সাফল্য। ব্যর্থতা। হতাশা। উচ্ছ্বাস। অন্ধকার ঘরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে একটা লোক। পাশে একগ্লাস জল রেখে গেল কেউ। তিনি জানেন কেন ঘন অন্ধকারেও চোখ বুজে থাকে লোকটা। আসলে অন্ধকারে চেয়ে থাকা এক ধরণের বোকামি৷ যে অন্ধকার ঘরে চোখ মেলে থাকে সে অন্ধকারই দেখতে চায়। অথচ চোখ বুজলে অজস্র আলো দেখা যায়। যার ঝকঝকে রেখার মধ্যে ট্রাপিজের মতো খেলে উপরের শব্দগুলো। সাফল্য-ব্যর্থতা-উচ্ছ্বাস।
‘আপনার একটা ফেরারি আছে। তার সাথে আমার একটা ছোট্ট গাড়ি। রেসে জিততে হলে আপনার চাকা আমাকে ভাঙতেই হবে, কিংবা আপনার তেলের ট্যাংকে চিনি ঢালতে হবে।’ – খিলখিল করে ট্রেডমার্ক হাসিটা হেসেই শান্ত হয়ে গেলেন দ্য স্পেশাল ওয়ান।
বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণময় মানুষটিই একমাত্র মানুষ যিনি নিজেই নিজেকে সবার সামনে অকপটে বলে দিতে পারেন- ‘আমি জানি আমি স্পেশাল ওয়ান।’ এবং এমন একটা সময়ে যখন তাঁকে বিশ্বের স্পেশাল ওয়ান বলে মেনে নেওয়ার অনেক যোজন দূরে দাঁড়িয়ে, ফুটবলের সবচেয়ে কঠিন অগ্নিকুণ্ডে পা রাখছেন তিনি। লন্ডনের স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের প্রথম প্রেস কনফারেন্স।
হোসে মরিনহো বাইবেলের মতোই যেন ঐ মুহুর্তে লিখেছিলেন একটা দর্শন, ‘তোমার মানসিকতাই নির্ধারণ করে দেবে তুমি কী হতে এসেছ, বিজয়ী না পরাজিত!’
মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা আশ্চর্য গন্ধ যেন জন্মলগ্ন থেকেই মিশে গিয়েছিল মোরিনহোর জীবনদর্শনে। ববি রবসনের ইন্টারপ্রিটার ও সহকারী রূপে মোরিনহো যখন কাজ শুরু করেন মোরিনহো ফুটবলকে দেখেছিলেন উল্টোভাবে। ঠিক যেভাবে জোনাথান উইলসন দেখছেন ফুটবলের পিরামিড ও ইনভার্টেড পিরামিডকে। ববি রবসনের কোচিং স্টাইলে ফুটবলের জনপ্রিয় ও বহুল চর্চিত দিকটিই ছিল মুখ্য।
‘ইউজ দ্যা স্পেস’ অর্থাৎ স্পেসকে ব্যবহার করে আক্রমণ। ‘রিডিউস দ্য টাইম’ অর্থাৎ গতি বাড়িয়ে আক্রমণ। মোরিনহো আইনস্টাইনের মতোই স্পেস-টাইম কার্ভ উল্টে নিজের ভেতর গড়ে নিয়েছিলেন একেবারে উল্টো একটা তত্ত্ব। যা বলে- ‘রিডিউস দ্য স্পেস’ বা প্রতিপক্ষকে জায়গা ব্যবহার করতে দিও না এবং ‘ইনক্রিস দ্য টাইম’ অর্থাৎ প্রতিপক্ষের আক্রমণের গতিকে শ্লথ করা।
ববি রবসনের সাথে থেকে মরিনহো ক্রমশই যে স্বতন্ত্র এক ফুটবল বিজ্ঞান বুনে ফেলছিলেন ভেতরে তা ক্রমশই বুঝতে পারেন রবসন। এরপর লুই ভ্যান গালের সাথে কাজের সময়তেও নিজের মস্তিষ্কের জটিল ক্যালকুলাসের জট ছাড়াচ্ছিলেন মরিনহো।
পোর্তোর দায়িত্বটাই যেন মরিনহোর হাতে তুলে দিল সাদামাটা মধ্যবিত্ততার ভেতর থেকে নিজেকে মুচড়ে বের করে আনার ম্যাজিক স্টিক। মরিনহো ক্রমশই নিজের এতদিনের গড়ে তোলা সায়েন্সবুকটা খুলে দিচ্ছিলেন ইউসেবিওর দেশে, নিজের দেশে।
আর অঙ্ক মিলে গেলে হয়ত দিনশেষে মিলে যায় সব, তেমনই ৩২ ম্যাচের পর্তুগিজ লিগে ২৭ ম্যাচ জিতে রেকর্ড পয়েন্ট নিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বেনফিকার থেকে ১১ পয়েন্ট আগে লিগ চ্যাম্পিয়ন করে দিলেন পোর্তোকে। পরের বছর আবার ইতিহাস। পোর্তোর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ট মরশুমের জাদুকর হলেন মোরিনহো। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চাণক্য স্যার আলেক্স ফার্গুসনের সামনে সাইডলাইন দেখল এক ফুটবল জিনিয়াসের উত্থান।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি হয় না’, কিন্তু মরিনহো প্রথম প্রবাদের বিপক্ষে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, ‘যদি চচ্চড়িকেই আমি বিরিয়ানির চেয়ে সুস্বাদু বানাতে পারি?’
চেলসি থেকে ইন্টার মিলান, মাদ্রিদ থেকে ম্যানচেস্টার – মরিনহো ফুটবল গবেষণার একটা করে বই ফেলে যাচ্ছিলেন ইউরোপজুড়ে, সাথে ভরে উঠছিল ট্রফি ক্যাবিনেট। ক্রুয়েফীয় তত্ব বলে বলের দখলের মাধ্যমে স্পেসের দখল ম্যাচ জেতায় আর মরিনহো তাকে ভেঙেচুড়ে বলেন, বলের দখল বিপজ্জনক, বলছাড়া স্পেস ব্যবহারই ম্যাচ জেতায়।
তাই বিজ্ঞানের প্রতিবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করতেই মরিনহো ছুটেছেন ফুটবলের পথ ধরে। সে পথে হয়ত আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো সৌন্দর্য নেই, পেপ গার্দিওলার মতো পাসিং মাদকতা নেই কিন্তু আছে আলেকজান্ডারের সামনে সামান্যপুঁজির পুরু হয়েও লড়াই জিতে নেবার অদম্য জেদ, যা নিজেই এই স্বতন্ত্র ফুটবল সংস্কৃতি।
চেলসিতে ক্লদিও ম্যাকালেলে কে ব্যবহার করলেন মরিনহো, সারাবিশ্ব দেখল এক অন্য ম্যাকালেলেকে। সারাবিশ্বের সামনে নিয়ে এলেন তিন ডিফেন্সিভ হাফ বা ট্রিভিয়ট সেস্টেম যার জাঁতাকলে আটকে গেল একের পর এক ফুটবল মহারথী। মরিনহোর বিখ্যাত ট্রিভিয়টে কখনো খেলেছেন ম্যাকালেলে-ল্যাম্পার্ড-এসিয়েন আবার কখনো আলোন্সো-খেদিরা-দিয়ারা।
মরিনহোর ফুটবল দর্শনের যে জাল তাতে ত্রিকোণা জোনাল মার্কিং, ম্যান টু ম্যান টাইট প্রেস আর সেন্ট্রাল করিডোর কাউন্টারের ত্রিমুখী নাগপাশে আটকে গেছেন বহু রথী-মহারথী। আর মোরিনহো ছুটেছেন আপন খেয়ালে, ক্যাম্প ন্যু- স্তব্ধ করে দিয়ে সেই দৌড় যেন সৌন্দর্যের সীমাবদ্ধতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে তার গণ্ডি। পাল্টেছে জার্সি, পাল্টেছে তার পিছনের নাম কিন্তু স্পেশাল ওয়ান থেকে গেছেন সেই অসীম রহস্যমাঝেই।
‘আমার ফুটবল অবিধানে ফেয়াল বলতে কোনো শব্দ নেই’ – বলেই মুচকি হেসে প্রেস কনফারেন্স ছেড়ে উঠে যান দ্যা স্পেশাল ওয়ান। টাইম আর স্পেস নিয়ে কোনো একটা অনন্ত দাবার ছকে মুখোমুখি বসেন তিনি। আড়াই চালের প্যাঁচে হাঁফিয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। তিনি জানেন, জানেন কীভাবে বিজ্ঞান পাথরে ফুল ফোটাতে পারে,কোনো ম্যাজিশিয়ান নন, অসীম রহস্য মাঝে তিনি আদতে এক বিজ্ঞানী, ফুটবল বিজ্ঞানী।
ওই যে অন্ধকার ঘরে চোখ খুলে রাখে যারা তারা শুধু অন্ধকারই দেখতে চায়, আমি আলোর মানুষ, আলোর খোঁজে চোখ বন্ধ করতে হলেও আমি রাজি। আমার প্রবাদ বলে, ‘এভ্রিথিঙ ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’