সিলেট থেকে বাংলা, ভায়া ক্যামব্রিজ

চলুন, টাইম মেশিনে চাবি ঘুরিয়ে একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭০-এর শুরুর এক শীতকাল। উত্তর কলকাতার পাবলিক পার্কে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ। প্রবীন ক্রিকেটাররা স্থানীয় তারুণ্য নির্ভর একটা লোকাল ক্লাবের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলছে।

পশ্চিমবঙ্গের কিংবদন্তিতুল্য সব ক্রিকেটাররা খেলেছিলেন সেই ম্যাচ। পঙ্কজ রায় থেকে শুরু করে কার্তিক বোস, কমল ভট্টাচার্য, অজয় বোস, প্রেমাঙশু চ্যাটার্জী, পুষ্পেন সরকার – সবাই ছিলেন সেই ম্যাচে।

আরেকজন ছিলেন। তিনি হলেন পুণ্য দত্ত। পুরো নাম পুণ্য ব্রত দত্ত। ডাক নাম বাদল। কেউ কেউ বলতো পিবি দত্ত। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যান যখন ক্রিজে আসলেন, তখন মাঠে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শকদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন, ‘এই দাদা নাকি ক্যামব্রিজ ব্লু!’

সেই গুঞ্জনটা আরো প্রবল হল, যখন ৪৬ বছর বয়সী ওই ভদ্রলোক একটা শর্ট বল পেয়ে এমন একটা পুল শট খেললেন যে বল মাঠের বাইরে থাকা রাস্তা পেরিয়ে একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় আছড়ে পড়লো।

প্রতিপক্ষের তরুণদেরও তখন শ্রদ্ধায় বুকটা ভরে উঠলো। কারণ তাঁরা জানে, একজন মাস্টারক্লাস ম্যাজিশিয়ানের ব্যাটিং দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে তাঁদের।

এই বাদল দত্ত’র জন্মস্থান কিন্তু এই বাংলাদেশ। জন্ম তাঁর সিলেটে। ১৯২৪ সালের ২১ জুন। তিনি ছিলেন এলিগ্যান্ট একজন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। সাথে কার্যকর বাঁ-হাতি স্পিন। সিলেটে জন্ম নেওয়া প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার হতে পারতেন তিনি। স্রেফ ভাগ্য সহায় হয়নি বলে সেটা আর হয়নি।

তবে, চুটিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৪৪-৪৫ মৌসুমে থেকে শুরু করে ১৯৫৫-৫৬ মৌসুম অবধি খেলেছেন। সর্বোচ্চ ১৪৩ রানের ইনিংসসহ করেছেন মোট ১৪৫৯ রান। ২৯.৭৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন চারটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি। ৩৭.০৯ গড়ে পেয়েছেন ৪১ টি উইকেট। সেরা বোলিং ফিগার ছিল ৫২ রানে পাঁচ উইকেট।

কুচবিহারের মহারাজার অধীনে বেঙ্গলের হয়ে তাঁর প্রথম শ্রেণির অভিষেক হয় ১৯৪৪-৪৫ মৌসুমে। ইডেন গার্ডেন্সের ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল ইউনাইটেড প্রোভিন্স (ইউপি)। ব্যাটিংয়ে নেমে দলীয় মাত্র এক রানের মাথায় ডাক মেরে বিদায় নেন ওপেনার অশোক চ্যাটার্জী। এরপর অভিষিক্ত ওপেনার বাদলের ৫৮ ও খোকন সেনের ৬৩ রানের সুবাদে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১২৪ রান যোগ করে বেঙ্গল। খোকন সেনের জন্মও কিন্তু কুমিল্লাতে। ইনিংস শেষ হয় ২৪৮ রানে। সফরকারীদের হয়ে এসএন গান্ধী ৯৭ রান দিয়ে পাঁচ উইকেট নেন। অভিষিক্ত আব্দুল মজিদ নেন ২৫ রান দিয়ে চার উইকেট।

জবাবে ইউপি ১৭৬ রানে অলআউট হয়। এবার বাদল তিন ওভার বোলিং করলেও কোনো উইকেট পাননি।

দ্বিতীয় ইনিংসে ফের ওপেনিংয়ে নামেন বাদল। কিন্তু মজিদের একটা ডেলিভারিতে হাঁটুতে ব্যাথা পেয়ে ‘রিটায়ার হার্ট’ হয়ে সাজঘরে ফেরেন। ২৭ রানে দলের জন্য দ্বিতীয় উইকেটের পতন হয় তখন আবারো ক্রিজে আসেন। এরপর করতে পারেন ১০ রান। বেঙ্গলের ইনিং ১৫৭-এ শেষ হয়। গান্ধী এবার ৪৪ রানে চার উইকেট পান। নিরোদ ‘পুটু’ চৌধুরী স্বাগতিকদের হয়ে ৪৯ রানে পাঁচ উইকেট নেওয়ায় জয় আসে ৭৫ রানের ব্যবধানে। ১৯৪৫-৪৬ মৌসুমে ইউপির বিপক্ষে এর পরের ম্যাচটাতেই বাদল দুই ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি (৬৩ ও ৫১) করেন।

ইতিহাস বলে, বড় বোলারদের বিপক্ষে ভাল সামলেছেন পুণ্য। রোহিনটন বাড়িয়া ট্রফিতে একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ম্যাচ হল। সেটা ১৯৪৫-৪৬ মৌসুমের কথা। সেবার দুই ইনিংসে ৩০ ও ২৭ রান করলেন এই পূণ্য। বল হাতে ৫৪ রানে নেন দুই উইকেট। পাঞ্জাবের বোলিং আক্রমণে ছিলেন ফজল মাহমুদ ও খান মোহাম্মদ। পাঞ্জাব অবশ্য ম্যাচটায় ৫৪ রানে জিতে।

বাদল দত্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ব্লু ছিলেন সেটা তো বলাই হল। শুধু তাই নয়, তিনি ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত কুইডনাঙ্কস ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যও ছিলেন। এই ক্লাবে মূলত ক্যামব্রিজ ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়রাই সুযোগ পেতেন। বিশেষ করে যারা এগিয়ে থাকতেন তাঁদের সুযোগ আসতো। তাঁদের ইতিহাসে সদস্য মাত্র ২০৯ জন, তাঁদের একজন বাদল।

১৯৪৭ সালে বদল রঞ্জিৎসিঞ্জি কিংবা দুলীপসিঞ্জির মত ক্যামব্রিজের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। প্রথম মৌসুমে তিনি ১৩ ম্যাচ খেলেন, সেবারই ব্লু পেয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে করেন ৩২০ রান। সর্বোচ্চ ছিল ৪৭ রানের একটা ইনিংস। গড় ২২.৮৫। ছয়টা ক্যাচ ধরেন, ২৯ টা উইকেট নেন। বিশ্ববিদ্যালয় দলে সুযোগ পাওয়াটাও অটোমেটিক ছিল না। দু’টো ট্রায়াল ম্যাচের পরই সেই সুযোগ মেলে। বোঝাই যাচ্ছে বাদল সেই পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন।

সেই ট্রায়াল ম্যাচে তিনি দারুণ করেন। ‘এ’ ও ‘বি’ দলের ম্যাচে ৮১ রানের ইনিংস খেলেন। ২৯ রান দিয়ে এক ইনিংসে চার উইকেট নেন। পরের ম্যাচে নেন পাঁচ উইকেট, এর মধ্যে ছিল স্বয়ং ট্রেভর বেইলির উইকেট। ম্যাচে একটা ইনিংসই হয়। বাদল ব্যাট করার সুযোগই পাননি। ক্যামব্রিজে তাঁর সাথে একই সাথেই অভিষেক হয় বেইলি। বেইলি অবশ্য পরে চলে এসেক্সে, সেখানে তিনি কিংবদন্তি বনেছেন। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। আরো ছিল হিউ ওয়াটস, তিনি পরে খেলেন সামারসেটের হয়ে।

বাঁ-হাতি স্পিনে তিনি নিয়মিত উইকেট পেতেন। সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক ট্যুর ম্যাচে দুই ইনিংসে মাত্র ২৪ রান করলেও বল হাতে ৮২ রান দিয়ে তিন উইকেট নিয়েছিলেন, এর মধ্যে ছিল অধিনায়ক অ্যালান মেলভিলের উইকেটও।

তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি আসে ইডেন গার্ডেন্সে। বাংলার হয়ে, বিহারের বিপক্ষে। ১৯৫২-৫৩ মৌসুমের সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে বাংলা ৩২৩ রান করে। প্রথম ইনিংসে ৬২ রান করা দত্ত ছিলেন সর্বোচ্চ সংগ্রাহক। বিহার জবাবে শুটে ব্যানার্জির ১৩৮ রানের ইনিংসে ভর করে ২৩৫ রান করে। স্বাগতিকদের হয়ে মন্টু ব্যানার্জি নেন ৬৬ রানে সাত উইকেট।

দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলা দল পাঁচ উইকেটে ৩৫৪ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। দত্ত ১৪৩ রান করেন, ২২৫ মিনিট ব্যাটিং করে ১৬ টি চার হাঁকান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এটাই তাঁর সর্বোচ্চ সংগ্রহ। বেনু দাস গুপ্ত ১০৪ রান করেন। বিহার পরে ১৪০ রান করতেই সাত উইকেট হারায়। এরপর আর খেলা চালানো যায়নি, ড্র মেনে নেয় দু’দল।

দত্তর আরেকটা স্মরণীয় ইনিংস ছিল এই ইডেন গার্ডেন্সেই। হোলকারের বিপক্ষে। টপ অর্ডারে নেমে ১৪১ রান করেন। ৩৩৩ মিনিটের ইনিংস ছিল ১৩ টি চার। বাংলা দল প্রথম ইনিংসে করে ৪৭৯ রান। হোলকার প্রথম ইনিংসে করে ৪৯৬ রান। বিবি নিম্বলকর করেন ২১৯ রান, সাথে মুশতাক আলী ৯৯ রানের এক ইনিংস খেলেন।

বাংলা দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেটে ৩২০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। ম্যাচটা ড্র হয়। নয় উইকেট হারিয়ে ১৭৭ রান করে কোনোক্রমে পরাজয় আটকায় হোলকার।

দত্তর এর পরের দু’টি সেঞ্চুরি আসে উড়িষ্যা ও বিহারের বিপক্ষে। কোটাকে দত্ত অধিনায়ক হিসেবে নামেন। ওপেন করেন পঙ্কজ রায়ের সাথে। করেন ১১০ রান। বাংলা চার উইকেটে ৩২৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। উড়িষ্যা মোটে ৫৮ রানেই অলআউট হয়, পরে ফলোঅনে পরে করে ১২৬ রান। সেই ম্যাচে খোকন সেন উইকেটরক্ষক পরিচয় ভুলে বোলিং করেন, উড়িষ্যার দ্বিতীয় ইনিংসে হ্যাটট্রিক করেন।

বিহারের বিপক্ষে পরের ম্যাচটা হয় ইডেন গার্ডেন্সে। বাংলা প্রথম ইনিংসে করে ৩০৯ রান। উইকেটরক্ষক খোকন সর্বোচ্চ ৬৫ রান করে। শুটে ব্যানার্জি বল হাতে সফল ছিলেন, ৭০ রানে নেন চার উইকেট। বিহার প্রথম ইনিংসে করে ১১৯ রান। চ্যাটার্জি পাঁচটি ও চৌধুরী চারটি উইকেট নেন।

দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলা নয় উইকেটে ৪২১ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। অনিল ভট্টাচার্য্য ১২৫ ও দত্ত ১১৫ করেন। পঞ্চম উইকেটে তাঁরা ২২১ রান করে যোগ করেন। বিহার কোনক্রমে পরাজয় এড়ায়। আট উইকেট হারিয়ে শেষ ইনিংসে করে ১৬৯ রান।

দত্তর শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ছিল মধ্য প্রদেশের বিপক্ষে, ইডেনেই। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে। ম্যাচটা ভাল কাটেনি দত্তর। একটা ইনিংসে ব্যাট করতে পারেন। পাঁচ রান করেন, কোনো উইকেট পাননি। বাংলা অবশ্য ১০ রানে জিতে গিয়েছিল।

৩৪ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে প্রায় ৩০ গড়ে ব্যাট করেছেন, রান প্রায় ১৫০০’র মত। উইকেট ৪১ টা। জাতীয় দলে সুযোগ পাননি কখনোই। অল্পের জন্য হতে পারেননি সিলেটে জন্ম নেওয়া প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার। অবসরের পরও ক্রিকেটের সাথেই ছিলেন। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েয়েশন অব বেঙ্গলে (সিএবি) ছিলেন।

ব্রিটেনে পড়াশোনার কারণেই কি না – চালচলন, কথাবার্তা ছিল পুরো সাহেবদের মত। বাংলায় ওই সময় নাকি তাঁর মত ভাল স্পিন আর কেউ খেলতে পারতেন না। দিব্যি টেস্ট খেলতে পারতেন বাদল। স্বয়ং চুনী গোস্বামী আনন্দবাজারে লেখা এক কলামে বলে গেছেন, ‘ক্রিকেট জীবনে নিজের সেরা সময়ে স্পিনের বিরুদ্ধে ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা ব্যাট। বলতে দ্বিধা নেই বাংলার হয়ে ওঁর মতো অত ভাল স্পিন খেলতে আমি কাউকে দেখিনি। পঙ্কজ রায়কে মাথায় রেখেও এ কথা বলছি। ওঁর প্রতিভার ঠিক মতো বিচার হয়নি। হলে ভারতের হয়ে খেলা উচিৎ ছিল বাদলদার। স্পিনের বিরুদ্ধে ওঁর ফুটওয়ার্কটাই ছিল দেখার মতো। ক্রিকেটার জীবনে আমিও অনেক সময় স্পিন খেলতে গিয়ে ওঁর মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি।’

অধিনায়ক হিসেবেও ওই সময় বেশ রেট করা হত এই বাদল দত্তকে। গোপাল বসু বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ক্রিকেটার থাকেন, তাঁরা যেখানে খেলবেন, ক্যাপ্টেন হয়েই খেলেন৷ বাদলদা তেমনই বিরল প্রজাতির ক্রিকেটার৷’

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link