্যাট হাতে তাঁর রাজসিক প্রত্যাবর্তনটা।

ইস্পাতকঠিন মনোবল এবং হার না মানার ব্যাপারটা যে অজিদের রক্ত-মজ্জায় বিদ্যমান সেটা স্মিথ আরেকটিবার প্রমাণ করেছিলেন ২০১৯ সালের অ্যাশেজে। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বাইশ গজে ফেরার প্রথম টেস্টেই তিনি হাঁকিয়ে বসেন দুটি শতক। চার টেস্টে চোখ কপালে ওঠে যাওয়ার মতো ১১০.৫৭ গড়ে সংগ্রহ করেন ৭৭৪ রান।

এই লাইনগুলো যত সহজে লিখে ফেললাম ব্যাপারটা মোটেও ততটা সহজ ছিল না৷ ওই অ্যাশেজে স্মিথের প্রতিপক্ষ কেবল ইংরেজ ক্রিকেটাররাই ছিলেন না, ছিলেন তাঁদের ভক্ত-সমর্থকরাও। মাঠে ফিরেই স্মিথ পঞ্চাশ হাজার সমর্থকের দুয়োধ্বনি শুনেছেন। বার বার শুনেছেন। কিন্তু কানে নেননি। তিনি শুধু নিজের কাজটাতেই মনঃসংযোগ করেছেন এবং রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন। তাতেই কয়েকদিনের মধ্যে সমর্থকদের দুয়োধ্বনি রূপান্তরিত হয় করতালিতে। হয়তো তিনি স্টিভ স্মিথ বলেই তা সম্ভব করতে পেরেছিলেন।

স্টিভ স্মিথ ক্রিকেটটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। প্র-চ-ণ্ড! চলতে-ফিরতে, গোসলে এমনকি খাবারের টেবিলেও তাঁর শ্যাডো প্র্যাকটিস চলে। যে কারণে বারো মাসের নিষেধাজ্ঞাকে আপাদমস্তক ক্রিকেটপ্রাণ এই মানুষটির জন্য নির্যাতন বলে অভিহিত করেছিলেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার।

নিষেধাজ্ঞার ওই বারোটি মাসের প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি দিন তিনি আত্মদহনে পুড়েছেন। তবে পুড়ে পুড়ে ছাই হননি বরং আরও শক্ত হয়েছেন। জেগে ওঠেছিলেন ঠিক ফিনিক্স পাখির মতো, ফিরেছিলেন বীরের বেশে, আগের চেয়েও ধারালো রূপে। দুঃসময়ের চোরাবালিতে ৩৬৫ দিন আটকে থাকার পর স্মিথের সেই প্রত্যাবর্তনটা কোনোকালেই ভুলবার নয়।

এই যে মানসিক দৃঢ়তা, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, গভীর মনঃসংযোগ, অবিশ্বাস্য মনোবল এবং হার না মানার চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্মিথ স্থাপন করেছেন তা যে-কোনো উঠতি ক্রিকেটারের জন্য পাথেয় হবে। চরম দুর্দশা কাটিয়েও পূর্বের চেয়ে আরো কঠিনভাবে তাঁর ফিরে আসার যে স্পিরিট সেটা ক্রিকেটবিশ্বে আজীবন উদাহরণ হয়ে থাকবে।

এভাবেই অগ্রসর হতে থাকুক স্মিথের ক্যারিয়ারের চাকা, খেলাটাকে রাঙিয়ে এবং আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link