ছেড়া ঘুড়ি, রঙিন বল

ক্রিকেটের সাথে আইসক্রিম গাড়ির এক অমোঘ টান। গ্রীষ্মের দুপুরে ইনজামাম আউট হয় না কিছুতেই। আমরা খরখরি টেনে ঘর অন্ধকার করে বসি। ইরফান পাঠানের ইনসুইং লেগগ্লান্স করে দেয় ইনজি।

এই মোক্ষম সময়েই আমরা জানি বাইরে দিয়ে হেঁকে যাবে কাঠি আইসক্রিম, কুলপি মালাই। ভাইফোঁটায় পাওয়া জহরমানিতে টান পড়ে। এই সাদামাটা প্রলোভন ক্রিকেটীয়। আমাদের ক্রিকেট ঘোরতর প্যাভিলিয়নমুখী। আমরা সবাই ক্রিকেট খেলি। কিন্তু আমাদের হয়ে খেলে কেউ কেউ। আজিঙ্কা রাহানে আমাদের পুরোনো ব্যাট। চার নম্বর।

কৈশোরের জহরত যৌবনের ফ্ল্যাটবাড়ির এককোণায় পড়ে থাকে। বিখ্যাত ও অখ্যাতের মাঝে সেপিয়া মধ্যবিত্ত নিয়ে আমাদের যাবতীয় লেখালিখি। রাহানে ক্রিকেট খেলেন। রাহানে ড্রেসিংরুম থেকে মাঠ অবধি বয়ে আনেন কিছু মানুষকে যারা অনেকদিন বিকেলে ক্যাম্বিস বল ছুঁয়ে দেখেনি।

কিন্তু, বিরাটের উইকেট? যেন গোটা ভারতবর্ষ দুটো তেরচা বেলের মতো টইটম্বুর ব্যালেন্স করে আছে তিন স্টাম্পের মাথায়। আউট হলেই টিভি বন্ধ। অজিঙ্ক নামবেন। বাজারদরের মতো লাল ডিউক ওঠানামা করবে অফ করিডরে। আজিঙ্কা কোনোদিন জেতাবেন। কোনোদিন অসহ্য উইকেট ছুঁড়ে দেবেন স্লিপ ফিল্ডারের হাতে।

আজিঙ্কা অনিশ্চিত। রিভার্স সুইং-এর মতো দোদুল্যমান। অথচ প্রতিটা স্টান্সের আগে চোখ স্থির করে দেখে নেন চারপাশ। বিরাট-পন্থের জমকালো পশমিনার মাঝে আজিঙ্কা সেই কাঠি আইস্ক্রিমওয়ালা। সেই অনিশ্চিত হেঁকে যাওয়া। সন্ধ্যের বেখাপ্পা লোডশেডিং। আজিঙ্কা ফ্রন্ট ফুটে থমথমে, ব্যাকফুটে সাবেকি, মাঝেমধ্যে স্টেপআউট!

রাহানে ঠুকে ঠুকে পিচ দেখে ফিরে আসেন চিলেকোঠায়। আজিঙ্কা ছোটোকাগজের প্রচ্ছদ। হাওয়া দিলে সরু চেহারা ফুলে ওঠে, লিকলিকে পা চলে যায় সামনে। রাহানে ড্রাইভ করেন সারা বিকেলজুড়ে। আজিঙ্কা ফিরতি ট্রেনের জানলা সারাতেন বহুদিন। নিশ্চিত সাফল্যের পৃথিবীতে কোনো এক মাধ্যমিকের ভয়!

মিস্টার আজিঙ্কা একজন ফর্দ হারিয়ে ফেলা মধ্যবিত্ত পুরুষ। বাজারের চলতি ভিড়ে ফতুয়ার খুট দিয়ে ঘাম মুছে ফেলা ছাপোষা বাঙালি। আজিঙ্কা দু’দিন হেরে যান। একদিন জেতেন। জেতা-হারার ওপর দুলতে থাকে বাজারের দর। ও খুচরোর হিসেব গুলিয়ে ফেলে রোজ। ওর মাথার ওপর থার্মোকলের চাঁদ।

পায়ের তলায় ঝুরঝুরে উইকেট। স্টান্সের ভেতর অলস দুপুর। বয়স বাড়লে মধ্যবিত্ত মানুষের জন্মদিন কেউ মনে রাখে না। ক্যালেন্ডারে দু একটা জোনাকি এসে বসে। আজিঙ্কা ঢিলেঢালা রোববারের ঘুম। আজিঙ্কা ছেঁড়া ঘুড়ি। আজিঙ্কা রঙিন বল। আমাদের হারানো বিকেলে এইটুকু সম্বল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link